গত পরশু যখন ফরিদাকে দেখতে গেলাম, তখন দেখি তার মাথার কাছে এক প্যাকেট বিদেশী চকলেট। সে প্যাকেট থেকে চকলেট বের করে। বলল, নাও। চকলেট খাও। আমি বললাম, চকলেট কে দিয়েছে? ফরিদা কিছু বলল না, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসল।
হিমু ভাই, আমার মনের ভেতর কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে আপনি জানেন না। আমার আর এক ্মুহূর্ত বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করছে না। শুধু ইমরুলের জন্যে বেঁচে আছি। এবং প্রতিমুহূর্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়। আপনার উপর দায়িত্ব, আপনি জেনে দিন ঘটনা কী?
যে লোক চকলেট নিয়ে এসেছে সে যদি ফরিদার পুরনো প্রেমিক হয় তাহলে ঘটনা কোন দিকে যাবে তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
এই হারামজাদা এখন বলবে। আমি ফরিদার চিকিৎসার খরচ দিব। মহৎ সাজার চেষ্টা। হিমু ভাই, এ ধরনের লোককে আমি চিনি। এই মতলববাজরা মতলব নিয়ে ঘোরে। অন্য আরেক লোকের স্ত্রী নিয়ে তোর মাথাব্যথা কেন? তুই মহৎ সাজতে চাস মহৎ সাজ। স্কুল দে, হাসপাতাল দে, তোকে তো কেউ মানা করছে না।
হিমু ভাই শুনুন, এই ব্যাটার টাকায় আমি আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করোব না। কক্ষনো না। ফরিদা যদি চোখের সামনে ছটফট করতে করতে মারা যায় তাহলেও না। এই লোক যদি ফরিদার চিকিৎসার খরচ সম্পর্কে কোনো কথা বলে তাহলে জুতিয়ে হারামজাদার আমি দাঁত ভেঙে দেব।
হিমু ভাই, উল্টাপাল্টা কীসব লিখছি আমি নিজেও জানি না। রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। একটা কিছু ঘটনা আমি অবশ্যই ঘটাব। এখন আপনি এসে পুরো ঘটনার হাল ধরুন। আপনার কাছে এই আমার অনুরোধ।
মন অসম্ভব খারাপ। রাতে ঘুম হয় না। গত রাতে সেভেন পয়েন্ট ফাইভ মিলিগ্রামের দুটো ডরমিকাম খেয়েও সারারাত জেগে বসেছিলাম। শেষ রাতের দিকে বুকে ব্যথা শুরু হলো। সেই সঙ্গে ঘাম। হার্ট এটাক-ফেটাক হয়েছে বলে শুরুতে ভেবেছিলাম। ঐ শুয়োরের বাচ্চা সত্যি সত্যি ফরিদাকে দেখতে এসেছে–এটা জানায় আগে আমার মৃত্যু হলে ভালো হতো। তা হবে না, কারণ আমি হচ্ছি। এই পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান অভাগা।
হিমু ভাই, আপনি আমার ব্যাপারটা একটু দেখেন। ফরিদকে জিজ্ঞেস করে কায়দা করে জেনে নেন–সত্যি সত্যি সে এসেছে কি না।
ইতি হাবিবুর রহমান
পুনশ্চ-১ : হিমু ভাই, শুয়োরটার নাম রশিদুল করিম। নিউ জার্সিতে থাকে। বলে বেড়ায় কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করেছে। আমার ধারণা–সব ভুয়া। খোঁজ নিলে জানা যাবে পেট্রোল পাম্পে গাড়িতে তেল ঢালে।
পুনশ্চ-২ : হিমু ভাই, আমি যে আমার সংসারের গোপন কথা আপনাকে জানিয়েছি। এটা যেন ফরিদা জানতে না পারে। আপনাকে দোহাই লাগে।
***
প্রিয় বৃষ্টি ভাইজান,
হিমু ভাই, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে? বৃষ্টি শুরু হয় শেষ রাতে। বৃষ্টি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি আয়োজন করে বৃষ্টির শব্দ শুনি। বৃষ্টির শব্দ যে আয়োজন করে শোনা যায় এটা আমি শিখেছি আপনার কাছে। প্রথম যেদিন আপনি টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্যে আমাদের বাসায় এসেছিলেন সেদিন আপনাকে ধান্ধবাজ মানুষ মনে হয়েছিল। যখন দেখলাম। আপনি সত্যি সত্যি খুব আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছেন তখন আপনার প্রতি আমার শুরুতে যে মিথ্যা ধারণা হয়েছিল। তার জন্যে খুব লজ্জা পেয়েছি।
হিমু ভাই, আমার এখন চিঠি লেখা রোগ হয়েছে। আয়াকে দিয়ে চিঠি লেখার কাগজ-খাম আনিয়েছি। সন্ট্যাম্প আনিয়েছি। পরিচিত অপরিচিত সবার কাছে চিঠি লিখছি। আপনি শুনে খুবই অবাক হবেন যে আমি আমার স্কুলজীবনের এক বান্ধবী লুনাকেও চিঠি লিখেছি। সে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জন্ডিস হয়ে মারা গিয়েছিল। লুনাকে লেখা চিঠিটা আমি বালিশের নিচে রেখে দিয়েছি। আপনার কি ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমার ধারণা আমার মাথা ঠিকই আছে। আমার শরীর অসুস্থ কিন্তু মাথা সুস্থ।
আমি যে পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে চিঠি লিখছি তার পেছনে কোনো কারণ নেই। কিন্তু আপনাকে চিঠি লেখার পেছনে কারণ আছে। আপনি দয়া করে ইমরুলের বাবাকে একটু শান্ত করবেন। সে আমার চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের চিন্তায় আধাপাগলের মতো হয়ে আছে। আধাপাগল হলে তো লাভ হবে না। টাকা এমন জিনিস যে পাগল হলেও জোগাড় হয় না। ওর কিছু বড়লোক আত্মীয়স্বজন আছে। এক মামা আছেন কোটিপতি। আমার ধারণা সে প্রতিদিন একবার বড়লোক আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো উপস্থিত। হচ্ছে। আমার ভাবতেই খারাপ লাগছে।
ওর কোটিপতি মামার বাড়িতে বিয়ের পর আমি একবার গিয়েছিলাম। সে-ই আমাকে খুব আগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিল। এক ঘণ্টা সেই বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে থাকার পর ভদ্রলোক খবর পাঠালেন। আজ তাঁর শরীর খারাপ। নিচে নামবেন না। আরেকদিন যেন যাই। সেই দিন আমি যে কষ্ট পেয়েছিলাম। এত কষ্ট কোনোদিন পাই নি। আমার ধারণা টাকার সন্ধানে গিয়ে ইমরুলের বাবা রোজ এই কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। টাকা এত বড় জিনিস আমার ধারণা ছিল না। সারাজীবন শুনে এসেছি অর্থ অনার্থের মূল। অর্থ তুচ্ছ। আজ টের পাচ্ছি। অর্থ অনেক বড় জিনিস।
হিমু ভাই, আপনি ওকে শান্ত করুন। ওর অস্থিরতা দূর করুন।
বিনীতা
ফরিদা
পুনশ্চ-১ : কামরুলের আঁকা ভূতের ছবি যেটা আপনি আমার বেডের পাশের দেয়ালে টানিয়েছেন সেই ছবি সুপার হিট করেছে। ডাক্তার নার্স যেই আসে। সেই কিছুক্ষণ ছবি দেখে। অদ্ভুত ভুত দেখে খুব মজা পায়।
মাজেদা খালা দরজা খুলে
মাজেদা খালা দরজা খুলে কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবটা এরকম যে আমাকে চিনতে পারছেন না। যেন আমি মানুষ না, অন্য গ্রহের কোনো প্রাণী। ফ্লাইং সসারে করে এসেছি। যান্ত্রিক গণ্ডগোলে ফ্লাইং সসার স্টার্ট নিচ্ছে না। আমি ফ্লাইং সসার। লুকিয়ে রেখে এই বাড়িতে এসেছি। খাদ্যের সন্ধানে। সপ্তাহখানিকের খাবার-দাবার নিয়ে উড়ে চলে যাব।