আমি এবং বাদল ওদের এগারটার ট্রেনে তুলে দিতে এলাম। ফুপা-ফুপু এলেন না। ফুপার শরীর খারাপ করছে।
ট্রেন ছাড়বার আগমূহুর্তে রিনকি বলল, হিমু ভাই আমার কেমন জানি ভয় ভয় করছে।
কীসের ভয়?
এত আনন্দ লাগছে। আনন্দের পরই তো কষ্ট আসে। যদি খুব কষ্ট আসে?
কষ্ট আসবে না। তোদের জীবন হবে আনন্দময়। তোদের আমি আমার ময়ূরাক্ষী নদী ব্যবহার করতে দিয়েছি। এই নদী যারা ব্যবহার কেও তাদের জীবনে কষ্ট আসে না।
তুমি কী যে পাগলের মত কথা মাঝে মাঝে বল। কিসের নদী?
আছে একটা নদী।। আমি আমার অতিপ্রিয় মানুষদের শুধু সেই নদী ব্যবহার করতে দিই। অন্য কাউকে দিই না, তুই আমার অতি প্রিয় একজন। যদিও খানিকটা বোকা। তবু প্রিয়।
তুমি একটা পাগল। তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার।
ট্রেন নড়ে উঠল। আমি জানালার সঙ্গে সঙ্গে এগুতে লাগলাম। রিনকির আনন্দময় মুখ দেখতে এত ভালো লাগছে। রিনকির চোখে এখন জল। সে কাঁদছে। আমি মনে মনে বললাম–হে ঈশ্বর, এই কান্নাই রিনকি নামের মেয়েটির জীবনের শেষ কান্না হোক।
ময়ূরাক্ষী ৫/৮
প্রায় দশদিন পর আস্তানায় ফিরলাম।
আস্তানা মানে মজিদের মেস–দি নিউ বোর্ডিং হাউস।
মজিদ ঐ বোর্ডিং হাউসে দীর্ঘদিন ধরে আছে। কলেজে যখন পড়তে আসে তখন এই অন্ধ গহ্বর খুঁজে বের করে। নামমাত্র ভাড়ায় একটা ঘর। সেই ঘরে একটা চৌকি, একটা টেবিল। চেয়ারের ব্যবস্থা নেই কারণ চেয়ার পাতার জায়গা নেই।
মজিদের চৌকিতে একটা শীতল পাটি শীত-গ্রীষ্ম সবসময় পাতা থাকে। মশারিও খাটানো থাকে। প্রতিদিন মশারি তোলা এবং মশারি ফেলার সময় মজিদের নেই। তাকে সকাল থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত নানান ধান্ধায় ঘুরতে হয়, প্রতিমাসে তিনটি মানি অর্ডার করতে হয়। একটা দেশের বাড়িতে, একটা তার বিধাব বড়বোনের কাছে এবং তৃতীয়টি আবু কালাম বলে এক ভদ্রলোককে। এই ভদ্রলোক মজিদের কোনো আত্নীয় নন। তাকে প্রতিমাসে কেন টাকা পাঠাতে হয় তা মজিদ কখনো বলে নি। জিজ্ঞেস করলে হাসে। এইসব রহস্যের কারণেই মজিদকে আমার বেশ পছন্দ। আমাকে মজিদের পছন্দ কিনা জানি না। সে মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অন্যগ্রহ নিয়ে মেশে। কোনোকিছুতেই অবাক বা বিস্ময় প্রকাশ করে না। সম্ভবত শৈশবেই তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় তাকে একবার একটা ম্যাজিক শো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাচ এক জাদুকর জার্মান কালচারাল সেন্টারে জাদু দেখাচ্ছেন । বিস্ময়কর কান্ডকারখানা একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। একসময়ে তিনি তাঁর সুন্দীর স্ত্রীকে করাত দিয়ে কেটে দুই টুকরা করে ফেললেন। ভয়াবহ ব্যাপার । মহিলা দর্শকরা ভয়ে উুঁ উুঁ জাতীয় শব্দ করছে তাকিয়ে দেখি মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে । ক্ষীণ নাকতাকার শব্দও আসছে । আমি চিমটি কেটে তার ঘুম ভাঙলাম।
সে বলল,কী হয়েছে? আমি বললাম , করাত দিয়ে মানুষ কাটা হচ্ছে।
মজিদ হাই তুলে বলল, ও আচ্ছা।
সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। অথচ আমি অনেক ঝামেলা করে দুইটা টিকিট জোগাড় করেছি যাতে একবার অনন্ত সে বিস্মিত হয় । আমার ধারণা তাজমহলের সামনেও যদি তাকে নিয়ে যাওয়া সে হাই চাপতে চাপতে বলবে ও এইটাই তাজমহল। ভালোই তো। মন্দ কী ।
মজিদকে আমার একবার তাজমহল দোখানোর ইচ্ছা । শুধু দেখার জন্য-সত্যি সত্যি সে কী করে । বা আসলেই সে কিছু করে কি-না।
দশদিন পর মজিদের সঙ্গে আমার দেখা-সে একবার মাত্র মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর পত্রিকা পড়তে লাগল। বছরখানেক আগের বাসি একটা ম্যাগাজিন।একবার জিজ্ঞেস ও করল না, আমার খবর কী । আমি কেমন। এতদিন কোথায় ছিলাম।
আমি বললাম , তোর খবর কিরে মজিদ ?
মজিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দেয় না ।
তোর আজ টিউশনি নেই? ঘরে বসে আছিস যে?
আজ শুক্রবার ।
তখন মনে পড়ল ছুটির দিনে যখন তার হাতে কোনো কাজ থাকে না তখনই সে ম্যাগাজিন জোগাড় করে। ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঘুমায়, আবার জেগে উঠে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায় ,কিছুক্ষণ পর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জীবনের কাছে তার যেন কিছুই চাওয়ার বা পাওয়ার নেই । চার-পাঁচটা টিউশনি, মাঝেমধ্যে কিছু খুচরা কাজ এবং গ্রুফ দেখার কাজেই সে খুশি। বিএ পাস করার পর কিছুদিন সে চাকরির চেষ্টা করেছিল । তারপর-‘দুর আমার হবে না।’ এই বলে সব ছেড়েছুড়ে দিল।
আমি একবার বলেছিলাম ,সারাজীবন এই করে কাটাবি নাকি? সে বলল, অসুবিধা কী? তুই তো কিছু না-করেই কাটাচ্ছিস।
আমার অবস্থা ভিন্ন । আমার ভেবেছিলাম , একবার হয়তো জিজ্ঞেস করবে কিসের এক্রপেরিমেন্ট, তাও করল না । আসলেই তার জীবনে কোনো কৌতূহল নেই।
রূপাকে অনেক বলেকয়ে একবার রাজি করেছিলাম যাতে সে মজিদকে নিয়ে চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আসে।আমার দেখার ইচ্ছা একটি অসম্ভব রূপবর্তী এবং বুদ্ধিমর্তী মেয়েকে পাশে পেয়ে তার মনের ভাব কী হয় । আগের মতোই সে কী নির্লিপ্ত থাকে,না জীবন সম্পর্কে খানিকটা হলেও আগ্রহী হয়। আমার প্রস্তাবে রূপা প্রথমে খুব রাগ করল। চোখ তীক্ষ্ণ করে বলল, তুমি নিজে কখনো আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছ? চিনি না জানি না একটা ছেলেকে নিয়ে আমি যাব।তুমি আমাকে পেয়েছ কী?
সে যতই রাগ করে, আমি ততই হাসি। রূপাকে ঠান্ডা করার এই একটা পথ। সে যত রাগ করবে আমি তত হাসব।আমার হাসি দেখে সে আরো রাগবে। আমি আরো হাসব।সে হাল ছেড়ে দেবে। এবারো তাই হলো।সে মজিদকে নিয়ে যেতে রাজি হলো । আমি একটা ছুটির দিনে মজিদকে বললাম,তুই চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আয়। পত্রিকায় দেখলাম জিরাফ এনেছে।
মজিদ বলল, জিরাফ দেখে কী হবে?
কিছুই হবে না । তবু দেখে আয় ।
ইচ্ছে করছে না।
আমার এক দূর-সম্পর্কের ফুপাতো বোন-বেচারির চিড়িয়াখানা দেখার শখ। সঙ্গে কোনো পুরুষমানুষ না থাকায় যেতে পারছে না । আমার আবার জন্তু জানোয়ার ভালো লাগে না । তুই তাকে নিয়ে যা।
মজিদ বলল, আচ্ছা।
আমার ধারণা ছিল রূপাকে দেখেই মজিদ একটা ধাক্কা খাবে। সে রকম কিছুই হলো না । রুপা গাড়ি নিয়ে এসেছিল, মজিদ গম্ভীরমুখে ড্রাইভারের পাশে বসল।
রূপা হাসি মুখে বলল, আপনি সামনে বসছেন কেন? পেছনে আসুন। দু জন গল্প করতে করতে যাই ।মজিদ বলল, আচ্ছা।
পেছনে এসে বসল।তার মুখ ভাবলেশহীন। একবার ভালো করে দেখলও না তার পাশে যে বসে আছে সে মানবী না অপ্সরী।
ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করলাম,কেমন দেখলি?
ভালোই।
কথা হয়েছে রূপার সঙ্গে?
হুঁ ।
কী কথা হলো?
মনে নেই।
আচ্ছা রূপার পরনে কী রঙের শাড়ি ছিল বল তো?
লক্ষ্য করি নি তো ।
আমি মজিদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাই। রাতে তার সঙ্গে এক চৌকিতে ঘুমাই। তার কাছ থেকে শিখতে চেষ্টা করি কী আশেপাশের জগৎ সম্পর্কে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হওয়া যায়। সাধু-সন্ন্যাসীরা অনেক সাধনায় যে স্তরে পৌছেন মজিদ সে স্তরটি কী এত সহজে অতিক্রম করল তা আমার জানতে ইচ্ছা করে।
আমার বাবা তাঁর খাতায় আমার জন্য যেসব উপদেশ লিখে রেখে গেছেন তার মধ্যে একটার শিরোনাম হচ্ছে : নির্লিপ্ততা। তিনি লিখেছেন-