দুপুরের খাওয়া হয় নি। খিদে জানান দিচ্ছে। আমি নিয়ম মেনে চলি না। কিন্তু আমার শরীর নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা। যথাসময়ে তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা হয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করার নিয়মকানুন জানা থাকলে হতো। বিজ্ঞান এই দুটি জিনিস জয় করার চেষ্টা কেন করছে না? আমার চেনা একজন আছে যে তৃষ্ণা জয় করেছে। গত তিন বছরে সে এক ফোঁটা পানি খায় নি। তার নাম একলেমুর মিয়া। সে ফার্ম গেটে তার মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করে। আমার সঙ্গে ভালো খাতির আছে। আজ দুপুরে খাওয়া তার সঙ্গে খাওয়া যায়। বড় খালার বাড়িতেও যেতে পারি। কিংবা রূপাদের বাড়ি। তবে রূপার বাড়িতে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। সে কী একটা বই লিখেছে। সকালে উঠে জয়দেবপুরের বাড়িতে চলে যায়। রাতে ফেরে। সেখানে টেলিফোন নেই। ঢাকার বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে।
চট করে কোনো দোকান থেকে টেলিফোন করা এখন আর আগের মতো সহজ নয়। টেলিফোন করতে টাকা লাগে। আগে যে-কোনো দোকানে ঢুকে করুণ মুখে বললেই হতো—ভাই, একটা টেলিফোন করব।
এখন টেলিফোনের কথা বলার আগে কাউন্টারে পাঁচটা টাকা রাখতে হয়।
বিনা টাকায় টেলিফোন করা যায় কিনা না সেই চেষ্টা করা যেতে পারে। নতুন কোনো টেকনিক বের করতে হবে। এমন টেকনিক যা আগে ব্যবহার করা হয় নি। ভিক্ষার জন্যে যেমন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন টেকনিক বের করতে হয়—ফ্রি টেলিফোনের জন্যেও হয়। আমি এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখলাম—
ভাই,
আমার বান্ধবীকে খুব জরুরি একটা টেলিফোন করা
দরকার। সঙ্গে টাকা-পয়সা নেই বলে লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে
পারছি না।
বিনীত
হিমু
কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে পড়লাম। সেলসম্যানকে কাগজটা পড়তে দিলাম। সে পড়ল, খানিকক্ষণ বিস্মিত চোখে আমাকে দেখে টেলিফোন সেট আমার দিকে এগিয়ে দিল।
হ্যালো, আমি হিমু।
চিনতে পারছি।
কেমন আছ রূপা?
ভালো।
আজ জয়দেবপুর যাও নি?
না, কিছুক্ষণের মধ্যে রওণা হব!
আচ্ছা, তোমাদের জয়দেবপুরের বাড়িটা কেমন?
খুব সুন্দর বাড়ি।
কী রকম সুন্দর বল তো?
কেন?
আহা বলো না।
বললে তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?
যেতে পারি।
সাত একর জমি নিয়ে গ্রামের ভেতর খামারবাড়ি কিংবা বলতে পারো খামার হাউস। বাড়ির পেছনে পুকুর আছে। পুকুর বড় না, ছোট্ট পুকুর। কিন্তু মার্বেল পাথরে বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে। বাড়িটা চারদিক দিয়ে গাছপালায় ঘেরা।
বাড়ির ছাদ আছে? ছাদে বসে জোছনা দেখা যায়?
ছাদে বসে জোছনা দেখার ব্যবস্থা নেই। টালির ছাদ।
বাংলো বাড়ি?
হ্যাঁ, বাংলো বাড়ি। যাবে আমার সঙ্গে?
ভাবছি।
তুমি কোথায় আছ বলো, আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাব।
আমি দ্রুত চিন্তা করছি। রূপার সঙ্গে নির্জন বাংলো বাড়িতে পুরো একটা দিন থাকার লোভ জয় করতে হবে। যে করেই হোক করতে হবে। শরীরের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু মনের উপর তো আছে…
হ্যালো—বলো তুমি কোথায় আছ?
শোন রূপা। জরুরি কিছু খবর আমাকে এখন লোকজনদের দিয়ে বেড়াতে হবে। নয়তো যেতাম।
কী জরুরি খবর?
কাল-পরশুর মধ্যে ভূমিকম্প হবে—এই খবর। যদিও তা হবে ছোট সাইজের, তবুও তো ভূমিকম্প।
তুমি আমার সঙ্গে কোথাও যাবে না সেটা বলো—ভূমিকম্পের অজুহাত তৈরি করলে কেন?
অজুহাত না, সত্যি।
তুমি বলতে চাচ্ছ ভূমিকম্পের ব্যাপারে তুমি আগে জেনে ফেলেছে?
হুঁ।
তোমার এই এই…
রূপা কথা পাচ্ছে না। রাগে তার চিন্তা এলোমেলো হয়ে গেছে।
আমি বললাম, টেলিফোন রাখি রূপা? এখন তোমাদের বাংলো বাড়িতে গিয়ে লাভ হবে না। দিন-তারিখ দেখে যেতে হবে—পূর্ণিমা দেখে। নেক্সট পূর্ণিমায় যাব। অবশ্যেই যাব, রাখি কেমন?
আমি টেলিফোন নামিয়ে বের হয়ে এলাম। পাশের একটা দোকানে ঢুকলাম। কাগজের টুকরোটা কতটুকু কাজ করে দেখা দরকার। মনে হচ্ছে ভালো ব্যবস্থা।
এই দোকানটার সেলসম্যান কিংবা মালিক আগের দোকানটার মতো চট করে রিসিভার এগিয়ে দিলেন। ভূরু কুঁচকে কাগজটা দেখতে দেখতে বললেন, আপনি কথা বলতে পারেন না?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
কথা বলতে পারেন তাহলে কাগজে লিখে এনেছেন কেন? এই ঢং করার দরকার কী?
আমি হাসলাম। মধুর ভঙ্গির হাসি। ভদ্রলোকের ভূরু আরো কুচঁকে গেল।
বুঝলেন হিমু, যা করবেন স্ট্রেইট করবেন। বাঁকা পথে করবেন না। ‘ছিরাতুল মুস্তাকিম’—সরল পথ। কোথায় আছে বলেন দেখি?
সূরা ফাতেহা।
গুড। নিন টেলিফোন,যত ইচ্ছা বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করুন।আবার যখন দরকার হবে চলে আসবেন। স্লিপ ছিঁড়ে ফেলে দিন। আমার সামনেই ছিঁড়ুন।
আমি স্লিপ ছিঁড়লাম। ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন,গুড। নিন, কথা বলুন।যা ইচ্ছা বলতে পারেন।আমি শুনব না।আমি একটু দূরে যাচ্ছি।ভদ্রলোক সরে গেলেন। রূপাকে দ্বিতীয়বার টেলিফোন করার কোনো অর্থ হয় না। আমার আর কোনোও বান্ধবীও নেই। টেলিফোন করলাম বড়খালার বাসায়। খালু ধরলেন, মিহি গলায় বললেন, কে হিমু?
খালু, আপনি অফিসে যান নি?
আর অফিসে যাওয়া-যাওয়ি, যে যন্ত্রণা বাসায়!
কী হয়েছে?
তোমার খালা যা শুরু করেছে এতে আমার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।
খালা এখন কী করছেন?
জিনিসপত্র ভাঙছে।আর কী করবে! আমাকে যে সব কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে তা শুনলে বস্তির মেয়েরাও কানে হাত দিবে।
অবস্থা মনে হয় সিরিয়াস।
আর অবস্থা! তুমি টেলিফোন করেছ কেন?
জরুরি একটা খবর দেবার জন্যে টেলিফোন করেছিলাম।এখন আপনার কথাবার্তা শুনে ভুলে গেছি।
বাসায় আসো না কেন?
চলে আসব। এখন কয়েকদিন একটু ব্যস্ত।ব্যস্ততা কমলেই চলে আস।
তোমার আবার কিসের ব্যস্ততা?
নিষ্পাপ মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি খালুজান।
কী খুঁজে বেড়াচ্ছ?
নিষ্পাপ মানুষ।
টেলিফোনেই শুনলাম ঝনঝন শব্দে কী যেন ভাঙল। খালুজান খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।আমার মনে হয় পালিয়ে গেলেন।