আমি এবং মিতু সিঁড়ি দিয়ে নামছি। মিতু আমার পাশে পাশে নামছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বা নামার সময় মেয়েরা কখনো পাশাপাশি হাঁটে না। তারা হয় আগে আগে যায়, নয়তো যায় পেছনে পেছনে।
হিমু সাহেব!
জি ম্যাডাম।
মিতু থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ম্যাডাম বলছেন কেন?
ম্যানেজার সাহেব আপনাকে ম্যাডাম বলতে বলেছেন। তাছাড়া ম্যাডাম বলাটাই তো শোভা। আপনাকে মিতু ডাকলে আপনার নিশ্চয়ই
ভালো লাগবে না।
মিতু বলল, আমার চুলগুলো মনে হয় আপনার খুব পছন্দ হয়েছে। বারবার চুলের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
আপনার চুল খুব সুন্দর।
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চান? ছুঁয়ে দেখতে চাইলে পারেন। কিছু কিছু সৌন্দর্য আছে যা অনুভব করতে হলে স্পর্শ করতে হয়।
ছুঁয়ে দেখব?
দেখুন। এতে আমার অস্বস্তিও লাগবে না কিংবা গা ঘিনঘিনও করবে না। কারণ এই চুল নকল চুল। আমি মাথায় উইগ পরেছি।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। নকল চুল হাত দিয়ে দেখার কোনো আগ্রহ বোধ করছি না। সুন্দর একটা মেয়ে, তার মাথার চুলও নিশ্চয়ই সুন্দর। সে নকল চুল পরেছে কেন?
হিমু সাহেব।
জি।
ভূমিকম্প হয়েছিল ঠিকই। আগে আগে কীভাবে বললেন? আপনার টেকনিকটা কী?
কোনো টেকনিক নেই।
কিছু টেকনিক নিশ্চয়ই আছে।
আমি সহজ গলায় বললাম, নিম্নশেণীর প্রাণী, যেমন ধরুন , কুকুর বেড়াল এরা ভূমিকম্পের ব্যাপার আগে আগে টের পায়। আমিও বোধহয় নিম্নশেণীর প্রাণী।
মিতু কঠিন গলায় বলল, আমার নিজেরও তাই ধারণা।
আমাকে প্রায় হতভম্ব করে মিতু নেমে যাচ্ছে। এবার সে যাচ্ছে আগে, আগে, আমি পেছনে পেছনে। মেয়েদের ধর্ম সে এখন পালন করছে।
ম্যানেজার সাহেব চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এসি বসানো শেভ্রলেট। আগামী সাতদিন এই গাড়ি সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকবে। গাড়ির ড্রাইভার আমার চেনা—তার গাড়ির ভেলভেটের সিটই আমি আগুন গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেই সেট কভারই বদলানো হয়েছে। পুরো গাড়ির সিট কভার বদলানো। ঝকঝকে কমলা রঙের সিট কভারে সুন্দর লাগছে।
ড্রাইভার ভীতমুখে বলল, কোথায় যাব স্যার?
যেদিকে ইচ্ছা চালাতে থাকুন। আমি যখন বলব, স্টপ, তখন শুধু থামবেন।
যেদিকে মন চায় সেইদিকে চালাব?
হুঁ।
বিস্মিত এবং ভীত ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। আমি গাড়ির সিটে গা এলিয়ে আরামে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে এই জীবনটা গাড়িতে গাড়িতে কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না।
ড্রাইভার ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। তাকে আপনি আপনি করে বলাতেও সে বোধহয় খানিকটা ভড়কে গেছে। বারবার মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে। ব্যাকভিউ মিরর খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করল। অর্থাৎ মিরর এমনভাবে সেট করল যেন ঘাড় না ঘুরিয়েই সে আমাকে দেখতে পায়।
ড্রাইভার সাহেব!
জি স্যার।
আপনার নাম কী?
আমার নাম স্যার ছামছু।
ভালো। খুব সুন্দর নাম, সামছু হলে ভালো হতো তবে ছামছুও খারাপ না। আগের বার আপনার নাম জানা হয়নি। এবার জেনে নিলাম।
স্যার, আমারে তুমি কইরা বলবেন। আর ড্রাইভার সাব বইল্যা লজ্জা দিবেন না । আর আফনের সাথে বিয়াদবি কিছু করলে মাফ দিয়া দিবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, ছামছু। ভালোমতো চালাও। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।
যে দেকি ইচ্ছা সেদিকে চালামু স্যার?
হুঁ। খানাখন্দ এড়িয়ে চালাবে। ঘুমোচ্ছি তো, হঠাৎ ঝাঁকুনি খেলে ঘুম ভেঙে যাবে।
জি আচ্ছা স্যার।
ছামছু গাড়ি চালাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। ছামছু উদ্দেশ্যবিহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে না। আমি জানি, সে এখন যাচ্ছে তার বাসার দিকে। বাসার খুব কাছাকাছি যাবার পর সে বলবে, এখন কোথায় যাব স্যার? তার আগে বলবে না। এই পৃথিবীতে মানুষের একমাত্র গন্তব্য তার ঘর।
ছামছু মৃদু গলায় বলল, গান দিমু স্যার?
তোমার নিজের গান শুনতে ইচ্ছা হলে দিতে পারো। আমার লাগবে না।
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভেঙে দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার ছামছু তার সিটে চুপচাপ বসা । আমাকে তাকাতে দেখেই সে বলল, এখন কোন দিকে যামু স্যার?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, তোমার বাসা কি খুব কাছে?
জি স্যার। সামনের গলির দুইটা বাড়ির পরে।
তাহলে তুমি বরং এক কাজ করো—বাসা থেকে একটু ঘুরে আসো। ছেলেমেয়েদের দেখে আসো। ততক্ষণে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।
ছামছু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।
এই পৃথিবীতে সবচে’সুন্দর জিনিস কী? মানুষের বিস্মিত চোখ। আমার ধারণা, সৃষ্টিকর্তা মানুষের বিস্মিত চোখ দেখতেই সবচে’ পছন্দ করেন, যে কারণে প্রতিনিয়ত মানুষকে বিস্মিত করার চেষ্টা তিনি চালিয়ে যান। যাদের তিনি অপছন্দ করেন তাদের কাছে থেকে বিস্মিত হবার ক্ষমতা কেড়ে নেন। তারা কিছুতেই বিস্মিত হয় না।
সত্যি বাসায় যামু স্যার?
হ্যাঁ যাও।
ছামছু চলে গেছে। আমি আগের মতোই গা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব। শরীর জুড়ে আলস্য। সন্ধ্যাবেলা রূপার কাছে যাবার ইচ্ছা ছিল। অনেকদিন রূপাকে দেখা হয় নি।
বড় খালুর বাসায়ও যাওয়া দরকার।
খুঁজে বের করা দরকার পুর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্টকে, নাম হলো—মুনশি বদরুদ্দিন তালুকদার।
অনেক কাজ। কিন্তু সব কাজ ছাপিয়ে ঘুমানোর কাজটাই আমার কাছে প্রধান বলে মনে হচ্ছে। এই গাড়ির জানালার কাচ মনে হয় রঙিন। বাইরের পৃথিবীটা অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে মজার কোনো খেলা খেলছে। কী একটা সাদা বলের মতো জিনিস একজন আরেকজনের গায়ে ছুড়ে দিচ্ছে। যার গায়ে ছুড়ে দেয়া হচ্ছে সে আনন্দে চিৎকার করছে। যে ছুড়ে মারছে সেও আনন্দে চিৎকার করছে। কত আনন্দই না এই ভুবনে ছড়ানো। ভালোমতো তাকিয়ে দেখি গোল সাদামতো জিনিসটা একটা কুকুরছানা। সে এই বিচিত্রা খেলার কিছুই বুঝতে পারছে না। তার চোখ আতম্কে নীল হয়ে আছে। সে জেনে গেছে তার কপালে আছে অবধারিত মৃত্যু। সে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্যে।
আমি হাত উঁচিয়ে ছেলেগুলোকে ডাকলাম, এই এই—
ছেলেরা কঠিন মুখ করে এগোচ্ছে। কুকুরছানাটা একজনের হাতে। ছানাটার বুক কামারের হাপরের মত উঠানামা করছে।
তোরা এই বাচ্চাটাকে আমার কাছে বিক্রি করবি ?
না
আচ্ছা তাহলে চলে যা। বিক্রি করলে আমি কিনব।
না, বেচব না।
তাহলে চলে যা।
ছেলেরা চলে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছি খেলা আর জমছে না। তারা গোল হয়ে আলাপ করছে। মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। একদল বিক্রি করতে চায়, একদল চায় না। একটা ছেলে এগিয়ে আসছে। তাকে মনে হয় নিগোসিয়েশনের জন্য পাঠানো হচ্ছে—
কী রে, বিক্রি করবি ?
হুঁ।
চাস কত?
পাঁচ শ’ টেকা।
কমাবি না?
না।
দেখ কিছু কমানো যায় কিনা।
দলের অন্যরাও এগিয়ে আসছে। আসন্ন ব্যবসায় সম্ভাবনায় তারা উল্লিসিত। সবার চোখ চকচক করছে। আমি বললাম, পাঁচশ’ টাকা এই কুকুরছানার দাম হয় না তাও হয়তো কিনতাম, কিন্তু লেজটা কালো। কালো লেজের কুকুরের সাহস থাকে না।
এইটা বিদেশী কুত্তা।
কে বলল বিদেশী??
দেইখ্যা বোঝা যায়।
দেখে বোঝা গেলেও এত দাম দিয়া কিনব না। কম কত নিবি?
এক পয়সাও কম নাই।
তোরা তো ব্যবসা ভালো শিখেছিস।
আপনে কত দিবেন?
আমি দশ টাকা দিতে পারি। দশ টাকার এক পয়সা বেশি হলেও নিব না।
ছেলেগুলি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কোথায় পাঁচ শ’ কোথায় দশ! তারা মনে হয় এত হতাশ এর আগে কখনো হয় নি।
কী রে, দিবি দশ টাকায়?
না।
তাহলে চলে যা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমি চোখ বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। আমি জানি এরা যাবে না। এরা দশ টাকাতেই কুকুরটা বিক্রি করবে। আমি একটা পশুর জীবন কিনব দশ টাকায়।