রিনকির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। এই মেয়ে নাইন-টেনে পড়ার সময় রোগাভোদা ছিল–এখন দিনদিন মোটা হচ্ছে। আজ অবশ্যি সে রকম মোটা লাগছে না। ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে এর চেয়ে কম মোটা হলে তাকে মানাত না।
কি রে, ক্লাস ওয়ান একটা বর জোগাড় করে ফেললি? কনগ্রাচুলেশনস।
রিনকি অসম্ভব খুশি হলো। অবশ্যি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বলল, ক্লাস ওয়ান বর না ছাই। ক্লাস থ্রি হবে বড় জোর।
মেয়েদের আমি কখনও খুশি হলে সেই খুশি প্রকাশ করতে দেখি নি। একবার একটা মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে ইণ্টারমিডিয়েটে ছেলে-মেয়ে সবার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। আমি বললাম, কি খুশি তো? সে ঠোঁট উল্টে বলল, উহুঁ বাংলা সেকেণ্ড পেপারে যা পুওর নাম্বার পেয়েছি। জানেন, মার্কশিট দেখে কেঁদেছি। রিনকিরও দেখি সেই অবস্থা। খুশিতে মুখ ঝলমল করছে অথচ মুখে বলছে–ক্লাস থ্রি।
হিমু ভাই, ও কিন্তু দারুন শর্ট। মনে হয় কলিংবেল হাত দিয়ে নাগাল পাবে না।
আমি অত্যন্ত খুশি হবার ভঙ্গি করলাম। খুশি গলায় বললাম, তাহলে তো তুই লাকি। ভাগ্যবতী মেয়েদের বর খাটো হয়–খনার বচনে আছে।
যাও।
সত্যি–খনা বলেছেন : খাটো পেয়ারা ভালো। খাটো স্বামীর মন…তারপর আরো কী কী যেন আছে মনে নেই।
বানিয়ে বানিয়ে কী যে মিথ্যা তুমি বল। এই ছড়াটা তুমি এক্ষুণি বানালে তাই না?
হুঁ।
কেন বানালে বল তো?
তোকে খুশি করবার জন্য।
খুশি করয়াব্র দরকার নেই, আমি এমনিতেই খুশি।
সেটা তোর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। বর পছন্দ হয়েছে?
হুঁ। তবে খুব বিরক্ত করছে।
বিরক্ত করছে মানে?
আজই মাত্র কথাবার্তা ফাইনাল হলো এর মধ্যে তিনবার টেলিফোন করেছে। তারপর বলেছে রাত এগারটার সময়ে আবার করবে। লজ্জা লাগে না? তার উপর টেলিফোন বাবার ঘরে। বাবা সন্ধে থেকে তাঁর ঘরে বসা আছে। আমি কি বাবার সামনে তার সঙ্গে কথা বলব?
লম্বা তার আছে, তুই টেলিফোন তোর ঘরে নিয়া আয়।
আমি কী করে আনব? আমার লজ্জা লাগে না?
আচ্ছা যা, আমি এনে দিচ্ছি।
পরে কিন্তু তুমি এই নিয়ে ঠাট্টা করতে পারবে না। আমি তোমাকে আনতে বলিনি। তুমি নিজ থেকে আনতে চেয়েছ।
তাতো বটেই। ঐ ভদ্রলোক টেলিফোনে কী বলে?
কী আর বলবে, কিছু বলে না।
আহা বল না শুনি।
উফ তুমি বড় যন্ত্রণা কর–আমি কিছু বলতে টলতে পারব না।
রিনকি লজ্জায় লাল-নীল হতে লাগল। মনে হচ্ছে সে এখন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটাচ্ছে। বড় ভালো লাগছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। রিনকির সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা ছিল। থাকা গেল না। ফুপা ডেকে পাঠালেন।
ফুপার ঘর অন্ধকার।
জিরো পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। লক্ষণ সুবিধার না, ফুপার মাঝেমধ্যে মদ্যপানের অভ্যাস আছে। এই কাজটা বেশিরভাগ সময় বাইরেই সারেন। বাসায় ফুপুর জন্যে তেমন সুযোগ পান না। ফুপুর শাসন বেশ কঠিন। হঠাৎ হঠাৎ কোনো বিশেষ উপলক্ষে বাসায় মদ্যপানের অনুমতি পান। আজ পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
মদ্যপান করছে এ রকম মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হয়। কারণ তাদের মুড মদের পরিমাণ এবং কতক্ষণ ধরে মদ্যপান করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে। ফুপার তরল অবস্থায় তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা বিশেষ হয় নি, কাজেই তরল অবস্থায় তাঁর মেজাজ-মর্জি কেমন থাকে তাও জানি না।
ফুপা আসব?
হিমু? এসো। দরজা ভিড়িয়ে দাও। তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। বস সামনের চেয়ারটায় বস।
আমি বসলাম।
তিনি গ্লাস দেখিয়ে বললেন, আশা করি এইসব ব্যাপারে তোমার কোনো প্রিজুডিস নেই।
জি না।
তারপর বল কেমন আছ। ভালো?
জি।
রিনকির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল শুনেছ বোধহয়?
জি।
ছেলে ভালো তবে খুবই খাটো। আমাদের সঙ্গে এই রকম একটা ছেলে পড়ত–তার নাম ছিল স্ক্রু। এই ছেলেরও নিশ্চয়ই এই ধরনের কোনো নামটাম আছে। বেঁটে ছেলের নাম সাধারণত স্ক্রু হয় কিংবা বল্টু হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। ফুপাকে নেশায় ধরেছে বলে মনে হচ্ছে। না ধরলে নিজের জামাই সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলতে পারতেন না।
আপনার ছেলে পছন্দ হয় নি?
আরে পছন্দ হবে কী? মার্বেলের সাইজের এক ছেলে।
পছন্দ হয় নি তো বিয়েতে মদ দিলেন কেন?
আমার মতামতের প্রশ্নই তো ওঠে না। আমি হচ্ছি এই সংসারের টাকা বানানোর মেশিন। এর বেশি কিছু না। আমি কী বলছি না বলছি তা তো কেউ জানতে চায় না। তারপরেও বলতাম। কিন্তু দেখি মেয়ে আর মেয়ের মা দুই জনই খুশিতে বাকবাকুম।
তাঁর গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো খানিকটা ঢাললেন। আমি তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, এটা পঞ্চম পেগ। আমার লিমিট হচ্ছে সাত। সাতের পর লজিক এলোমেলো হয়ে যায়। সাতের আগে কিছুই হয় না।
আমি বললাম, ফুপা এক মিনিট। আমি টেলিফোনটা রিনকির ঘরে দিয়ে আসি। ও কোথায় যেন টেলিফোন করবে।
ফুপা মুখ বিকৃত করে বললেন, কোথায় করবে বুঝতে পারছ না? ঐ মার্বেলের কাছে করবে। টেলিফোন করে করে অস্থির করে তুলল।
আমি রিনকিকে টেলিফোন দিয়ে এসে বললাম, আপনি কী জানি জরুরি কথা বলবেন।
ও হ্যাঁ জরুরি কথা, বাদল সম্পর্কে।
জি বলুন।
ও তোমাকে কেমন অনুকরণ করে সেটা লক্ষ্য করেছ? তুমি তোমার মুখে দাড়িগোঁফের চাষ করছ–কর। সেও তোমার পথ ধরেছে। আজ তুমি হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে এসেছ, আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি, কাল দুপুরের মধ্যে সে হলুদ পাঞ্জাবি কিনবে। আমি কি ভুল বললাম?
না, ভুল বলেন নি।
তুমি যদি মাথা কামাও , আমি সিওর ব্যাটা কাল মাথা কামিয়ে ফেলবে। এরকম প্রভাব তুমি কী করে ফেললে আমাকে বল। You better explain it.
আমার জানা নেই ফুপা।
ভুলটা আমার। মেট্রিক পাস করে তুমি যখন এলে আমি ভালোমনে বললাম, আচ্ছা থাকুক। মা-বাপ নেই–ছেলে একটা আশ্রয় পাক। তুমি-যে এই সর্বনাশ করবে তাতো বুঝি নি ! বুঝতে পারলে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম।
আমি জেনেশুনে কিছু করি নি।
তাও ঠিক । জেনেশুনে তুমি কিছু করনি। আই ডু এগ্রি। তোমার লাইফস্টাইল তাকে আকর্ষণ করেছে। তুমি ভ্যাগাবন্ড না অথচ তুমি ভাব কর যে তুমি ভ্যাগান্ড। জোছনা দেখানোর জন্যে চন্দ্রায় এক জঙ্গলের মধ্যে বাদলকে নিয়ে গেলে। সারারাত ফেরার নাম নেই। জোছনা কি এমন জিনিস যে জঙ্গলে বসে দেখতে হবে? বল তুমি। তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
শহরের আলোয় জোছনা ঠিক বোঝা যায় না।
মানলাম তোমার কথা। ভালো কথা, চন্দ্রায় গিয়ে জোছনা দেখ। তাই বলে সারারাত বসে থাকতে হবে?
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জোছনা কীভবে বদলে যায় সেটাও একটা দেখার মত ব্যাপার। শেষরাতে পরিবেশ ভৌতিক হয়ে যায়।
তাই নাকি?
জি। তাছাড়া জঙ্গলের একটা আলাদা এফেক্ট আছে। শেষ রাতের দিকে গাছগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে।
তোমার কথা বুঝলাম না। গাছগুলো জীবন্ত হয় মানে? গাছ তো সব সময়ই জীবন্ত।
জি-না। ওরা জীবন্ত, তবে সুপ্ত। খানিকটা জেগে ওঠে পূর্ণিমারাতে। তাও মধ্যরাতের পর থেকে। জঙ্গলে না গেলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। আপনি একবার চলুন-না নিজের চোখে দেখবেন। দিন-তিনেক পরেই পূর্ণিমা।
দিন-তিনেক পরেই পূর্ণিমা?
জি।
এইসব হিসাব নিকাশ সবসময় তোমার কাছে থাকে?
জি।
একবার গেলে হয়।
বলেই ফুপা গম্ভীর হয়ে গেলেন। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি আমাকে পর্যন্ত কনভিন্সড করে ফেলেছিলে। মনে হচ্ছিল তোমার সঙ্গে যাওয়া যেতে পারে। অবশ্যি এটা সম্ভব হয়েছে নেশার ঘোরে থাকার জন্যে।
তা ঠিক। কিছু মানুষ ধরেই নিয়েছে তারা যা ভাবছে তাই ঠিক। তাদের জগৎটাই একমাত্র সত্যি জগৎ। এরা রহস্য খুজবে না। এরা স্বপ্ন দেখবে না।
চুপ কর তো।
আমি চুপ করলাম।
ফুপা রাগী-গলায় বললেন, তুমি ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরবে আর ভাববে বিরাট কাজ করে ফেলছ। তুমি যে অসুস্থ্ এটা তুমি জানো? ডাক্তার হিসেবে বলছি–তুমি অসুস্থ্। You are a sick man.
ফুপা আপনি নিজেও কিন্তু অসুস্থ্ হয়ে পড়ছেন। বেশি খাচ্ছেন। আপনি বলছেন আপনার লিমিট সাত। আমার ধারণা এখন নয় চলছে।
তোমার কাছে সিগারেট আছে?
আছে।
দাও।
তিনি সিগারেট ধরালেন। খুকখুক করে কাশলেন। ফুপাকে আমি কখনও সিগারেট খেতে দেখি নি। তবে মদ্যপানের সঙ্গে সিগারেটের ঘনিষ্ট সর্ম্পক আছে এ রকম শুনেছি।
হিমু।
জি।
রাস্তায় রাস্তায় ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে তুমি যদি আনন্দ পাও-তুমি অবশ্যি তা করতে পারো। It is your life. কিন্তু আমার ছেলেও তা করবে তাতো হয় না।
ও কি তা করছে নাকি?
এখনও শুরু করেনি। তবে করবে। দুই বছর তুমি ওর সঙ্গে ছিলে। একই ঘরে ঘুমিয়েছ। এই দুই বছরে তুমি ওর মাথাটা খেয়েছ। তুমি আর এ বাড়িতে আসবে না।
জি আচ্ছা । আসব না।
ঠিক আছে।
এই বাড়ির ত্রিসীমানায় যদি তোমাকে দেখি তাহলে পিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল তুলে ফেলব।
আপনার নেশা হয়ে গেছে ফুপা। পিটিয়ে ছাল তোলা যায় না। আপনার লজিক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
ফুপার সিগারেট নিভে গেছে। সিগারেটে অনভ্যস্ত লোকজন সিগারেটে আগুন বেশিক্ষণ ধরিয়ে রাখতে পারে না। আমি আবার তার সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। ফুপা বললেন, তোমাকে আমি একটা প্রপোজাল দিতে চাই । একসেপ্ট করবে কি করবে না ভেবে দেখ।
কী প্রপোজাল?
তোমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে চাই। As a matter of fact. আমার হাতে একটা চাকরি আছে। আহামরি কিছু না। তবে তোমার চলে যাবে।
বেতন কত?
ঠিক জানি না। তিন হাজারের কম হবে না। বেশিও হতে পারে।
তেমন সুবিধার চাকরি বলে তো আমার মনে হচ্ছে না।
ভিক্ষা করে জীবন যাপন করার চেয়ে কি ভালো না?
না । ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে। প্রাচীন ভারতের সাধু-সন্ন্যাসীদের সবাই ভিক্ষা করতেন। বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার একটা বড় অঙ্গ হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। এরা অবশ্যি ভিক্ষা বলে না। এরা বলে মাধুকরী।
আমার কাছে লেকচার ঝাড়বে না।
ফুপা আমি কি তাহলে উঠব?
যাও ওঠ। শুধু একটা জিনিস বল–যে ধরণের জীবন তুমি যাপন করছ তাতে আনন্দটা কী?
যা ইচ্ছা করতে পারার একটা আনন্দ আছে না?
যা ইচ্ছা তুমি কি তাই করতে পারবে?
অবশ্যই পারব। বলুন কী করতে হবে?
খুন করতে পারবে?
কেন পারব না। খুন করা আসলে খুব সহজ ব্যাপার।
সহজ ব্যাপার?
অবশ্যিই সহজ ব্যাপার। যে কেউ করতে পারে। রোজ কতগুলো খুন হচ্ছে দেখছেন তো! খবরের কাগজ খুললেই দেখবেন। আমার তো রোজই একটা-দুটা মানুষকে খুন করতে ইচ্ছা করে।
হিমু। Your are a sick man. You are a sick man.
আর খাবেন না ফুপা। আপনি মাতাল হয়ে গেছেন।
কী করে বুঝলে মাতাল হয়ে গেছি। কী করে বুঝলে?
মাতালরা প্রতিটা বাক্য দুইবার করে বলে। আপনিও তাই বলেছেন। আপনি বাথরুমে গিয়ে বমির চেষ্টা করুন। বমি করলে ভালো লাগবে।
বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে সরে গেলাম। বমির কথা মনে করিয়ে দিয়েছি, কাজেই ফুপা এখন হড়হড় করে বমি করবেন। হলোও তাই। তিনি চারদিক ভাসিয়ে দিলেন। ওয়াক ওয়াক শব্দে ফুপু ছুটে এলেন। তিনি তার সাজানো ঘর দেখে স্তম্ভিত। ফুপাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে তার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে। হঠাৎ হয়তো দেখব বমির সঙ্গে তাঁর পাকস্থলী বের হয়ে আসছে । সেই দৃর্শ্য খুব সুখকর হবে না। আমি বারান্দায় চলে এলাম। রিনকি ছুটে এসেছে, বাদলও এসেছে।
ফুপা চিঁচিঁ করে বলছেন–সুরমা আমি মরে যাচ্ছি। ও সুরমা আমি মরে যাচ্ছি।
বমি করতে করতে কোনো মাতাল মারা যায় বলে আমার জানা নেই। কাজেই আমি রাস্তায় নেমে এলাম । সিগারেট কেনা দরকার। আকাশে মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি হবে কিনা কে জানে। হলে ভালোই হয়। এই বৎসর এখনো বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি। নবধারা জলে স্মান বাকি আছে।
সিগারেটের সঙ্গে জরদা দেয়া দুটো পান কিনলাম। জরদার নাম সবই পুংলিঙ্গে–দাদা জরদা, বাবা জরদা। মা জরদা, খালা জরদা এখনো বাজারে আসে নি যদিও মহিলারাই বেশি জরদা খান। কোন একটা জরদা কোম্পানিকে এই আইডিয়াটা দিয়ে দেখলে হয়।
প্রথমবার ঢোকার সময় ফুপুকে যত গম্ভীর দেখলাম দ্বিতীয়বারের চেয়েও বেশি গম্ভীর মনে হলো। ফুপু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। কাজের মেয়ে বালতি আর ঝাঁটা হাতে যাচ্ছে। কাজের ছেলেটির হাতে ফিনাইল। ফুপুর কিছুটা শুচিবায়ুর মতো আছে। আজ সারারাতই বোধহয় ধোয়াধুয়ি চলবে।
ফুপু বললেন, তুই তাহলে আছিস। আমি ভাবলাম চলে গিয়েছিস।
পান কিনতে গিয়েছিলাম। ফুপার অবস্থা কী?
অবস্থা কী জিজ্ঞেস করছিস লজ্জা করে না? তোর সামনে গিলল, তুই একবার না করতে পারলি না? চাকর বাকর আছে। কী লজ্জার কথা। তুই কী আজ এখানে থাকবি?
হ্যাঁ।
এখানে থাকার তোর দরকারটা কী?
এতরাতে যাব কোথায়?
ফুপু শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। টেলিফোনে ক্রমাগত রিং হচ্ছে। এগিয়ে গেলাম টেলিফোনের দিকে। রিনকির ঘর পর্যন্ত টেলিফোন নেয়া যায় নি। তার এত লম্বা নয়। টেলিফোন বারান্দায় রাখা। আমি রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলা পাওয়া গেল, এটা কী রিনকিদের বাসা?
হ্যাঁ।
দয়া করে ওকে একটু ডেকে দেবেন?
আপনি কে জানতে পারি? এ বাড়ির নিয়ম কানুন খুব কড়া, অপরিচিত লোক যদি রিনকিকে ডাকে তাহলে রিনকিকে দেয়া যাবে না।
আমি এন্তাজ।
আপনি কি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার?
জি।
আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম…..
আপনি কে তা আমি বুঝতে পেরেছি–আপনি হচ্ছেন হিমু ভাই।
আমি সত্যি চমৎকৃত হলাম। এর মধ্যে রিনকি আমার গল্প করে ফেলেছে? এমনভাবে করেছে যে ভদ্রলোক কয়েকটা বাক্যতেই আমাকে চিনে ফেললেন। ভদ্রলোকের বুদ্ধি তো ভালোই। এমন বুদ্ধিমান এক জন মানুষ রিনকির মতো গাধা টাইপের একটি মেয়ের সঙ্গে জীবন কী করে টেনে নেবে কে জানে।
হ্যালো। হ্যালো লাইন কি কেটে গেল?
না কাটে নি।
আপনি কি হিমু ভাই?
হ্যাঁ।
রিনকি বলছে আপনার নাকি অলৌকিক সব ক্ষমতা আছে।
কী রকম ক্ষমতা?
প্রফেটিক ক্ষমতা। আপনি নাকি ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন। আপনি যা বলেন তাই নাকি হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। এই জাতীয় প্রসঙ্গ এলে চুপ করে থাকাই নিরাপদ। হ্যাঁ-না কিছু বললেই তর্কের মুখোমুখি হতে হয়। তর্ক করতে আমার ভালো লাগে না।
হ্যাঁলো হ্যাঁলো । লাইনটা ডিসটার্ব করছে।
হ্যাঁলো হিমু ভাই।
বলুন।
আপনি কি দয়া করে একটু রিনকিকে…
ওকে তো দেয়া যাবে না। ও আশেপাশে নেই। বাবার সেবা করছে। উনি অসুস্থ্।
অসুস্থ্? কী বলছেন? সিরিয়াস কিছু?
সিরিয়াস বলা যেতে পারে।
বলেন কী! আমি কী আসব?
আমি কয়েক মূহুর্ত দ্রুত চিন্তা করে বললাম, আসতে অসুবিধা হবে নাতো?
না-না অসুবিধা কী! আমার গাড়ি আছে।
আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝড়বৃষ্টি হতে পারে।
হোক। বিপদের সময় উপস্থিত না থাকলে কী করে হয়?
তাতো বটেই। আপনি এক্ষুণি রওনা না হয়ে ঘন্টা খানেক পর আসুন।
কেন বলুন তো?
এমনি বললাম।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনার কথা অগ্রাহ্য করব না যেসব কথা আমি শুনেছি–মাই গড। আপনি দয়া করে আমার সম্পর্কেও কিছু বলবেন। মাই আর্নেস্ট রিকোয়েস্ট।
আচ্ছা বলব।
হিমু ভাই তাহলে রাখি? আর ইয়ে আমি যে আসছি এটা রিনকিকে বলবেন না। একটা সারপ্রাইজ হবে।