করিম তার ছাপড়ার ঘর থেকে বের হয়ে আনন্দে দাঁত বের করে ফেলল—
আরে, হিমু ভাইজান আফনে?
কেমন আছিস?
ভালো আছি। আফনের দোয়।
ব্যবসাপাতি কেমন হচ্ছে?
ব্যবসা নাই বললেই হয়। কনটেকে একটা কাম করলাম—পুলা হারাইয়া গেছিল। পাঁচ হাজার টেকা কনটেক। বাইর কইরা দিলাম—এর পরে আর টেকা দেয় না। চইদ্দবার গেছি। কোনোবারে দেয় পঞ্চাশ, কোনোবারে কুড়ি…
শেষে এমন গাইল দিছি—বলছি—হারামির বাচ্চা, তোর মারে আমি…..
চুপ চুপ।
ছরি ভাইজান, ছরি। মিসটেক হইছে—আপনের সাথে মেয়েছেলে আছে খিয়াল নাই। বোরকা পরা খালাম্মা—মাফ কইরা দিবেন। ছোটলোকের জাত—মুখের ভাষার নাই ঠিক…।
আমি মিতুর দিকে তাকালাম। বোরকার ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে করিমের দিকে। কিছুই বলছে না। আমি বললাম, একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে। পলিন নাম। তার পেনসিল বক্সটা আমার সঙ্গে আছে। মেয়েটা কোথায় আছে বল।
বাক্সটা দেন দেহি আমার হাতে।
আমি পেনসিল বক্স তার হাতে দিলাম। বক্স হাতে নিয়েই করিম ফিরিয়ে দিয়ে বিরস গলায় বলল, হারাইছে কই! এই মেয়ে তার মার সাথেই আছে। মেয়ে ইশকুলে পড়ে। তার গালে পোড়া দাগ আছে। ভাইজান, ঠিক বলছি না?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছে।
মিতু বলল, পেনসিল ব্ক্স হাতে নিয়েই বুঝে ফেললেন?
জে।
কীভাবে?
কীভাবে এইটা তো খালাম্মা জানি না। আল্লাহপাক একটা ক্ষমতা দিছে। এই ক্ষমতা বেইচ্যা খাই।
আমার একটা লোক খুঁজে দিতে পারবেন?
জে পারব। অবশ্যই পারব। তয় খালাম্মা কনটেকে কাম করব। টেকা পুরাটা দিবেন এডভান্স। কাম করতে না পারলে গলায় ইটের মালা দিয়া কানে ধইরা শহরে চক্কর দেওয়াইবেন। করিমের এক কথা। যার খোঁজ চান—তার নাম দিবেন, ব্যবহারী জিনিস দিবেন। ছবি থাকলে ছবি দিবেন। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।
আচ্ছা, আমি আসব।
গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম, লোকটাকে কি আপনার বিশ্বাস হয়েছে?
মিতু বলল, আপনার হয়?
হ্যাঁ হয়। এই ক্ষমতা তার আছে। কীভাবে এই ক্ষমতা তার হয়েছে আমি জানি না। তবে হয়েছে। সে আপনার হারানো মানুষ খুঁজে দেবে। তবে…।
তবে কী?
যে হারিয়ে গেছে তাকে হারিয়ে যেতে দেয়াই ভালো। হারানো মানুষকে খুঁজে বের করতে নেই।
মিতু বোধহয় কাঁদছে। বোরকায় মুখ ঢাকা বলে বুঝতে পারছি না। তবে বোরকার পরদা উঠিয়ে দিয়ে বলল, আপনি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি থাকেন তাহলে আর হারানো মানুষ খুঁজব না। আপনি কি রাজি?
আমি বললাম, না।
না কেন?
আপনার আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল। রূপার চেয়ে প্রবল। আমাকে এর বাইরে থাকতে হবে।
কেন?
আমার উপর এই হলো আদেশ।
কার আদেশ?
আমার বাবার। তিনি আমার নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মিতু যাই। মিতু জবাব দিল না।
পারাপার – ০৮
আপনার নাম কি মুনশি বদরুদ্দিন তালুকদার?
জি।
ভালো আছেন?
মুনশি বদরুদ্দিন জবাব দিলেন না, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। আমার সঙ্গে কথাবার্তাও চালাতে চাচ্ছেন না। তালগাছের মতো লম্বা একজন মানুষ। রোগা। ক্লান্ত চেহারা। নামের সঙ্গে মুনশি থাকার কারণে ক্ষীণ সন্দেহ থাকে, হয়তো তাঁর দাড়ি আছে। ভদ্রলোকের দাড়ি নেই। আমি বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
কেন?
এমনি। কিছুক্ষণ কথা বলব? কোনো কারণ নেই।
জমিজমা সংক্রান্ত কোনো কাজ?
না। আমি আপনাকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না। কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাব। আপনার ঠিকানা বের করতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। অফিস থেকে মালিবাগের একটা ঠিকানা দিয়েছিল—দেখা গেল ভুল ঠিকানা।
শুধু শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে চান কেন?
শুনেছি আপনি ঘুস খান না। কাজেই আপনার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ বোধ করছি।
ঘুস তো অনেকেই খায় না।
তাও ঠিক। সবার নাম ঠিকানা জানি না। জানলে সবার সঙ্গেই দেখা করতাম।
কেন?
বারবার কেন কেন জিজ্ঞেস করবেন না তো ভাই—একটু বসতে দিন।
আমার মেয়ে খুব অসুস্থ। আপনি আরেকদিন আসুন।
তার কী অসুখ?
বুকে ব্যাথা।
আজই বুকে ব্যাথা করছে, না অনেকদিনের রোগ?
অনেকদিনের অসুখ।
আমি শারীরিক ব্যথা কমাতে পারি। মেয়েটার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
মুনশি বদরুদ্দিনের মুখের মাংসপেশি সামান্যতমও শিথিল হলোনা। বোঝাই যাচ্ছে এ কঠিন লোক। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে যে দাঁড়িয়েই আছে। এক মুহূর্তের জন্যেও দরজা থেকে হাত সারায় নি। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, আচ্ছা ভাই যাই। আরেকদিন আসব।
সিঁড়ি দিয়ে প্রায় নেমে গেছি, তখন বদরুদ্দিন ডাকলেন, আসুন।
আমি ঘরে ঢুকলাম। একজন সৎ মানুষের বসার ঘর যেমন হওয়া উচিত, ঘরটি তেমন। এক কোনায় কয়েকটা কাঠের চেয়ার, অন্য কোনায় বড় চৌকি। অসুস্থ মেয়েটি এই চৌকিতেই শুয়ে আছে। ১৪-১৫ বছর বয়স। মায়া-মায়া মুখ। হাত-পা এলিয়ে শুয়ে আছে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ব্যথায় ঠোঁট নীল। এই অবস্থায়ও সে আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছে। আমি হাসলাম। সেও হাসার চেষ্টা করল। আমি সহজ গলায় বললাম, মেয়েটার মা কোথায়?
দেশের বাড়িতে। বেতন যা পাই তাতে ফ্যামিলি নিয়ে ঢাকায় থাকা যায় না। আমি একটা ঘর সাবলেট নিয়ে একা থাকি।
এই মেয়েটি কি আপনার সঙ্গে থাকে?
একে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম।
চিকিৎসা হচ্ছে?
বদরুদ্দিন চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আপনার মেয়ের নাম কী?
ওর নাম কুসুম।
আমি বসে আছি একটা চেয়ারে। বদরুদ্দিনের হাতে একটা গ্লাস এবং চামচ। গ্লাসে সম্ভবত শরবত জাতীয় কিছু আছে। তিনি চামচে করে মেয়ের মুখে শরবত দেয়ার চেষ্টা করছেন। মেয়েটা শরবত খেতে চাচ্ছে না। আমি বললাম, ভাই শুনন,আপনার মেয়েটার মনে হয় খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে—চলুন মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
না।
না কেন?
আমি কারো দয়া নেই না।
দয়া বলছেন কেন? বলুন সাহায্য।
আমি কারোর সাহায্যও নেই না।
শুনন ভাই—এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে সাহায্য নিতে হয় এবং সাহায্য করতে হয়। Give and take.
আমি আপনাকে চিনি না, জানি না—কেন আপনি খামাখা বিরক্ত করছেন?
মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে, আপনি তার কষ্ট কমাবার চেষ্টা করবেন না?
আমি আমার সাধ্যমতো করেছি। যেটা আমার সাধ্যের বাইরে সেটা আমি করব না।
বদরুদ্দিন সাহেব—সততা একসময় রোগের মতো হয়ে দাঁড়ায়। সবসময় দেখা যায় সৎ মানুষরা ভয়ানক অহঙ্কারী হয়। এরা নিজেদেরকেই শুধু মানুষ মনে করে, অন্যদের করে না।আপনি নিজে যেমন কারোর সাহায্য নেন না—আমি নিশ্চিত, আপনি কাউকে সাহায্যও করেন না। করেছেন, কাউকে কেনো সাহায্য?
আমি আমার নিজের মতো থাকি।
নিজের মতো থাকার জন্যে তো আপনাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় নি।
আপনি কে?
আমার নাম হিমু। বাইরে ঠাণ্ডা আছে। মেয়েটাকে একটা গরম কাপড় পরান। আমারা তাকে ভালো কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব। আবার যদি না বলেন—তিনতলা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব।
অসুস্থ মেয়েটি তার বাবাকে চমকে দিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, কুসুম, তুমি কি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে?
হুঁ।
তোমার ব্যথা কি এখন একটু কমেছে?
হুঁ। আপনি কে?
আমার নাম হিমু। ভালো নাম হিমালয়।
মেয়েটি আবারো হেসে উঠল। মনে হচ্ছে সে অতি অল্পতেই হেসে ফেলে।
বদরুদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, হাসপাতালে কুসুমকে নিয়ে লাভ হবে না। ওর একটা অপারেশন দরকার। ডাক্তাররা বলছেন এই অপারেশন এখানে হয় না। আগে কখনো হয় নি।
আগে হয় নি বলে কোনোদিন হবে তা তো না। এবার হবে। মেয়েটার গরম কাপড় নেই?
বদরুদ্দিন লাল রঙের একটা সুয়েটার বের করে আনলেন। মেয়েটা আনন্দিত মুখে চুল আঁচড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কোথাও বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।