বড় ফুপুর বাড়িতে এমন চেহারা নিয়ে উঠা ঠিক হবে না জেনেও উঠলাম। এই বাড়ির বাথরুম খুব সুন্দর । হালাকা নীল রঙের শ্রীলংকা টালি বসানো বাথরুম। বড় একটা বাথটাব আছে। বাথটাব পানি ভর্তি করে শুধু নাকটা ভাসিয়ে শুয়ে থাকা দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তবে ও বাড়িতে উপস্থিত হবার বেশ কিছু সমস্যা আছে।বড়ফুপু ঘোষনা করে দিয়েছেন, আমাকে যেন তাঁর বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে দেয়া না হয়। আমি একটি পাবলিক ন্যুইসেন্স। আমার আসল স্থান—মানসিক রুগীদের জন্যে নির্ধারিত কোন হোম। হোমে জায়গা পাওয়া না গেলে সেকেন্ড চয়েস মীরপুর চিড়িয়াখানা। আমার ফুপু তাঁর স্বামীর কোন বক্তব্যের্ সঙ্গে একমত হন না, শুধু এই বক্তব্যে একমত। ফুপার বাড়িতে তারপরও মাসে দু’মাসে একবার যাই। ফুপার দুই ছেলেমেয়ে বাদল এবং রিনকি—এই দু’জনের কারণে। দু’জনই আমার মহাভক্ত। বাদলের ধারণা, আমি রাসপুটিন এবং গৌতম বুদ্ধের ফিফটি-ফিফটি মিকচার। শুধু মহাপুরুষ না, পরমপুরুষ। লোকজন এখনো আমাকে চিনতে পারছে না। যেদিন চিনবে, হৈ চৈ পড়ে যাবে। আমার সম্পর্কে রিনকির ধারণা অবশ্যি এত উচ্চ না। মেয়েরা সহজে কাউকে মহাপুরুষ ভাবে না। পুরুষের দুর্বল দিকগুলি সম্পর্কে তারা সবচে’ ভাল জানে বলেই তারা অনায়াসে মহাপুরুষকেও সাধারণ পুরুষের দলে ফেলে দেয়।
বাদল বসার ঘরে খবরের কাগজ পড়ছিল। আমাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠল। আনন্দিত স্বরে বলল, আরে হিমুদা! কি যে সুন্দর তোমাকে লাগছে! অদ্ভুদ!
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আছিস কেমন?
বাদল সামাজিক সৌজন্যের ধার দিয়েও গেল না। মুগ্ধ স্বরে বলল, ভুরুও কামিয়ে ফেলেছ? ইস কি অদ্ভুত! ভুরু কামানো মানুষ এই প্রথম দেখলাম। সাদা চাদরে কি অপূর্বই না তোমাকে লাগছে হিমুদা।
‘বাসায় লোকজন আছে?’
‘সবাই আছে। দাঁড়াও ডাকছি। তুমি এক কাজ কর—সন্ন্যাসীদের মত সোফায় পদ্মাসন হয়ে বস। আমি সবাইকে ডাকি। বাবাও বাড়িতে আছেন, অফিসে যান নি। তাঁর পেটে ব্যথা।’
‘তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেল বাদল। পিস্তল বের করে আমাকে গুলি-টুলি করে দেয় কি-না কে জানে।’
‘গুলি করবে কেন শুধু শুধু। আর যদি করেও তোমার কিচ্ছু হবে না। রাসপুটিনকে তিনবার গুলি করা হয়েছিল, পটাসিয়াম সায়ানাইড খাওয়ানো হয়েছিল, নদীর পানিতে চেপে ধরা হয়েছিল…তারপরেও…’
বাদলের কথা শেষ হবার আগেই ফুপু ঢুকলেন। আমাকে দেখে শুরুতে হকচকিয়ে গেলেও চট করে নিজেকে সামলে নিলেন। পাথর হয়ে গেলেন। কর্কশ গলায় বললেন, তুই!
বাদল বলল, হিমুদাকে গ্রাণ্ড দেখাচ্ছে দেখলে মা? উফ অপূর্ব!
ফুপুর গম্ভীল গলায় বললেন, এই নতুন ভং কবে ধরলি?
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। ফূপু বললেন, তোকে না এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। কি মনে করে এলি?
‘গোসল করতে এসেছি ফুপু। গোসল করেই বিদেয় হব। বাথটাবে সারা শরীর ডুবিয়ে…’
‘পাগলের মত কথা বলিস না। তোকে আমাদের বাথরুমে ঢুকতে দেব?’
বাদল বলল, অফকোর্স দেবে মা। আমি বাথটাবে পানি দিচ্ছি। ডিপ ফ্রীজে বরফ আছে মা? বাথটাবে বরফের টুকরা ছেড়ে দেব। গ্রাণ্ড হবে।
ফুপুর ক্রুদ্ধ গলায় বললেন তুই আমার সামনে থেকে যা বাদল, হিমুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
‘তুমি কথা বলতে থাক। আমি বাথটাব রেডি করি। বাথটাবটা আরেকটু বড় হলে আমিও তোমার সঙ্গে গোসল করে ফেলতাম।’
বাদল অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে গেল। ফুপু বললেনে, তোকে যে পুলিশ খুঁজছে এটা তুই জানিস?
‘না। আমি ঢাকায় ছিলাম না।’
‘পুলিশ আমাদের এখানেও রোজ একবার করে তোর খোঁজে টেলিফোন করে।
তুই না-কি কোন মন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেছিস?’
‘জ্বালানী মন্ত্রীর ছেলে?’
‘কোন মন্ত্রী জানি না, তোর ফুপা জানে। সত্যি কিনা বল?’
‘না।’
‘না হলে খামাখা তোকে পুলিশ খুঁজবে কেন?’
‘পুলিশ তো খামাখাই খোঁজাখুঁজি করে ফুপু।’
‘তুই তোর ফুপার ঘরে যা। তার সঙ্গে কথা বল। কথা বলে বিদেয় হয়ে যা। এক মুহূর্তও এখানে থাকবি না।’
‘গোসল করে ভদ্র হয়ে গেলে কেমন হয়?’
‘এই বাড়িতে তোর গোসল হবে না। এক কথা কতবার বলল? যা, তোর ফুপার ঘরে যা।’
ফুপা বিছানায় কাত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। টেবিলে বিরাট এক গ্লাস ভর্তি ঘোলাটে রঙের বস্তু। আমি ঘরে ঢুকেই বললাম, ওরস্যালাইন চালাচ্ছেন না-কি ফুপা?
ফুপা তিক্ত গলায় বললেন, ওরস্যালাইনা না। ডাবের পানি।
‘পেটব্যথা কমেছে কিছূ?’
‘আমার শরীর সম্পর্কে তোমার কৌতুহল দেখানোর কোন কারণ দেখছি না।’
‘ফূপু বলছিল আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
‘আমি কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই না। তোমার সঙ্গে তো নয়ই।’
‘তাহলে ফুপা যাই?’
‘না বোস। তোমার ফুপু কি বলেছে যে পুলিশ তোমাকে খুঁজছে?’
‘জ্বি, বলেছেন।’
‘মন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে না-কি ভেগেছ? করেছ কি? খুন করেছ?’
‘না।’
‘এখন না করলেও করবে। You will up in murder. তুমি এক্ষুণি মন্ত্রীর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কর। এবং পুলিশকে বল আর যেন তারা টেলিফোন করে আমাকে বিরক্ত না করে।’
‘আচ্ছা বলব। আমি কি এখন উঠতে পারি ফুপা?’
‘হ্যাঁ উঠতে পার। আমি তোমাকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছিলাম , তারপরেও এসেছ?’
‘গোসল করার জন্যে এসেছি। গোসল করেই চলে যাব।’
‘গোসলের জন্যে বাথরুম খোঁজা তোমার শোভা পায় না হিমু্। তুমি গোসল করবে ডোবায়, নর্মায়। মানুষ স্নান করে পরিষ্কার হবার জন্যে, তুমি কর অপরিষ্কার হবার জন্যে। ভুল বললাম?’
আমি জবাব দিলাম না। ফুপাকে শান্ত করার একটা উপায় হচ্ছে তাঁর কোন প্রশ্নের জবাব না দেয়া। কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় ক্লান্ত হয়ে চুপ করে যান।
‘হিমু!’
‘জ্বি।’
‘তুমি নিজে একটা বদ্ধ উন্মাদ। তোমার দেখাদেখি আমার ছেলেটাও উন্মাদ হচ্ছে। মানুষ ভালটা কখনো শেখে না, মন্দটা শেখে। এই যে তুমি দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড করেছ—বাদল এই দেখে উৎসাহী হবে।আমি তোমার সঙ্গে একশ টাকা বাজি রাখতে পারি। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই সে মাথা মুড়িয়ে ফেলবে। রাখতে চাও বাজি?’
‘জ্বি না।’
‘রাখতে চাও না কেন? টাকা নেই?’
‘টাকার সমস্যা তো আছেই, তা ছাড়া এ বাজিতে আপনার জিতে যাবার সম্ভাবনা। আমারো ধারণা, বাদল মাথা মুড়িয়ে ফেলবে, ভুরু কামিয়ে ফেলবে।’
ফুপা বিস্মিত হয়ে বললেন, ভুরু কামাবে কেন?’
‘আমি ভুরু কামিয়েছি তো, তাই।’
‘তুমি ভুরু কামিয়েছ!’
‘জ্বি।’
‘I see. হিমু।’
‘জ্বি।’
‘আমি তোমাকে একটা প্রপোজাল দিচ্ছি। মন দিয়ে শোন। দিনে দশ টাকা হিসেবে প্রতি মাসে আমি তোমাকে তিনশ করে টাকা দেব। তার বদলে তুমি এ বাড়িতে আসবে না। রাজি আছ?’
‘ভেবে দেখি।’
‘আচ্ছা যাও ফাইভ হানড্রেড। প্রতি মাসের এক তারিখে আমি নিজে গিয়ে টাকাটা তোমার হাতে দিয়ে আসব। বাট ইউ গট টু প্রমিজ যে এই বাড়ির দু’হাজার গজের ভেতর তোমাকে দেখা যাবে না।’
‘ঠিক আছে।’
‘তুমি তাহলে রাজি?’
‘জ্বি রাজি।’
‘প্রতিজ্ঞা করছ?’
‘করছি।’
‘আজ হচ্ছে মাসের কুড়ি তারিখ। তুমি দশদিনের টাকা পাবে। মাসে পাঁচশ হলে দশ দিনে হল ১৬৬ টাকা ৬৬ পয়সা।’
ফুপা মানিব্যাগ বের করলেন। টাকা বের করার আগেই বাদল ঢুকল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ত্রিশটা টাকা দাও তো বাবা।
‘কেন?’
‘দুই কেজি বরফ আনব। দশ টাকা করে কেজি। দশটাকা রিকসা ভাড়া।’
‘কেন?’
‘হিমুদা গোসল করবে। দুই কেজি বরফ এনে ছেড়ে দেব। ডিপ ফ্রীজে একদানা বরফ নেই।’
ফুপা কোন কথা না বলে বাদলে হাতে ত্রিশটা টাকা দিলেন এবং গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত।
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘কে বলবে তোমার সঙ্গে মেশার আগে আমার এই ছেলে বুদ্ধিমান ছিল?’
‘বুদ্ধি এখনো আছে ফুপা।’
ফুপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বিড় বিড় করে বললেন, মানুষের ব্রেইন পুরোপুরি অকেজো করে দেয়ার ক্ষমতা কোন সহজ ক্ষমতা না। সবাই পারে না। তুমি পার।
‘ওর ব্রেইন নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না ফুপা। ওর ব্রেইন ভাল।’
‘ব্রেইন ভাল? ব্রেইন ভালর নমুনা শুনবে? গতমাসে কি করল শোন—বাড়ির পেছনে একটা সজনে গাছ আছে না? এক সন্ধ্যে বেলা দেখি সজনে গাছ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে দেখলাম। নিচে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি? সে দাঁত বের করে বলল, গাছের ইলেকট্রন নিয়ে নিচ্ছি। আমি বললাম, গাছের ইলেকট্রন নিয়ে নিচ্ছিস মানে? গাছের ইলেকট্রন নিতে তোকে কে বলেছে? সে চোখ বড় বড় করে বলল—হিমুদা শিখিয়েছে।এই ছেলের ব্রেইন তুমি ভাল বলবে?
আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি। তুমি কেন আমার এত বড় ক্ষতি করছ?’
আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, গাছের ইলেকট্রন নেয়ার ব্যাপারটা আপনাকে আরেকদিন বুঝিয়ে বলব। একবার বুঝিয়ে বললে আপনার কাছে আর তেমন হাস্যকর লাগবে না।
‘আমাকে কিছুই বুঝিয়ে বলতে হবে না। তুমি বিদেয় হও। পাঁচশ টাকা দিচ্ছি, খুশি হয়েই দিচ্ছি। নিয়ে উধাও হয়ে যাও। দয়া করে বাদল বরফ নিয়ে ফিরে আসার আগেই যাও। ওর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ থাকলে—তোমার কাছ থেকে আরো কিছু কায়দা কানুন শিখে ফেলবে। এখন গাছ থেকে ইলেকট্রন নিচ্ছে, পরে হয়তো আগুন থেকে ইলেকট্রন নিতে চাইবে। একটাই আমার ছেলে হিমু…ওনলি সান।’
‘ঠিক আছে ফুপা আমি যাচ্ছি।’
‘থ্যাংকস। মন্ত্রীর ছেলের ব্যাপারটা খোঁজ নিও। ওরা বড় বিরক্ত করছে।’
‘আচ্ছা খোঁজ নেব।’
‘ওসিকে বলবে আর যেন আমাকে বিরক্ত না করে। এক্ষুনি টেলিফোন করে বলে দাও—টেলিফোন নাম্বার তোমার ফুপুর কাছে আছে?’
‘আছে ফূপা, এক্ষুণি টেলিফোন করছি।’
‘এখান থেকে টেলিফোন করার দরকার নেই। কোন দোকান-টোকান থেকে কর। নাও, টেলিফোনের জন্যে পাঁচটা টাকা নিয়ে যাও।’