তাঁকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিলাম। বড় ক্লিনিক বলেই বোধহয় শুধু টাকারই খেলা। ভর্তি করাবার সময়ই সাতদিনের টাকা এডভান্স দিতে হয়। এই সঙ্গে ডাক্তার এবং ওষুধের বিল বাবদ দেড় হাজার টাকা।
পকেটে আছে দুটা কুড়ি টাকার নোট। একটা পাঁচ টাকার নোট। দ্রুত টাকার যোগাড় করতে হবে। জরুরি সময়ের একমাত্র ভরসা হচ্ছে রূপা। টেলিফোনে তাকে পাওয়া গেলে হয়। ক্লিনিকের রিসিপশান থেকে টেলিফোন করতে হলেও এডভান্স টাকা দিতে হয়। শহরের ভেতর প্রতি কল পাঁচ টাকা। মানুষের রোগ নিয়ে ব্যবসা কত প্রকার ও কী কী হতে পারে তা ক্লিনিকওয়ালাদের মতো ভালো কেউ জানে না।
হ্যালো রূপা?
হুঁ।
কুকুরছানাটা যে পাঠিয়েছিলাম সে কেমন আছে?
ভালো আছে।
পছন্দ হয়েছে তো?
হ্যাঁ,পছন্দ হয়েছে। খুব পছন্দ হয়েছে। এটা কিন্তু নেড়ি কুকুর না। বিদেশী কুকর—পুডল।
শুনে আনন্দি হলাম। এখন তুমি দয়া করে একটা কাজ করো—কুকুরের দাম বাবদ চার হাজার টাকা পাঠিয়ৈ দাও। আমি লোক পাঠাচ্ছি।
লোক পাঠাতে হবে না। তুমি কোথায় আছ বলো—আমি নিজেই টাকা নিয়ে আসছি। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। রূপা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। রূপার এখানে আসতে আসতেও আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। এই ফাঁকে আমি সটকে পড়ব। রূপার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।
কুসুমের জায়গা হয়েছে রুম নাম্বার ৮-এ। বেশ বড় রুম। টিভি পর্যন্ত আছে। কুসুম তার শরীরের তীব্র ব্যথা অগ্রাহ্য করে তার কেবিনের সাজসজ্জা দেখছে। তার চোখে গভীর বিস্ময়।
ডাক্তার সাহেব ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়েছেন। ডাক্তার সাহেবের মুখ শুকানো। মনে হচ্ছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি ইনজেকশনটা দিলেন। আমি বললাম,রোগী কেমন দেখছেন ডাক্তার সাহেব
তিনি রসকষহীন গলায় বললেন, বাইরে আসুন, বলছি।
আমরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ডাক্তার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনারা লষ্ট কেইস নিয়ে এসেছেন। এই মেয়ের বাঁচার কোন আশা নেই। এর হার্ট পুরোপুরি ড্যামেজড। এ যে কীভাবে বেঁচে আছে সেটাই একটা রহস্য।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, জগতটাই রহস্যময় ডাক্তার সাহেব। তবে আপনাকে একটা উপদেশ দেই। লষ্ট কেইস ধরে নিয়ে কোনো রোগীর চিকিৎসা করবেন না। চিকিৎসকরা চিকিৎসা শুরু কররেন ‘gain case ধরে, lost case’ ধরে না।
ভেবেছিলাম আমার কথায় ডাক্তার রাগ করবেন। তিনি রাগ করলেন না। চিন্তিত মুখে আবার মেয়েটির কাছে ফিরে গেলেন।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত বোধ করছি। এই মেয়েটিকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। রূপা চলে আসছে। যা করার সে-ই করবে। টাকা না দিয়েই ক্লিনিক ছেড়ে চলে যাচ্ছি—এটা ক্লিনিকের লোক পছন্দ করছে না। একজন এসে টাকা দেবে—এই সত্য বিশ্বাস করতে তারা প্রস্তুত নয়। ম্যানেজার জাতীয় এক ভদ্রলোক বললেন, আপনি বসুন নারে ভাই। চা পানি খান। উনি আসলে চলে যাবেন। আমি বললাম, আমার কথার উপর ভরসা হচ্ছে না ?
ছিঃ ছিঃ কী বলেন, ভরসা হবে না কেন ?
জামিন হিসেবে একজন রোগী তো আছেই। টাকা-পয়সা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ঝামেলা হলে ইনজেকশন দিয়ে রোগী মেরে ফেলবেন। গেল ফুরিয়ে। মামলা ডিসমিস।
আপনি অমানুষের মত কথা বলছেন। আপনি তো একজন ক্রিমিনাল। ঠিক বলেছেন। এখন দয়া করে অনুমতি দিন—আমাকে মুন্সিগঞ্জ যেতে হবে। মুন্সিগঞ্জের ওসি সাহেবের কাছে ধরা দিতে হবে। যেতে পারি ?
কেউ জবাব দিল না।
হাসপাতালের গেটের কাছে মুনশি বদরুদ্দিন দাঁড়িয়ে। তিনি আমাকে দেখলেন। কিছু বললেন না। মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মনে হচ্ছে তিনি আমাকে পছন্দ করছেন না।
পারাপার – ০৯
মোহাম্মদ রজব খোন্দকার থানায় ছিলেন না। থানার ভেতরেই তাঁর কোয়াটার। গেলাম কোয়র্টারে। আশঙ্কা ছিল তিনি আমাকে চিনতে পারবেন না। অল্প কিছুক্ষণের পরিচয়। না পাবারই কথা। পুলিশদের স্মৃতি দুর্বল হয়। কিন্তু তিনি আমাকে চিনলেন, আনন্দিত গলায় বললেন—আরে দি গ্রেট হিমবাবু।
চিনতে পেরেছেন?
চিনব না মানে? মাথা কামিয়ে গর্ত বানিয়ে বসে ছিলেন। আমি ধরে নিয়ে এলাম। এরপরেও চিনব না? এখন করছেন কী ?
কিছু না।
হণ্টন চালিয়ে যাচ্ছেন? শহরজুড়ে হাঁটাহাঁটির বদঅভ্যাস আছে এখনো?
কয়েকদিন হলো হাঁটছি না। গাড়ি করে ঘুরছি—
গড়ি! গাড়ি কোথায় পেলেন? চোরাই মাল?
চোরাই মাল না।
অবশ্যই চোরাই মাল। ঢাকা শহরে যত গাড়ি আছে সব ব্ল্যাকমানির গাড়ি। তারপর বলুন হিমু সাহেব—আমার কাছে কী জন্যে?
আপনি কেমন আছেন দেখতে এসেছি স্যার।
ভালো আছি। সুখে আছি। মিরপুরে একটা জমি কিনেছি।
ঘুস খাওয়া ধরেছেন?
অবশ্যই ধরেছি। সকাল বিকাল সন্ধা তিন বেলা খাচ্ছি। কী ঠিক করেছি জানেন—আগামী পাঁচ বছর খাব। তারপর তওবা করব। ব্যস, আর না। বাকি জীবন আল্লাহ-খোদার নাম দিয়ে পার করে দেব। পাঁচ বছরের অপরাধ তিনি ক্ষমা করবেন। কারণ তিনি হচ্ছে রহমানুর রহিম। কত কঠিন অপরাধ ক্ষমা করে দেন—ঘুস তো সেই তুলনায় কিছুই না।
স্যার, আপনার কাছে কলম আছে?
কলম কী জন্যে?
পবিত্র মানুষের একটা লিষ্ট করেছিলাম। সেখানে আপনার নাম ছিল—নামটা কেটে দেব।
পবিত্র মানুষদের লিষ্ট ?
হুঁ।
নতুন কোনো পাগলামি ?
হুঁ।
গুড। ভেরি গুড। দু- একটা পাগল- ছাগল সংসারে না থাকলে ভালো লাগে না। হিমবাবু!
জি স্যার ?
রাতে আমার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করবেন। একজন একটা রুই মাছ দিয়ে গেছে, আট কেজি ওজন। নদীর ফ্রেশ মাছ। পোলাওয়ের চালের ভাত করতে বলেছি। পোলাওয়ের চালের ভাত, কগজি লেবু আর মাছের পেটি। দেখি মাছ কত খেতে পারেন। মাছ খেতে পারেন তো?
জি স্যার, পারি।
এখন সত্যি করে বলুন। আসলেই কি পবিত্র মানুষের লিষ্ট আছে?
আছে।
মুন্সীগঞ্জ এসেছেন আমার ব্যাপারে খোঁজখবর করবার জন্যে?
জি।
হিমু সাহেব, পবিত্র মানুষের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। এটা পাবেন না। আমি একজন পবিত্র মানুষকে জানতাম—আমার পিতা। অতি পবিত্র। স্কুলশিক্ষক ছিলেন—মধুর ব্যবহার। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে স্থির থাকতে পারতেন না। লোকে বলত থাকে দেখলে দিনটা ভালো যায়। সেই লোক কী করত জানেন ? তাঁর কাজ ছিল—কাজের মেয়েদের প্রেগনেন্ট করে ফেলা। চারটা কাজের মেয়ে আমাদের বাসায় পর পর প্রেগনেন্ট হয়েছে। আমার মা এদের টাকা-পয়সা দিয়ে গ্রামে পার করে দিতেন। আর শুধু কাঁদতেন…। বুঝলেন হিমু সাহেব, পবিত্র মানুষ না হয়ে সাধারণ মানুষ হওয়াই ভালো।