গোসল না করেই ফুপার ঘর থেকে বের হলাম। ডাক্তারখানা থেকে ওসি সাহেব কে টেলিফোন করলাম। ভদ্রলোক হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন বলে মনে হল। আনন্দে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তা তো করে তোতলালেন।
‘কে বলছেন, হিমু সাহেব? ও মাই গড। আপনাকে আমরা পাগলের মত খুঁজছি। আপনি আত্মীয়স্বজনের যে লিস্ট দিয়ে গিয়েছিলেন সেই লিস্ট ধরে ধরে সবার কাছে গিয়েছি। যাদের টেলিফোন নাম্বার আছে তাদের অনবরত টেলিফোন করছি।’
‘কেন বলুন তো?’
‘বিরাট সমস্যা হয়েছে ভাই। মোবারক হোসেন সাহেবের ছেলে—ঐ যে আপনার বন্ধু জহির—ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না। মোবারক সাহেবের ধারণা, আপনি তাকে ফুসলে-ফাসলে নিয়ে গেছেন, কিংবা আপনি জানেন সে কোথায় আছে।’
‘আমি জানি না।’
‘ভাই, আপনি জানেন কিংবা না জানেন, মোবারক হোসেন সাহেবের সঙ্গে আপনাকে একটু দেখা করতে হবে। এক্ষুণি।’
‘এক্ষুণি তো যেতে পারব না। আমার এখনো গোসল হয় নি।’
‘ভাই আমি সামান্য ওসি। ছোট চাকরি করি। আপনারা দু’জন এসে আমাকে মন্ত্রীর থাবার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এখন উদ্ধার করুন।’
‘আপনার স্ত্রী কেমন আছেন? উনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন?’
ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।আমি বললাম, ঐদিন যদিও আপনি বলেছেন আপনার স্ত্রী সুস্থ আমার তা মনে হয় না। আমার ধারণা, তিনি বেশ অসুস্থ। আমার ইনট্যুসন পাওয়ার খুব প্রবল। সব সময় তা কাজ করে না। মাঝে মাঝে করে। এখনো করছে। এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি—এখনো মনে হচ্ছে তিনি খুব অসুস্থ্।
ওসি সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ সে অসুস্থ। তাঁর অসুখ সারাবার সাধ্য কারোর নেই। আপনার থাকলেও থাকতে পারে। এটা বড় ব্যাপার না, এই মুহুর্তে বড় ব্যাপার হচ্ছে এখন আপনি আমাকে দয়া করে উদ্ধার করুন। প্রীজ, ঐ বাড়িতে যান।
‘এখন গেলে তো উনাকে পাওয়া যাবে না। মন্ত্রী সাহেব বিকেলে ফিরে ঘণ্টা খানেক ঘুমান, তারপর আবার বের হন। ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা।’
‘উনি না থাকলেও উনার স্ত্রী আছ্নে। উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
ভাই, আপনি কি যাবেন?’
‘যাচ্ছি।’
‘সত্যি যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ সত্যি যাচ্ছি।’
‘ভাই অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি না জেনে আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।’
‘ক্ষমা করে দিলাম। আপনার স্ত্রীর অসুখটা কি?’
‘ওর গলায় ক্যানসার। মাসখানিক আয়ু আছে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আপনি ক্যানসার সারাতে পারেন?’
‘না।’
‘তাও ভাল স্বীকার করলেন। সবাই বলে সারাতে পারে। হোমিওপ্যাথ ডাক্তাররা বলে পারে, কবিরাজ বলে পারে, পীর-ফকির বলে পার।’
‘আপনার স্ত্রীর নাম কি রানু?’
‘তাকে চেনেন?’
‘চিনি না, হঠ্যাৎ মনে হল তাঁর নাম রানু। তাঁর মাথা ভর্তি চুল।’
ওসি সাহেব জবাবে হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।
জহিরদের বাড়িতে তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই ঢুকলাম। জহিরের মা সঙ্গে সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ভদ্রমহিলা দেখতে অবিকল তিতলীর মত। যেন মা’র মাথা কেটে তিতলীর ঘাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। মা-মেয়ের চেহারায় এত মিল সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে দু’জনের তাকানোর ভঙ্গি দু’রকম। মা শান্ত চোখে আমাকে দেখছেন। মেয়ের চোখে তীব্র রাগ এবং ঘৃণা। এমণভাবে আমাকে দেখছে যেন মাটির নিচ থেকে অদ্ভুদ জন্তু বের হয়ে এসেছে। মেয়েই প্রথম কথা বলল, আমার ভাই কোথায়?
‘আমি জানি না কোথায়।’
‘দয়া করে মিথ্যা বলবেন না। আপনি যথেষ্ট যন্ত্রনা করেছেন। আমরা আর যন্ত্রনা সহ্য করব না।’
জহিরের মা বললেন, তিতলী তুই চুপ কর তো। চুপ করে বসে থাক। যা বলার আমি বলব। বাবা, তুমি কি সত্যি জান না ও কোথায়?’
‘সত্যি জানি না।’
‘কোথায় থাকতে পারে তা কি জান?’
‘না, তাও জানি না।’
‘কিছু মনে করো না বাবা। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি জান। জেনেও বলছ জানি না।’
‘এ রকম মনে হবার কারণ কি?’
‘ও একটা চিঠি লিখে গেছে। চিঠি থেকে মনে হচ্ছে তুমি জান। তিতলী চিঠিটা এনে একে দেখা।’
‘চিঠি দেখাতে হবে না মা। ব্যক্তিগত চিঠি বাইরের মানুষকে দেখানোর দরকার কি?’
‘ও বাইরের মানুষ না, ও জহিরের বন্ধু। তুই চিঠি নিয়ে আয়।’
তিতলী চিঠি আনতে গেল। ভদ্রমহিলা কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁকে খুবেই কাহিল দেখাচ্ছে। চোখ লাল। মনে হয় রাতে ঘুমটুম হচ্ছে না।
‘বাবা, তোমার নামটা যেন কি?’
‘হিমু।’
‘ও হ্যাঁ হিমু। জহির কি তোমার খুব ভাল বন্ধু?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সেটা জহির বলতে পারবে। আমি তো বলতে পারব না। আমি জহিরকে খুব পছন্দ করি—এইটুকুই বলতে পারি।’
‘কেন পছন্দ কর?’
‘ভাল ছেলে। সরল সাদাসিধা। মনটা গভীর দিঘির জলের মত স্বচ্ছ।’
ভদ্রমহিলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মেয়েকে আসতে দেখে চুপ করে গেলেন। তিতলী আমার সামনে চিঠিটা রাখল। তার ফর্সা মুখ এখনো র্ঘনায় কুঁচকে আছে।। তিতলীর মা ক্লান্ত গলায় বললেন,
‘বাবা,চিঠিটা পড়। তুমি কি দুপুরের খাওয়া সেরে এসেছ?’
‘না।’
‘তাহলে এখানেই খাবে। জহিরের বাবা তিনটার দিকে আসবেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে তারপর যাবে।’
‘এখানে তো আমি খেতে পারব না। গোসল না করে আমি কিছু খেতে পারি না। সাতদিন আমি আছি গোসল ছাড়া।’
তিতলী বলল, আপনাকে সেটা বড় গলায় বলতে হবে না। আপনার গা থেকে যে বিকট গন্ধ আসছে তা থেকেই আমরা বুঝতে পারছি।
মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম কঠিন গলায় বললেন, তিতলী, তুই ভেতরে যা। এই ছেলে এখানে খাবে। ও গোসলের ব্যবস্থা করতে বল। বাথরুমে তোয়ালে সাবান দাও।
তিতলী উঠে গেল। তিনি আমার দিকে বললেন—বাবা, তুমি আমার ছেলে প্রসঙ্গে যে কথাগুলি বলেছ সেগুলি আমার এই মেয়ে প্রসঙ্গেও সত্য। আমার এই মেয়ের মনটাও গভীর দিঘির জলের মত স্বচ্ছ। ও তোমার উপর রেগে আছে বলে এরকম করছে। ওর ধারণা….
ভদ্রমহিলা কথা শেষ করলেন না। সম্ভবত মেয়ের ধারণার কথা তিনি আমাকে বলতে চান না। আমি জহিরের চিঠি পড়তে শুরু করলাম। চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। তবে বোনকে লেখা, তা বোঝা যাচ্ছে।