স্যার যেদিন মারা যান সেই রাত্রিতেই আমি প্রথম ময়ূরাক্ষী নদীটা স্বপ্নে দেখি। ছোট্ট একটা নদী। তার পানি কাঁচের মত স্বচ্ছ। নিচের বালিগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর দুইধারে দূর্বাঘাসগুলো কী সবুজ! কী কোমল! নদীর ঐ পাড়ে বিশাল ছায়াময় একটা পাকুড় গাছ। সেই গাছে বিষণ্ণ গলায় একটা ঘুঘু ডাকছে। সেই ডাকে একধরনের কান্না মিশে আছে।
নদীর ধার ঘেঁষে পানি ছিটাতে ডোরাকাটা সবুজ শাড়ি-পরা একটি মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমি শুধু একঝলক তার মুখটা দেখতে পেলাম। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে খুব চেনা, খুব আপন মনে হলো। যেন কত দীর্ঘ শতাব্দী এই মেয়েটির সঙ্গে কাটিয়েছি।
ময়ূরাক্ষী নদীকে একবারই আমি স্বপ্নে দেখে। নদীটা আমার মনের ভেতর পুরোপুরি গাঁথা হয়ে যায়। এরপর অবাক হয়ে লক্ষ্য করি কোথাও বসে একটু চেষ্টা করলেই নদীটা আমি দেখতে পাই। তারজন্যে আমাকে কোন কষ্ট করতে হয় না। চোখ বন্ধ করতে হয় না, কিছু না। একবার নদীটা বের করে আনতে পারলে সময় কাটানো কোনো সমস্যা নয়। ঘন্টার পর ঘন্টা আমি নদীর তীরে হাঁটি। নদীর হিম শীতল জলে পা ডুবিয়ে বসি। শরীর জুড়িয়ে যায়। ঘুঘুর ডাকে চোখ ভিজে ওঠে।
ঘুমাচ্ছেন নাকি?
আমি চোখ মেললাম। চারদিকে অন্ধকার। আরে সর্বনাশ, এতক্ষণ পার করেছি! ওসি সাহেব বললেন, যান চলে যান। জাস্টিস সাবের বাসা থেকে টেলিফোন করেছিল। ওরা কোনো চার্জ আনবে না। You are free to go.
জাস্টিস সাহেব নিজেই টেলিফোন করেছিলেন?
না, তাঁর মেয়ে।
মেয়েটা কী বলল, দয়া করে বলবেন?
বলল ধমকধামক দিয়ে ছেড়ে দিতে।
তাহলে দয়া করে ধমকধামক দিন। তারপর যাই।
ওসি সাহেব হেসে ফেললেন। পুলিশের যে একেবারেই রসবোধ নেই সেটা ঠিক না। আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, মেয়েটি কি তার নাম আপনাকে বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে, মীরা কিংবা মীরু এই জাতীয় কিছু।
আপনি কি নিশ্চিত যে সে জাস্টিস এম. সোবাহান সাহেবের মেয়ে? অন্য কেউই তো হতে পারে। আপনি একটা উঁড়ো টেলিফোন কল পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন তারপর জাস্টিস সাহেব ধরবেন আপনাকে, আইনের প্যাঁচে ফেলে অবস্থা কাহিল করে দেবেন।
ভাই আপনি যান তো। আর শুনেন একটা উপদেশ দেই। পুলিশের সঙ্গে এত মিথ্যাকথা বলবেন না। মিথ্যা বলবেন ভালোমানুষদের কাছে। যা বলবেন তারা তাই বিশ্বাস করবে। পুলিশ কোনকিছুই বিশ্বাস করে না। খোঁজখবর করে।
আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করেছেন?
হ্যাঁ। সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে খোঁজ নিয়েছি। জেনেছি টুটুল চৌধুরী নামের কোনো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক নেই।
আপনি কি আমার মুচলেকা ফুচলেকা এইসব কিছু নেবেন না?
না। এখন দয়া করে বিদেয় হোন।
আপনার গাড়ি করে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। আমি কি আশা করতে পারি না আবার গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে আসবেন।
কোথায় যাবেন?
ফার্মগেট।
চলুন নামিয়ে দেব।
আমি হাসিমুখে বললাম, আপনার এই ভদ্রতার কারণে কোনো একদিন হয়তো আমি আপনাকে ময়ূরাক্ষীর তীরে নিমন্ত্রণ করব।
ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি কী বললেন বুঝতে পারলাম না।
ঐটা বাদ দিন। সবকিছু বুঝে ফেললে তো মুশকিল। ভালো কথা, আপনি ডেইলি ক-প্যাকেট সিগারেট খান তা কি জানতে পারি?
ওসি সাহেব বললেন, আপনি লোকটা তো ভালো ত্যাঁদড় আছেন। দুই থেকে আড়াই প্যাকেট লাগে।
ময়ূরাক্ষী ২/৮
বড়ফুপুর বাসায় দুপুরে যাবার কথা।
উপস্থিত হলাম রাত আটটায়। কেউ অবাক হলো না। ফুপুর বড়ছেলে বাদল আমাকে দেখে উল্লসিত গলায় বলল, হিমুদা এসেছ? থ্যাংকস। অনেক কথা আছে, আজ থাকবে কিন্তু। আই নিড ইওর হেল্প।
বাদল এবার ইণ্টারমিডিয়েট দেবে। এর আগেও তিনবার দিয়েছে। সে পড়াশোনায় খুবই ভালো। এসএসসি’তে বেশ কয়েকটা লেটার এবং স্টার মার্ক পেয়েছে। সমস্যা হয়েছে ইণ্টারমিডিয়েটে। পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত দিতে পারে না। মাঝামাঝি জায়গায় তার এক ধরনের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যায়। তার কাছে মনে হয় পরীক্ষার হল হঠাৎ ছোট হতে শুরু করে। ঘরটা ছোট হয়। পরীক্ষার্থীরাও ছোট হয়। চেয়ার টেবিল সব ছোট হতে থাকে। তখন সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে আসা মাত্রই দেখে সব স্বাভাবিক। তখন সে আর পরীক্ষার হলে ঢোকে না। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে আসে।
দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবার সময় অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। ওষুধপত্র খাওয়ানো হলো। সেবারও একই অবস্থা। এখন আবার পরীক্ষা দেবে। এবারে ডাক্তারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পীর ফকির। বাদলের গলায়, হাতে, কোমরে নানা মাপের তাবিজ ঝুলছে। এর মধ্যে একটা তাবিজ নাকি জ্বিনকে দিয়ে কোহকাফ নগর থেকে আনানো। কোহকাফ নগরে নাকি জ্বিন এবং পরীরা থাকে। আমার বড়ফুপা ঘোর নাস্তিক ধরনের মানুষ এবং বেশ ভালো ডাক্তার–তিনিও কিছু বলছেন না।
বাদলের দেখি আমার মত অবস্থা। দাড়িগোঁফ গজিয়ে হুলুস্থুল। লম্বা লম্বা চুল। সে খুশিখুশি গলায় বলল, হিমুদা পড়াশোনা করছি। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমার ঘরে চলে আসবে।
পড়াশোনা হচ্ছে কেমন?
হেভি হচ্ছে। একই জিনিস তিন-চার বছর ধরে পড়ছি তো, একেবারে ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। হিমু ভাই, তুমি এমন ডার্ক হলুদ কোথায় পেলে?
গাউছিয়ায়।
ফাইন দেখাচ্ছে। সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী লাগছে–সন্ন্যাসী উপগুপ্ত, মথুরাপুরীর প্রাচীরের নিচে একদা ছিলেন সুপ্ত।
যা পড়াশোনা কর। আমি আসছি।
কী আর পড়াশোনা করব। সব তো ভাজা ভাজা।
তবু আরেকবার ভেজে ফেল। কড়া ভাজা হবে।
বাদল শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসি হেঁচকির মতো চলতেই থাকল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই ছেলের অবস্থা দেখি দিনদিন খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ ধরে কেউ হাসে?
ফুপু গম্ভীরমুখে খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে দুপুরে প্রচুর আয়োজন ছিল। সেইসব গরম করে দেয়া হচ্ছে। পোলাওয়ের টক টক গন্ধ। নষ্ট হয়ে গেছে কিনা কে জানে? আমার পেটে অবশ্যি সবই হজম হয়ে যায়। পোলাওটা মনে হচ্ছে হবে না। কষ্ট দেবে।
ফুপু বললেন, রোস্ট আরেক পিস দেব?
দাও।
এত খাবারদাবারের আয়োজন কীজন্যে একবার জিজ্ঞেস করলি না?
আমি খাওয়া বন্ধ করে বললাম, কীজন্যে?
আত্মীয়স্বজন যখন কোনো উপলক্ষে খেতে ডাকে তখন জিজ্ঞেস করতে হয় উপলক্ষটা কী। যখন আসতে বলে তখন আসতে হয়।
একটা ঝামেলায় আটকে পড়েছিলাম। উপলক্ষটা কী?
রিনকির বিয়ের কথা পাকা হলো।
বাহ্ ভালো তো।
ফুপু গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি খেয়েই যাচ্ছি। টকগন্ধ পোলাও এত খাওয়া ঠিক হচ্ছে না সেটাও বুঝতে পারছি তবু নিজেকে সামলাতে পারছি না। যা হবার হবে। ফুপু শীতল গলায় বললেন, একবার তো জিজ্ঞেস করলি না কার সঙ্গে বিয়ে। কী সমাচার।
তোমরা নিশ্চয় দেখেশুনে ভাল বিয়েই দিচ্ছ।
তুই একবার জিজ্ঞেস করবি না, তোর কোনো কৌতূহলও নেই?
আরে কী বল কৌতুহল নেই। আসলে এত ক্ষুধার্ত যে কোনোদিকে মন দিতে পারছি না। দুপুরের খাওয়া হয় নি। ছেলে করে কী?
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
বল কী! তাহলে তো মালদার পার্টি।
ফুপু রাগী-গলায় বললেন, ছোটলোকের মত কথা বলবি নাতো, মালদার পার্টি আবার কী?
পয়সাওয়ালা পার্টি এই বলছি।
হ্যাঁ, টাকা-পয়সা ভালোই আছে।
শর্ট না তো? আমার কেন জানি মনে হত–একটা শর্ট টাইপের ছেলের সাথে রিনকির বিয়ে হবে। ছেলের হাইট কত?
ফুপুর মুখটা কালো হয়ে গেল। তিনি নিচুগলায় বললেন, হাইট একটু কম। উঁচু জুতা পরলে বোঝা যায় না।
বোঝা না-গেলে তো কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া বেঁটে লোক খুব ইণ্টেলিজেণ্ট হয়। যত লম্বা হয় বুদ্ধি তত কমতে থাকে। আমি এখন পর্যন্ত কোনো বুদ্ধিমান লম্বা মানুষ দেখি নি। সত্যি বলছি।
ফুপুর মুখ আরো অন্ধকার হয়ে গেল।
তখন মনে পড়ল–কী সর্বনাশ! ফুপা নিজেই বিরাট লম্বা, প্রায় ছ ফুট। আজ দেখি একের পর এক ঝামেলা বাঁধিয়ে যাচ্ছি।
তুই যাবার আগে তোর ফুপার সঙ্গে কথা বলে যাবি। তোর সঙ্গে নাকি কী জরুরী কথা আছে।
নো প্রবলেম।
আর রিনকির সঙ্গে কথা বলার সময় জামাই লম্বা কি বেঁটে এ জাতীয় কোনো কথাই বলবি না।
বেঁটে লোকেরা যে জ্ঞানী হয় এই কথাটা ঠিক কায়দা করে বলব?
তোর কিছুই বলার দরকার নেই।
ঠিক আছে। ঠাণ্ডা পেপসি টেপসি থাকলে দাও। তোমরা তো কেউ পান খাও না। কাউকে দিয়ে তিনটা পান আনাও তো।