রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। মোবারক হোসেন সাহেব ন’টার দিকে বাসায় ফিরলেন। আমার ডাক পড়ল দশটায়। দোতলা পেছনের দিকের বারান্দায় তিনি বসে আছেন। বসে না, ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থায় আছেন। পা দু’টা মোড়ার উপর। খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত তোলা এক লুঙ্গি কোন রকমে কোমরে জড়ানো। তিতলী আমাকে নিয়ে গেল। তিনি হাই তুলতে তুলতে বললেন, বোস।
হাতলবিহীন একটা চেয়ার রাখা হয়েছে আমার জন্যে। আমি বসলাম। তিনি আবারো হাই তুলতে তুলতে তিতলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘরে টক দৈ আছে কি-না দেখতো মা। থাকলে আমাকে এক বাটি দিয়ে যাও।
তিতলী চলে গেল। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আমার সঙ্গে কথা বলার কোন রকম আগ্রহ দেখলাম না। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। তবে মোড়ায় রাখা পা নড়ছে। তা থেকে ধারণা করা যেতে পারে ভদ্রলোক জেগেই আছেন।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘প্রথমেই তোমার একটা ভুল ধারণা ভাঙ্গানো দরকার। আমার স্ত্রী এবং কন্যার আচার আচরণে তোমারা হয়ত ধারণা হয়েছে জহিরের পালিয়ে যাবার ব্যাপারটায় আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। ব্যাপারটা মোটেই তা না। এটা নতুন কোন ঘটনা না। এ জাতীয় ঘটনা আগেও ঘটেছে। আমি বরং খুশি যে সে বাড়ি থেকে বিদেয় হয়েছে। তোমাদের বাংলায় একটা প্রবচন আছে না—দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল?’
‘উল্টা প্রবচনও আছে স্যার, ‘নাই গরুর চেয়ে কানা গরু ভাল।’ অবশ্যি প্রবচন একটু অন্যভাবে আছে—নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। মুল ভাব কিন্তু এক।’
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমার চেহারায় কোথায় যেন একটু বোকা ভাব আছে। যার সঙ্গেই কথা বলি সেই আমাকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে। যদিও আমি মানুষটা বোকা না। একটা বোকা লোক সব সরকারের আমলে মন্ত্রী হয় না। এক সরকারের আমলে হয় অন্য সরকারের আমলে জেলে চলে যায়। আমি এখনও জেলে যাইনি।
‘আপনি বুদ্ধিমান এই নিয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’
‘বুদ্ধিমান মানুষ আবার নানা ধরনের আছে। কিছু মানুষ আছে যারা বড় সমস্যা। সমাধানে বুদ্ধিমান, আবার ক্ষুদ্র সমস্যার ব্যাপারে না। আমি ছোট এবং আপাতত তুচ্ছ বিষয়েও বুদ্ধিমান। প্রমাণ চাও?’
‘আমি চাচ্ছি না। আপনি দিতে চাইলে দিতে পারেন।’
‘বেশ প্রমাণ দিচ্ছি। তোমাকে নিয়ে আমার মেয়ে উপস্থিত হল। আমি চাচ্ছিলাম না আমাদের কথাবার্তায় সে থাকুক। তাকে চলে যেতে ও বলতে চাইলাম না, কারণ তাতে তার ধারণা হতে পারে আমি তোমার সঙ্গে জরুরী কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছি। কাজেই তাকে টক দৈ আনতে বললাম। আমি জানি ঘরে টক দৈ নেই। দোকান থেকে আনতে হবে। এতে খুব কম করে ও হলে আধ ঘণ্টা সময় লাগবে। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে আধ ঘণ্টা যথেষ্ট। আশা করি প্রমাণ পেয়েছে যে আমি বুদ্ধিমান।’
‘জ্বি পেয়েছি। বলুন কি বলবেন।’
‘আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনলাম জহিরের চিঠি তুমি পড়েছ। যে ছেলে নিজের বাবা-মা সম্পর্কে এত কুৎসিত কথা লিখতে পারে তার বাড়িতে থাকার এমনিতেই কোন অধিকার নেই। সে চলে গেছে ভাল করেছে। গুড ফর হিম। আমার সম্পর্কে
যে সব অভিযোগ এনেছে তার প্রত্যেকটার জবাব দেয়া যায়। কী জবাব দেব তুমি কি শুনতে চাও?’
‘না।’
‘শুধু একটার জবাব দিচ্ছি—বুলু মাষ্টারের ব্যাপারটা। লোকটা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। স্কুল টিচার, তার কাজ হচ্ছে ছাত্র পড়ানো। করে পলিটিক্স। সারাক্ষণ আমার বিরুদ্ধে লেগে ছিল। ইচ্ছা করলেই হারামজাদাকে আমি দশ হাত পানির নিচে পুঁতে ফেলতে পারতাম। তা করিনি। আমি মন্ত্রী হয়ে যাবার পর স্থানীয় লোকজন আমাকে খুশি করবার জন্যে তাকে খুনের মামলায় জড়িয়ে ফেলল।
খেয়াল রাখবে আমি কাউকে কিছু করতে বলিনি। ওসি আমাকে খুশি করতে চাইল, স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান খুশি করতে চাইল, একদল মিথ্যা সাক্ষী জুটে গেল। একদল অসৎ লোক মিলে কাণ্ডটা করল।’
‘আপনি কি খুশি হলেন?’
‘আমি সহজে খুশি হই না, সহজে ব্যাজারও হই না। আমার পুত্র এইসব ব্যাপার জানে না। সে জানে আমি শয়তান ধরণের মানুষ। ভাল কথা। ছেলে উপযুক্ত হয়েছে সে তার নিজস্ব ধারণা করতেই পারে—ছেলের ব্যাপারে আমার মোটেই মাথা ব্যথা নেই। আমি তোমার ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছি।’
মোবারক হোসেন সাহেব এই প্রথম চোখ মেললেন। আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। আমি খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, আমার কি ব্যাপার জানতে চান?’
‘সব কিছুই জানতে চাই। আমি কিছু খোঁজ-খবর করিয়েছি। এখনো করছি। তোমার উদ্দেশ্যটা কি? জহিরকে গর্ত খুঁড়ে বসিয়ে রাখার কাজটা যে তুমি করেছ, আমার ধারণা তা খুব ভেবে চিন্তে করেছ। এর পেছনে তোমার পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনাটা কি ? চট করে জবাব দিতে হবে না। ভাব। ভেবে ভেবে জবাব দাও।’
আমি চুপ করে রইলাম। মোবারক সাহেব চাপা গলায় বললেন, তুমি কি নিজেকে মহাপুরুষ মনে কর?
‘না।’
‘অনেকেই মনে করে।’
‘কেউ কেউ করে।’
‘অনেকের ধারণা তোমার সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে। যে ওসি তোমাদের ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল তাঁরও ধারণা সে রকম। তোমার কি আছে কোন সুপারন্যাচারাল ক্ষমতা?’
‘না। তবে আমার ইনট্যুশন ক্ষমতা প্রবল। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলে ফেলতে পারি।’
‘সে তো সবাই পারে। তোমার ইনট্যুশন এই মুহূর্তে কি বলছে?’
‘এই মুহূর্তে আমার ইনট্যুশন বলছে আপনি বড় রকমের ঝামেলায় পড়েছেন। এখন আর তেল এবং জ্বালানি মন্ত্রী না।’
মোবারক হোসেন শীতল গলায় বললেন, তোমার ইনট্যুশন ক্ষমতা কিছুটা হয়ত আছে, কিন্তু বলা যায় অনুমান শক্তি প্রবল। ব্যাপারটা ঘটেছে আজ রাত আটটায়, তোমার জানার কথা না। প্রেসিডেণ্টের গুডবুক থেকে নাম কাটা গেছে, গুড বুক থেকে নাম কাটা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাড বুকে নাম উঠে যায়। সেখানে নাম উঠে গেছে। আমাকে জেলে যেতে হতে পারে। তোমার ইনট্যুশন কি বলে?
‘আমার ইনট্যুশন কিছু বলছে না।’
মোবারক হোসেন আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মোড়ায় রাখা তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুল কাঁপতে লাগল। মনে হয় এই হল তাঁর চিন্তার পদ্ধতি।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমাকে জেলে ঢুকানো সহজ না। এতে থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে। আমাকে অখুশি করাও বর্তমানে সরকারের পক্ষে খুব রিস্কি।’ মেরে ফেললে ভিন্ন কথা। তোমার ইনট্যুশন কি বলে?’
‘কিছু বলছে না।’
‘তোমাকে ডেকে আনার কারণ এখন বলি, ভাল কথা, তুমি নিজে কি কিছু আন্দাজ করতে পারছ?’
‘না।’
‘কথা বলার জন্য ডাকলাম আর কিছু না। একটা পর্যায় আছে যখন কথা বলার কেউ আশেপাশে থাকে না। আমার অনেক কথা আছে। বলার মানুষ নেই। জহিরের বিষয় নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। লেট হিম গো টু হেল। অবশ্য গেছেও তাই। কোথায় আছে সেই খোঁজ বের করা আমার পক্ষে কঠিন না। বের করতে চাচ্ছি না। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ, তুমি আমার সঙ্গে একধরনের খেলা খেলার চেষ্টা করছ। ভাল কথা, খেল। শুধু জানিয়ে রাখলাম—যে খেলাটা তুমি গোপনে খেলতে পারছ না। আমি জানি।’
তিতলী টক দৈয়ের বাটি নিয়ে ঢুকল। আমি বললাম, চাচা আমি কি এখন যেতে পারি?
‘অবশ্যই যেতে পার। তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়নি। গুড নাইট।’
দরজার ওপাশে – ০৪
ঘুম ভেঙ্গে কেউ যদি দেখে তার মুখের ঠিক ছ’ইঞ্চি উপর একটি অচেনা মেয়ের মুখ ঝুঁকে আছে, যার চোখ টানা টানা, বয়স অল্প,
তাহলে তার ছোটখাট ধাক্কা খাওয়ার কথা। আমি তাই খেলাম। প্রথম কয়েক সেকেণ্ড মাথা ফাঁকা হয়ে থাকল। তারপর শুনলাম, অচেনা মেয়েটি বলছে—‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। কোন মেয়ে যদি জিজ্ঞেস করে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন, তাহলে তার মুখের উপর না বলা যায় না। কেউ বললে আদালতে তার জেল জরিমানা দুই-ই হবার বিধান থাকা উচিত।
‘চিনতে পারছেন তো আমাকে? এর আগে দু’বার দেখা হয়েছে। আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারিনি। দাড়ি গোঁফ কেটে ফেলেছেন কেন? আপনাকে সুন্দর লাগতো। আমি ঘরে ঢুকে প্রথম একটু চমকে গেলাম। ভাবলাম, কার না কার ঘরে ঢুকেছি। আচ্ছা, আপনি এমন দরজা খোলা রেখে ঘুমান? চোর এলে তো সর্বনাশ হয়ে যেত।’
আমি মেয়েটিকে চিনলাম। কথা বলার ভঙ্গি থেকে চিনলাম। এই মেয়ে একনাগাড়ে কথা বলছে। খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। আমার চেনার মধ্যে এরকম আন্তরিক ভঙ্গিতে একজনই কথা বলে—রফিকের বউ। কিন্তু রফিকের বউয়ের স্বাস্থ্য বেশ ভাল ছিল—এই মেয়েটিকে দারুণ রোগা লাগছে।
‘আমি কতক্ষণ আগে এসেছি বলুন তো? কাঁটায় কাঁটায় দেড় ঘণ্টা। বেশ কয়েকাবার আপনার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছি। দরজায় ঠক ঠক করেছি, খক খক করে কেশেছি। দিনের বেলায় কারো এমন গাঢ় ঘুম হয় আমি জানতাম না। শেষে কি হল জানেন? একটু ভয় লাগল।’
‘কিসের ভয়?’
‘হঠাৎ মনে হল কেউ হয়ত আপনাকে খুনটুন করে গেছে। দরজা খোলা তো, তাই এ রকম মনে হল। নিঃশ্বাস পড়ছে কি-না দেখার জন্যে আপনার মুখের উপর ঝুঁকে ছিলাম।’
আমি উঠে বসতে বললাম, রফিক ভাল?
‘সেটাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি।’
‘আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছেন কেন? আপনি জানেন না? দেখা হয় না?’
‘রোজই দেখা হয়। ও রোজ একবার আসে। ঠিক সন্ধ্যার দিকে আসে। ভাইয়ার বসার ঘরে ঘণ্টাখানিক বসে থেকে চলে আসে।’
‘আপনার সঙ্গে কথা হয় না?’
‘না। ভাইয়া আমাকে বলে দিয়েছে আমি যেন কথা না বলি। তারপরেও বলতাম। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা আবার ভাইয়া বাসায় থাকে।’
‘আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কেন? চেয়ারটায় বসুন।’
‘আমার নাম কি আপনার মনে আছে?’
‘মনে আছে। আপনার নাম যূথী।’
‘অনেক চন্দ্রবিন্দু দিয়ে যূথী লেখে। আমিও আগে লেখতাম। এখন লিখি না। আচ্ছা শুনুন, আপনার চিঠি এসেছে। নিচে পড়ে ছিল,আমি টেবিলে রেখে দিয়েছি। নিন।’
‘চিঠি পরে পড়ব। এমন কিছু জরুরী চিঠি না। আমার বাড়ির চিঠি। প্রতি মাসের শেষের দিকে তাঁরা একটা চিঠি পাঠান।’
‘আপনি একটা র্শাট গায়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ভদ্র হয়ে আসুন—কথা বলি। আপনার সঙ্গে খুব জরুরী কথা আছে। আর শুনুন, আপনার এখানে চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। যেন এটা তারই বাড়িঘর। আমি চৌকিতে বসতে বসতে বললাম, বলুন কি ব্যাপার?
‘আপনার বন্ধুর চাকরির কি কিছু হয়েছে? ভাইয়া ওকে জিজ্ঞেস করছিল। ও বলল—হিমুকে বলেছি। হিমু সব ঠিক করে দেবে। ভাইয়ার ধারণা ও কাউকেই কিছু বলেনি।’
‘আমাকে বলেছে।’
‘আমি জানি বলেছেন। ও কখনো মিথ্যা কথা বলে না। আমি ভাইয়াকে সেটা বললাম, ভাইয়া আমার উপর রেগে গেল। ভাইয়া ওকে দু’চোখে দেখতে পারে না।বলে সাব-হিউমেন স্পেসিস। ভাইয়া বলে—ওর শুধু চেহারাটা আছে।কোল বালিশের খোলটা শুধু ঘুরে, ভেতরে বালিশ নেই।
‘আপনার ভাইয়া কি রফিকের চাকরির কোন চেষ্টা করছেন?’
‘না। করবেও না। বললাম না ওকে দেখতে পারে না। ওর নাম শুনলেও রেগে যায়। তার উপর এখন বলছে—ওকে ডিভোর্স দিতে।’
‘তাই না-কি?’
‘হ্যাঁ। এটা আপনাকে বলার জন্যই এসেছি। ভাইয়ার বাসায় ওকে কেউ দেখতে পারে না। আমার ভাবী বলছিল—যূথী,তুমি যে ঐ ছেলের সঙ্গে থাকতে চাও—ওর তো মাথা খারাপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না। কোন সুস্থ ছেলে এই কাজ করবে না। একদিন দেখবে ঘুমের মধ্যে তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। তার পর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে দড়িতে ঝুলিয়ে বলবে আত্মহত্যা। পাগলদের বাস্তব বুদ্ধি আবার ভাল থাকে। আমি ভাবীর কথায় গুরুত্ব দেই নি—এখন আপনি বলুন, দিনের পর দিন কেউ যদি কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে—ডিভোর্স দাও, ডিভোর্স দাও, তাহলে কি ভাল লাগে?’