ছুটির দিনের ভোরবেলায় একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প হওয়াটা মন্দ না। চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব এসে গেছে। বড় একটা বিপদ হওয়ার কথা ছিল, হয় নি। সেই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সহমর্মিতার আনন্দ। বড় ধরনের বিপদের সামনেই একজন মানুষ অন্য একজনের কাছে আশ্রয় খোঁজে। পৃথিবীতে ভয়াবহ ধরনের বিপদ-আপদেরও প্রয়োজন আছে।
মেসে আজ ইমপ্রুভড ডায়েটের ব্যবস্থা হচ্ছে। মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ইমপ্রুভড ডায়েট হয়। আজ তৃতীয় সপ্তাহ চলছে,
ইমপ্রুভড ডায়েটের কথা না—ভূমিকম্পের কারণেই এই বিশেষ আয়োজন।
আমি ইমপ্রুভড ডায়েটের ঝামেলা এড়াবার জন্যে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি। হাতে দশটা টাকাও নেই। ইমপ্রুভড ডায়েটের ফেরে পড়লে কুড়ি-পঁচিশ টাকা চাঁদা দিতে হবে। কোত্থেকে দেব?
এরচে’ শুয়ে শুয়ে নিষ্পাপ মানুষের প্রাথমিক তালিকাটা করে ফেলা যাক। একলেমুর মিয়ার নাম লেখা যেতে পারে। ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পাপ তার আছে বলে মনে হয় না। ভিক্ষা নিশ্চয়ই পাপের পর্যায়ে পড়ে না। এই পৃথিবীর অনেক মহাপুরুষই ভিক্ষাবৃত্তি করতেন। তাছাড়া একলেমুর মিয়ার কিছু সুন্দর নিয়মকানুনও আছে। যেমন—সে ভিক্ষার টাকা জমা রাখে না। সন্ধ্যার পর যা পায় তার পুরোটাই খরচ করে ফেলে। অন্য ভিক্ষুকদের রাতের খাওয়া খাইয়ে দেয়।
খাতায় লিখলাম—
১। একলেমুর মিয়া, পেশায় ভিক্ষুক।
বয়স ৪৫ থেকে ৫৫
ঠিকানা : জোনাকী সিনেমাহলের গাড়ি বারান্দা।
শিক্ষা : ক্লাস থ্রি পর্যন্ত।
২। মনোয়ার উদ্দিন।
পেশায় ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার।
শিক্ষা : বিএ অর্নাস।
এই পর্যন্ত লিখেই থমকে যেতে হলো। মনোয়ার উদ্দিন আমার পাশের ঘরে থাকেন। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। শুধু মনে হয় লোকটা ভালো। তাঁকে একদিন দেখেছি আমার কলঘরে একটা ছ’সাত বছরের বাচ্চার মাথায় পানি ঢালছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? তিনি জানালেন, ছেলেটা নর্দমায় পড়ে গিয়ে কাঁদছিল। তিনি তুলে নিয়ে এসে গা ধোয়াচ্ছেন।
বুঝলেন হিমু সাহেব একটা আস্তা লাক্স সাবান হারামজাদার গায়ে ডলেছি তারপরেও গন্ধ যায় না।
মনোয়ার উদ্দিন সাহেবের নামটা লিস্টে রাখা যেতে পারে। ফাইন্যান্স স্ক্রুটিনিতে বাদ দিলেই হবে।
আরো দুইটা নাম ঝটপট লিখে ফেললাম। প্রসেস অব এলিনেশনের মাধ্যমে বাদ দেয়া হবে। এর মধ্যে আছে মোহাম্মদ রজব খন্দকার, সেকেন্ড অফিসার লালবাগ থানা। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন—পুলিশ হয়ে জন্মেছি ঘুস খাব না তা তো হয় না। গোয়ালাকে যেমন দুধে পানি মেশাতেই হয় পুলিশকে তেমনি ঘুস খেতে হয়। আমিও খাব। শিগগির খাওয়া ধরব। তবে ঠিক করে রেখেছি প্রথম ঘুস খাবার আগে তরকারির চামচে এক চামচ মানুষের ‘গু’ খেয়ে নেব। তারপর শুরু করব জোরেশোরে। ‘গু’টা খেতে পারছি না বলে ঘুস খাওয়া ধরতে পারছি না। তবে ঘুস তো খেতেই হবে। একদিন দেখবেন আঙুল দিয়ে নাক চেপে চোখ বন্ধ করে এক চামচ মানুষের গু খেয়ে ফেলব। জিনিসটা খেতে হয়তো বা খারাপ হবে না। কুকুরকে দেখেন না—কত আগ্রহ করে খায়। কুকুরের সঙ্গে মানুষের অনেক মিল আছে।
এখন নাম চারটা—
(১) একলেমুর মিয়া
(২) মনোয়ার উদ্দিন
(৩) মোহাম্মদ রজব খোন্দকার
(৪) রুপা
মনোয়ার উদ্দিনের নাম রাখাটা বোধহয় ঠিক হবে না। বড়ই তরল স্বভাবের মানুষ। তরল স্বভাবের মানুষের পক্ষে পব্ত্রি থাকাটা কঠিন কাজ। তাঁকে প্রায়ই দেখা যায় ময়নার মার সামনে উবু হয়ে বসে গল্প করছেন। ময়নার মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলছে—একটু সইরা বসেন না—এক্কেবারে শইল্যের উপরে উইঠ্যা বসছেন। হি-হি-হি।
সেই হাসি প্রশ্রয়ের হাসি। আহবানের হাসি। তরল স্বভাবের মানুষ যত পবিত্রই হোক এই হাসির আহবান অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
আমি লাল কালি দিয়ে মনোয়ার উদ্দিনের নাম কেটে দিলাম।
দরজায় টোকা পড়ছে। আমি খাতা বন্ধ করে দরজা খুলে দিলাম।
মনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি অত্যন্ত ব্যস্তভঙ্গিতে বললেন, কুড়িটা টাকা ছাড়ুন তো হিমু সাহেব। স্পেশাল খানা হবে—রহমত বাবুর্চিকে নিয়ে এসে খাসির রেজালা আর পোলাও।
আমি শুকনো মুখে বললাম, আমার কাছে টাকা পয়সা নেই।
সামান্য কুড়ি টাকাও নেই? কী বলছেন আপনি! দেখি আপনার মানিব্যাগ?
মনোয়ার সাহেব নাছোড়বান্দা প্রকৃতির মানুষ।মানিব্যাগ দিয়ে দিলাম। শূন্য মানিব্যাগ তিনি খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন।
এত সুন্দর একটা মানিব্যাগ খালি করে ঘুরে বেড়ান কী করে?
ঘুরে বেড়াই আর কোথায়, সারাদিনই তো বিছানায় শোয়া।
আচ্ছা থাক, টাকা দিতে হবে না। আপনি আমার গেস্ট। আপনার খরচ আমি দেব। নো বিগ ডিল। তবে আপনাকে কাজ করতে হবে। বসিয়ে রেখে খাওয়াব না।
কী কাজ?
আমার সঙ্গে বাজার-সদাই করবেন। খাসির গোশত দেখেশুনে কিনতে হবে। চট করে প্যান্ট পরে নিন।
আমি প্যান্ট পরলাম। মনোয়ার সাহেব এলেন পিছু পিছু।
খাসির গোশত কেনা কোনো ইজি ব্যাপার না, বুঝল্নে ভাই। ইট ইজ এ ডিফিকাল্ট জব। খাসির ওজন হতে হয় সাত সের। এর’চে কম ওজনের হলে মাংস গলে যায়। বেশি হলে চর্বি হয়ে যায়। বুঝলেন?
জি বুঝলাম।
খাসির গোশত রান্না করাও খুব ডিফিকাল্ট। একটু এদিক-ওদিক হলে all gone. গোশত নষ্ট হয় কিসে বলুন তো?
বলতে পারছি না।
আলু। আলু দিয়েছেন কি কর্ম কাবার। আলু গলে যায়, সরুয়া থিক হয়ে যায়…
ভদ্রলোকের হাত থেকে যে করেই হোক উদ্ধার পেতে হবে। কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছে না।
মনোয়ার ভাই।
বলুন।
একটু বসুন তো আমার ঘরে। এক দৌড় দিয়ে নিচ থেকে আসছি—একটা পান খেয়ে আসি। বমি-বমি লাগছে।
যাওয়ার পথে পান কিনে নিলেই হবে।
না না—এক্ষুণি পান লাগবে।
আমি ছুটে বের হয়ে এলাম। আর ফিরে না গেলেই হবে। মনোয়ার সাহেব অনেকক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। নিজের ঘর থেকে তালা এনে আমার ঘর বন্ধ করবেন। নিচে খানিকটা খোঁজখবরও করবেন—তারপর সব পরিষ্কার হবে। তিনি সাত সের ওজনের খাসি কিনতে বের হবেন।
মোড়ের পানের দোকান থেকে একটা পান কিনলাম। পান খাওয়ার কথা বলে বের হয়েছি, না খাওয়াটা ঠিক হবে না। মিথ্যার সঙ্গে খানিকটা সত্য মিশে থাকুক। যদিও ভোরবেলা আমি কখনো পান খেতে পারি না। ঘাস খেয়ে একটা দিন শুরু করার মানে হয় না। ঘাস যদি খেতেই হয় দিনের শেষভাগে খাওয়াই ভালো।
কোথায় যাব ঠিক করতে পারছি না। ইয়াকুব সাহেবকে কি বলে আসব—চিন্তা করবেন না—কাজ এগোচ্ছে। নাম লিস্ট করা শুরু হয়েছে। গোটা বিশেক নাম পাওয়া গেছে। সেখান থেকে নাম কাটতে কাটতে একটা নামে আসব। সময় লাগবে। ধৈর্য ধরতে হবে। মানুষের ধৈর্য নেই। মানুষের বড়ই তাড়াহুড়া। পবিত্র গ্রন্থ কোরান শরিফেও বলা হয়েছে—‘হে মানব সন্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।’
বেশ কয়েকটা খালি রিকশা আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালারা আশা-আশা চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। খালি রিকশা দেখলেই চড়তে ইচ্ছা করে। ভুল বললাম, খালি রিকশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে চড়তে ইচ্ছা করে না। চলন্ত খালি রিকশা দেখলে চড়তে ইচ্ছা করে। আমি এ রকম চলন্ত একটা রিকশায় প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়লাম। রিকশাওয়ালা হাসিমুখে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। কোথায় যেতে চাই কিছু জানতে চাইল না। মনে হচ্ছে এ বিপজ্জনক ধরণের রিকশাওয়ালা—যেখানে সে রওনা হয়েছে সেখানেই যাবে। মাঝপথে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লেও কিছু বলবে না, ভাড়া দেন, ভাড়া দেন বলে চেঁচাবে না।
ঢাকা শহরে রিকশাওয়ালাদের সাইকোলজি নিয়ে কেউ এখনো গবেষণা করেন নি। গবেষণা করলে মজার মজার জিনিস বের হয়ে আসত।
মতিঝিলের কাছে আমি লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামলাম। রিকশাওয়ালা আবার হাসিমুখে তাকাল। সে রিকশার গতি কমাল না। যে গতিতে চালাচ্ছিল সেই গতিতেই চালাতে লাগল। আর তখনি বুঝতে পারলাম, এই রিকশাওয়ালা আমার পূর্বপরিচিত। এর নাম হাসান। হাসানের কী যেন একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে। গল্পটা মনে পড়ছে না। আচ্ছা, হাসানের নামটা কি লিস্টিতে তুলব?
আপাতত থাক, পরে কেটে দিলেই হবে। প্রসেস অব এলিমিনেশন। হারাধনের দশটি ছেলে দিয়ে শুরু হবে—শেষ হবে এক ছেলেতে।