আমার এই চিঠি পড়ে খুব রাগ করবি। একবার ভেবেছিলাম চিঠি লিখব না। তাতে সবাই দুঃশ্চিন্তা বেশি করবে। তাই এই চিঠি। তোদের সঙ্গে আমি থাকতে পারছি না। মানুষ হিসেবে বাবা অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি অনর্গল মিথ্যা বলেন। একের পর এক আজে বাজে কাজ করে যান। কিছু কিছু কাজ এমন যে শয়তানের পক্ষেও করা সহজসাধ্য না। উদাহরণ দেই—আমাদের গ্রামের বাড়ির বুলু মাস্টার। ভদ্রলোক নিতান্তই ভাল মানুষ। তাঁর অপরাধের মধ্যে অপরাধ হচ্ছে, ইলেকসনের সময় বাবার বিরুদ্ধে নানান কথা বলেছে যেন লোকজন বাবাবে ভোট না দেয়। সে যে সমস্ত কথা বলেছে তার প্রতিটি বাক্য সত্য। যাই হোক। বাবা তাঁকে খুনের মামলায় এমন ফাঁসানো ফাসিয়েছেন যে এক থাক্কায় যাবজ্জীবন হয়ে গেল। এই জাতীয় মানুষের সঙ্গে কি বাস করা যায়? তুই-ই বল। মা’ও যে বাবার চেয়ে আলাদা, তা না। বাবার প্রতিটি অন্যায় মা সমর্থন করে যাচ্ছেন। আদর্শ স্বামীর আদর্শ স্ত্রী। বাবাকে একবার তিন লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে গেল। টাকাটা দিয়ে গেল মা’র হাতে। মা শান্ত ভঙ্গিতে সেই টাকা আয়রণ সেফে তুলে রাখলেন। তাঁর মধ্যে কোন বিকার নেই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কোথায় যাব জানি না। গর্ত খুঁড়ে মাটিতে ঢুকতে ইচ্ছা করছে। ভাল কথা, ঐ রাতে হিমুর সঙ্গে গর্ত খুঁড়ে বসেছিলাম—দারুন লাগছিল। দু’জনেই থানায় গেলাম, বাবা আমাকে ছাড়িয়ে আনলেন, হিমুকে আনলেন না। বেচারা একা বসে রইল। পুলিশ নিশ্চয়ই তাকে মারধোরও করেছে। বাবা সেরকম ইঙ্গিত দিয়ে এসেছেন। অবশ্য এতে হিমুর কিছুই যাবে আসবে না। পুলিশের পক্ষে ওকে হজম করা মুশকিল। ও কঠিন চিজ।
তুই ভাল থাকিস। প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাক যাতে তুইও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারিস। বাঁচার পথ একটাই। তোর ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা নিয়ে গেলাম। একবারে খালি হাতে বে হতে সাহস পাচ্ছি না।
‘বাবা চিঠি পড়লে?’
‘জ্বি পড়লাম।’
‘কিছু বলবে?’
‘ও কত টাকা নিয়েছে?’
‘সাতশ তেত্রিশ টাকা।’
‘চিন্তার কোন কারণ দেখি না। টাকা শেষ হলেই ফিরে আসবে। আগেও তো অনেকবার পালিয়েছে। নতুন কিছু তো না।’
জহিরের বাবাও তাই বলেছেন। কিন্তু আমি ভরসা পাচ্ছি না। রোজ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। ঐ দিন দেখলাম…
তিতলী বলল, গোসলের পানি দেয়া হয়েছে, আপনি আসুন। মেয়েটা এখনো চোখে-মুখে ঘৃণা ধরে আছে। ভালবাসা অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায়, ঘৃণা না। মেয়েটা কি করে ধরে রেখেছে সে-ই জানে।
‘কি হল, বস আছেন কেন? আসুন।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলাম এবং বাথরুমে ঢোকার আগে থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনাদের বাথরুমে কি বাথটাব আছে?
‘হ্যাঁ আছে।’
‘তাহলে দয়া করে দু’কেজি বরফের ব্যবস্থা করুন। বাথটাবে পানি দিয়ে আমি তার মধ্যে দু’কেজি বরফ ছেড়ে দেব। তারপর নাক ভাসিয়ে শুয়ে থাকব।’
‘পাগলামী কথাবার্তা আমার সঙ্গে বলবেন না। পাগলামী কথা শুনে আমি মুগ্ধ হই না। আমি জহির না।’
‘আপনাদের ডীপ ফ্রীজে বরফ নেই?’
তিতলী জবাব দিল না। আমি আশাও করিনি।
মন্ত্রীর বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন প্রচুর থাকবে এটা ভাবাই স্বাভাবিক। বিশাল ডাইনিং টেবিল থাকবে।চায়নীজ রেস্টুরেন্টের মত উর্দিপরা বয় থাকবে। ন্যাপকিন-কাটাচামচ থাকবে। সে রকম কিছু না। খেতে এসে দেখি খুবই এলেবেলে ব্যবস্থা। খাবার টেবিলটা ছোট। টেবিল ক্লথে তরকারির দাগ লেগে আছে। উর্দিপরা বয় বাবুর্চি দেখলাম না—বৃদ্ধা এক কাজের মেয়েকে দেখলাম তিতলী যাকে বড় বুবু করে ডাকছে। আয়োজনের সামান্য—রুগ্ন ধরনের কই মাছ, মুরগীর মাংস, ডাল এবং কালচে ধরনের পেপেভাজি।
তিতলী কঠিন ভঙ্গিতে বলল, খেতে বসুন।
‘আপনাদের খাওয়া হয়ে গেছে?’
‘খাওয়া না হলেও আপনার সঙ্গে বসে খাব এরকম ভাবছেন কেন?’
‘ভাবছি না।’
‘না ভাবলেই ভাল, বড়বুবু আছেন কিছু লাগলে উনাকে বলবেন, উনি দেবেন। আমি এসেছি শুধু আপনাকে একটা খবর দেবার জন্যে।
‘কি খবর?’
‘আপনি যে এসেছেন বাবাকে বলা হয়েছে। বাবা একটা কেবিনেট মিটিংএ আটকা পড়েছেন।আসতে রাত হবে। বাবার সঙ্গে দেখা না করে আপনি যাবেন না। খাওয়া শেষ হলে বড় বুবু আপনাকে ভাইয়ার ঘরে নিয়ে যাবে। আপনি ঐ ঘরে বিশ্রাম করবেন।’
‘হাউস এ্যারেস্ট?’
‘ভাইয়া চিঠিতে লিখেছে কেউ আপনাকে হজম করতে পারে না। আমরা পারব কেন? আপনাকে থাকতে বলা হয়েছে, আপনি থাকবেন।’
ঠিক আছে থাকব। তুমি বস, খেতে খেতে গল্প করি। আমার সঙ্গে গল্প করবে? আমি অনেক হাসির গল্প জানি।’
‘আপনার সঙ্গে গল্প করব মানে? হু আর ইউ? তাছাড়া তুমি করে বলছেন কেন? বাংলা সিনেমা পেয়েছেন? সব জায়গায় ভড়ং চলে না। মনে রাখবেন।’
‘আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তিতলী তুমি গল্প করতে না চাও করবে না। চেঁচামেচি করছ কেন? কেউ খাওয়ার সময় চেঁচামেচি করলে আমি খেতে পারি না। হাজার হলেও তোমাদের অতিথি। তাছাড়া খাবার আয়োজনও ভাল না। গল্পগুজব না করলে এইসব খাবার আরো বিস্বাদ লাগে।
‘তুমি তুমি করে কেন আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন? এই অধিকার আপনাকে কে দিল? এত সাহস আপনি কোথেকে পাচ্ছেন? আমি আপনাকে একটা শিক্ষা দেব। এমন শিক্ষা দেব যে আপনি কোনদিন ভুলবেন না।’
জহিরের মা এই পর্যায়ে খাবার ঘরে ঢুকে বললেন, কি হয়েছে?
তিতলী বলল, কিছু না।
জহিরের মা বললেন, বাবা তোমাকে রাত এগারোটা পর্যন্ত থাকতে হবে। তোমাকে কি তিতলী এই কথা বলেছে?
‘বলেছে। আমার কোন অসুবিধা নেই।’
‘খেতে পারছ বাবা?’
‘আমাকে এত ঘন ঘন বাবা বলবেন না। আমার খুব অস্বস্থি লাগে।’
‘তোমার মা যখন বলেন তখনো কি অস্বস্থি লাগে?’
‘মা বলার সুযোগ পান নি। মা বললেও লাগতো বলেই আমার ধারণা’