আমি বললাম, খালাজি সুপ্ৰভাত।
খালা বললেন, সুপ্ৰভাত মানে? তুই কী চাস? কী জন্যে এসেছিস? চাদমুখ দেখাতে এসেছিস? তোর চাদমুখ কে দেখতে চায়?
আমি বললাম, রেগে আছ কেন খালা?
রেগে থাকব না তো কী করব? তোকে কোলে করে নাচানাচি করব? আয়, কোলে আয়।
খালা সত্যি সত্যি দুহাত বাড়ালেন। তার মানে খালার রাগ এখন তুঙ্গস্পশী। তুঙ্গস্পশী রাগের বড় সুবিধা হচ্ছে–এই রাগ ঝট করে নেমে যায়। রাগ নামানোর জন্যে তেমন কিছু করতে হয় না। আপনা। আপনি নামে। সাধারণ পর্যায়ের রাগ নামতে সময় লাগে। রাগ নামানোর জন্যে কাঠ-খড়ও পোড়াতে হয়। আমি খালার রাগ নামার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে না। খালার মুখ দেখে মনে হচ্ছে রাগ নামি নামি করছে।
খালা বললেন, তুই নিজেকে কী ভাবিস? খোলাসা করে বল তো শুনি? এক সপ্তাহ হয়েছে আসমা এসেছে। রোজ তোর খোঁজ করছে। আমি দুবেলা তোর কাছে লোক পাঠাচ্ছি। আর তুই হাওয়া হয়ে গেলি? কোথায় ছিলি?
আমি মিনমিন করে বললাম, আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক মহিলার কাছে গিয়েছিলাম।
কী সম্পন্ন মহিলা?
আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন। সাইকিক। ইনি যে-কোনো মানুষের ভূতভবিষ্যৎবর্তমান দেখতে পারেন। সময়ের কঠিন বন্ধন থেকে উনি মুক্ত। উনার নাম তারাবিবি। ইংরেজিতে Star Lady.
একটা থাপ্পড় যে তুই আমার কাছে খাবি!
থাপ্পড় দিতে চাইলে দাও। তবে তারাবিবির কাছে একবার তোমাকে নিয়ে যাব। উনি আবার গাছ-গাছড়ার ওষুধও দেন। কয়েকটা গাছের ছাল বাকল হামানদিস্তায় পিষে দেবেন। খাওয়ার পরে দেখবে ওজন কমতে শুরু করেছে। দৈনিক এক কেজি করে। যদি কমে তাহলে চারমাসের পর তুমি মোটামুটি একটা শেপে চলে আসবে। রিকশায় উঠতে পারবে। চাকার পাম্প চলে যাবে না।
আমাকে নিয়ে তোর এত দুশ্চিন্তা এটা তো জানতাম না?
আমি সোফায় বসলাম। খালার তুঙ্গস্পশী রাগ এখন সমতল ভূমিতে নেমেছে। তবে তিনি প্ৰাণপণে রাগ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তেমন লাভ হচ্ছে না। তারাবিবির বিষয়ে কৌতূহলে তাঁর চোখ চকচক করছে।
মহিলার কি নাম বললি?
তারাবিবি। The great star lady। তবে আশেপাশের সবাই তাকে মামা ডাকে।
মামা ডাকে মানে! একজন মহিলাকে মামা ডাকবে কেন?
সিস্টেম এরকম দাঁড়িয়ে গেছে। উনি যে লেভেলে চলে গেছেন সেই লেভেলে নারীপুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। উনার নিজের ছেলেমেয়েরাও উনাকে মামা ডাকে। তার স্বামী বেচারাও মামা ডাকে।
আবার তুই আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস?
বিশ্বাস কর খালা, কোনো ফাজলামি না।
উনার কি সত্যি সত্যি ক্ষমতা আছে?
অবশ্যই আছে। ক্ষমতা না থাকলে নিজের স্বামী তাকে কোন দুঃখে মামা ডাকবে? জগতের কোনো স্ত্রী কি সহ্য করবে–স্বামী তাকে সিরিয়াসলি মামা বলে ডাকছে? তুমি সহ্য করতে? দৃশ্যটা কল্পনা কর, খালু সাহেব তোমাকে ওগো না বলে গম্ভীর গলায় মামা ডাকছেন।
ওগো সে আমাকে কখনো ডাকে না।
কী ডাকে?
কিছুই ডাকে না। হুঁ-হ্যাঁ দিয়ে সারে। এখন তো ডাকাডাকি পুরোপুরি বন্ধ। গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে না।
গলা এখনো ঠিক হয় নি?
না।
চিকিৎসা চলছে না?
চলছে, তবে দেশী চিকিৎসার উপর থেকে আমার মন উঠে গেছে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মাদ্ৰাজ?
না জেনে কথা বলিস কেন তুই? মাদ্রাজে হয় চোখের চিকিৎসা। নেত্র হসপিটাল। আমি তোর খালুকে নিয়ে যাচ্ছি বোম্বেতে।
কথা না বলা রোগের চিকিৎসা কি বম্বেতে ভালো হয়?
তুই চুপ করে থাক। তোর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া যন্ত্রণার মতো।
আমি বললাম, খালু সাহেব কথা বলতে পারছেন না–এটা তো তোমার জন্য ভালোই হলো। উনার কথা শুনলেই তো তোমার রাগ উঠে যেত। এখন নিশ্চয়ই নিমেষে নিমেষে। রাগ উঠছে না?
খালা বললেন, খামাক বকর-বকর না করে তুই চুপ করবি?
আচ্ছা চুপ করলাম।
সকালে নাশতা খেয়েছিস?
না।
এগারোটা বাজে, এখনো নাশতা খাস নি? আলসার-ফালসার বাঁধিয়ে একটা কাণ্ড না হওয়া পর্যন্ত ভালো লাগে না? কী খাবি?
গোশত পরোটা। ডাবল ডিমের ওমলেট, সবজি। সবশেষে সিজনাল ফ্রুটস।
মাজেদা খালা ভয়ঙ্কর মুখ করে বললেন— তুই ভেবেছিস কী? আমার বাড়িটা ফাইভ স্টার হোটেল? গড়গড় করে মেনু দিয়ে দিলি–টেবিলে নাশতা চলে এলো।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তাহলে এক কাজ কর— গত রাতের ফ্রিজে রেখে দেয়া ঠাণ্ডা। কড়কড়া ভাত দাও। বাসি। তরকারির ঝোল-টোল থাকলে দাও। বাসি। তরকারি মাখা কড়কড়া ভাত। খেতে খারাপ হবে না।
খালা কঠিন গলায় বললেন, চুপ করে বসে থাক। আমি নাশতা নিয়ে আসছি। একটু সময় লাগবে। খবরের কাগজ পড়। কিংবা তোর খালুর সামনে বসে থাক। সে কথা বলতে পারে না। কিন্তু অন্যরা কথা বললে খুশি হয়। মাঝে মাঝে টুকটাক জবাব দেয়।
কীভাবে জবাব দেন? ইশারায়?
না। ঘরে একটা বোর্ড লাগিয়েছি। চক আছে। বোর্ডে চক দিয়ে লেখে।
আমার কথা শুনলে খুশি হবেন বলে তো মনে হয় না। আমার ছায়া দেখলেই উনি রেগে যান।
ভদ্রভাবে কথা বলবি। চেটাং চেটাং করবি না। তাহলে রাগবে না।
উনার কথা বলা বন্ধ হলো কীভাবে?
নাশতার টেবিলে বসেছে। আমি একটা ডিম পোচ করে সামনে রেখেছি। ডিম পোচটার দিকে তাকিয়ে বলল— আচ্ছা ডিম… বাকিটা বলতে পারল না। কথা গলায় আটকে গেল।
আমি খালু সাহেবকে দেখতে গেলাম।
খালু সাহেবের বয়স মনে হচ্ছে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। খাটের উপর জবুথবু বৃদ্ধ টাইপ একজন বসে আছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, উনার চেহারা আগে যেমন ছিল। এখনো তেমনি আছে। আধাপাকা চুল। চিমশে ধরনের মুখ। কপালের চামড়ায় নতুন কোনো ভাঁজ পড়ে নি। তাহলে লোকটাকে হঠাৎ এতটা বুড়ো লাগছে কেন? আমি হাসি। হাসি মুখ করে বললাম, খালু সাহেব, ভালো আছেন? তিনি বৃদ্ধদের শুকনা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।