‘জ্বি না। ফাজলামি করছি না।’
‘শিয়ালের শিং দেখেছেন?’
‘না।’
‘শিয়ালের শিং আমি দেখিয়ে ছাড়ব। মহাপুরষ কত প্রকার ও কি কি বুঝে যাবেন। গর্তে ঢুকে মহাপুরুষ? শুকর গর্তে ঢোকে, মহাপুরুষ না। এই মবিন, মবিন।’
মবিন নামের একজন কেউ ছুটে এল। ওসি সাহেব চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, একটা নাপিত ধরে নিয়ে আস। মহাপুরষের চুল, দাড়ি, ভুরু সব যেন কামিয়ে দেয়। মহাপুরুষগিরি বার করছি। অনেক মহাপুরুষ দেখা আছে—পেনসিল কাটার পাওয়া গেল?
‘জ্বি না স্যার।’
‘না শব্দ আমি শুনতে চাচ্ছি না। খুঁজে বের কর।’
ওসি সাহেবের নাম মোহাম্মদ সিরাজুল করিম। তিনি দেখলাম আসলেই করিৎকর্মা লোক। শুধু যে করিৎকর্মা তাই না, বেশ সাহসীও। নাপিত ডাকিয়ে সত্যি সত্যি দাড়ি গোঁফ ভুবু সবই কামিয়ে দিলেন। হুংকার দিয়ে বললেন, মহাপুরুষের হাতে একটা আয়না দাও। মহাপুরুষ তার চেহারাটা দেখুক।
আমি হাই তুলে বললাম, চেহারা দেখতে চাচ্ছি না। মহাপুরুষদের আয়নায় নিজেকে দেখা নিষেধ আছে।এতে নিজের চেহারার প্রতি এক ধরণের মুগ্ধতা চলে আসে। এটা ঠিক না।
‘ঠিক না হলেও দেখে রাখুন। চেহারা যে অবস্থায় এখন আছে এই অবস্থা থাকবে না। মন্ত্রী সাহেব কি বলেছেন তা তো শুনেছেন? ভালমত জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শুধু মুখের কথায় হয় না। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ কঠিন জিনিস। শরীরের চামড়াটাই শুধু থাকবে—হাড্ডি যা আছে পানি হয়ে পিশাবের সঙ্গে বের হয়ে যাবে।’
‘মহাপুরুষদের প্রতি আপনার অকারণ রাগের কারণটা জানতে পারি? অবশ্যি বর্তমানে আপনার মন অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত। ঘরে অসুস্থ স্ত্রী। প্রিয়জন ভয়াবহ রকমের অসুস্থ থাকলে মনমেজাজ ঠিক থাকে না। সারা পৃথিবীর উপরই রাগ থাকে।
ওসি সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি আসলে আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়েছি। মাঝে মাঝে আমার আন্দাজ খুব লেগে যায়। এটা মনে হচ্ছে লেগে গেছে।
মন্ত্রী দেখার পর ওসি সাহেবের যে অবস্থা হয়েছিল এখনও সেই অবস্থা। মনে হচ্ছে হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। তেলাপিয়া মাছের মত মুখের হা বড় হচ্ছে, ছো্ট হচ্ছে।
ওসি সাহেবের গলার আওয়াজ খানিকটা নিচে নামল। তিনি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আমার স্ত্রী যে অসুস্থ এটা কি করে বললেন?
আমি হাসলাম। জবাব দিলাম না। একজন প্রথম শ্রেণীর ভবিষ্যৎবক্তা কথা বলবেন খুব কম। প্রশ্ন করলে অন্য দিকে তাকিয়ে হাসবেন।
‘তার কি অসুখ সেটা কি বলতে পারবেন?’
‘না আমি তো ডাক্তার না।’
‘তাঁর এই রোগের কোন অষুধ আছে?’
‘অবশ্যই আছে—সৃষ্টিকর্তা এমন কোন অসুখ তৈরি করেন নি যার প্রতিষেধক তাঁর কাছে নেই। আমাকে দয়া করে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমি রোগের অষুধ সম্পর্কে কিছু জানি না।’
ওসি সাহেব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, মহাপুরুষগিরি ফলানোর জায়গা পান না? স্ত্রী অসুস্থ? ভাওতাবাজি পুলিশের কাছে? বয়স তো খুব বেশি মনে হয় না। লোক-ঠকানো কায়দাকানুন সব জানা হয়ে গেছে—মবিন, মবিন।
মবিন চলে এল। মবিনের মুখ হাসি হাসি। কারণ তার হাতে পেনসিল কাটার। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সে খুশি খুশি গলায় বলল, পেনসিল কাটার পাওয়া গেছে।
‘পেনসিল কাটারের এখন আর দরকার নেই। বাবাজীকে হাজতে নিয়ে যাও। ভালমত আদর-যত্ম কর যাতে যতদিন বাঁচে পুলিশের খাতিরের ব্যাপারটা মনে থাকে। চুল দাড়ি কাটানো ঠিক হয়নি। চুল দাড়ি থাকলে আদর যত্মের সুবিধা হত।’
মবিন আনন্দিত স্বরে বলল, চুল দাড়ির কোন দরকার নেই স্যার। দেখেন না কি করি।
মবিন সাহেব কিছু করার সুযোগ পেলেন না।তার আগেই তেল ও জ্বালানী মন্ত্রী মোবারক হোসেন সাহেব আমাকে ছেড়ে দেবার জন্যে টেলিফোন করলেন। জহিরের চাপাচাপিতেই এটা করলেন, বলাই বাহুল্য। আমি যে খুব আনন্দিত হলাম তা না। পুলিশী মার খাবার চেষ্টা আমি অনেকদিন ধরেই করছি। ব্যাপারটা সম্পর্কে শুধু শুনেছি। অভিজ্ঞতাটা হয়ে যাওয়া ভাল। হেলাল গুন্ডা বলে একজনের সঙ্গে আমার খুব ভাল পরিচয় আছে। তার কাছ থেকে শুনেছি মারের সময় ব্যথা পাচ্ছি ভাবলেই ব্যথা পাওয়া যায়। ব্যথা পাচ্ছি না ভাবলে আর ব্যথা পাওয়া যায় না।
আমি থানা থেকে ছাড়া পেলাম রাত তিনটায়। এত রাতে ঢাকায় ফিরলাম না। চলে গেলাম নারায়নগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালে। রাত কাটাবার জন্যে লঞ্চ টার্মিনাল ভাল জায়গা। অনেক খালি লঞ্চ বাঁধা থাকে। চুপিচুপি চলে যেতে হয় ছাদে। চাদর মুড়ি দিয়ে টানা ঘুম দিলেই হয়।
লঞ্চের লোকজন এলে ভাববে তাদের কেউ।
আমার সঙ্গে চাদর আছে। শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়া কোন সমস্যা না।
তাই করলাম। ঘুম ভাঙল ভোর রাতে। লঞ্চ চলছে। কখন যাত্রী উঠল, কখন লঞ্চ ছাড়ল কে জানে? হু হু বাতাসে রীতিমত শীত ধরে গেছে। আকাশে থালার মত বড় চাঁদ। নদীর দু’পাশে গাছপালা চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এরা সবাই জেগে আছে। উথাল পাথাল জোছনায় গাছপালা ঘুমুতে পারে না। ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ। আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে চাঁদের আলো থেকে নিজেকে আলাদা করে ঘুমুতে গেলাম।
ঘুম আসছে না। বারবারই মনে হচ্ছে একটা ছোট ভুল করা হয়েছে। ঢাকা ছাড়ার আগে রুপার সঙ্গে দেখা করে আসা দরকার ছিল। ঢাকার বাইরে যতবারই যাই, এই কাজটা করি। এইবারই শুধু করা হল না। মানুষের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা থাকলে চমৎকার হত। লঞ্চের ছাদ থেকে রুপার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করা যেত।
‘হ্যালো, হ্যালো রুপা?’
‘তুমি!তুমি কোথায় এখন?’
‘লঞ্চের ছাদে।’
‘লঞ্চের ছাদে মানে? লঞ্চে করে যাচ্ছ কোথায়?’
‘জানি না।’
‘কি পাগলের মত কথা বলছ? তুমি লঞ্চে করে যাচ্ছ আর তুমি জান না কোথায় যাচ্ছ?’
‘আমরা কে কোথায় যাচ্ছি কেউই তা জানি না।’
‘আবার ফিলসফি শুরু করলে? শোন দার্শনিক, এগুলি নিতান্ত নিম্নশ্রেণীর ফিলসফি। পাঁচ হাজার বছর ধরে কপচানো। সত্যি করে বল তো কোথায় যাচ্ছ?
‘জানি না।’
‘জান না?’
‘না। জগতের পরম সত্য কি জান রুপা? জগতের পরম সত্য হচ্ছে—জানি না, I don’t know. এই ফিলসফিটা কেমন লাগল?’
ঘুম এসে যাচ্ছে। কাল্পনিক কথাবার্তা আজকের মত থাক। লঞ্চটা বড্ড দুলছে। রেলিং দেয়া নেই। গড়িয়ে পড়ে না গেলেই হয়।
দরজার ওপাশে – ০৩
সাতদিন পর ঢাকায় ফিরলাম। মানুষের মাথার চুল সাতদিনে ১.৫ মিলিমিটার বাড়ে। দাড়ি, গোঁফ এবং ভুরুর চুলও একই হারে বাড়ার কথা। ব্যাপার মনে হচ্ছে তা না। সাতদিনে আমার দাড়ি-গোঁফ কিছু গজিয়েছে। মাথার চুল তেমন গজায়নি। ভুরুর চুলের বৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আগে যা ছিল এখনো তাই। আমার চেহারায় এক ধরণের ভৌতিক ভাব চলে এসেছে। ভৌতিক ভাবের জন্যে গায়ের চাদরও বোধহয খানিকটা দায়ী।
চেহারায় ভৌতিক ভাব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি গত রাতে। স্টিমারে করে ফিরছি। ফার্স্টক্লাসের ডেক কেমন দেখার জন্যে উকি দিলাম। ডেক ফাঁকা। অল্পবয়েসী এক মা তার বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে। বাচ্চাটা হাত-পা ছুঁড়ছে এবং বিকট চিৎকার করছে। বাচ্চার বাবা বিব্রত মুখে এক গ্লাস পানি হাতে পাশে দাঁড়ানো। আমাকে দেখে বাচ্চা চোখ তুলে তাকাল। আর ঠিক তখন বাচ্চার মা নিচু গলায় বলল, ‘‘চুপ কর সোনা। চুপ না করলে ঐ ভূত তোকে খেয়ে ফেলবে।’’
বাচ্চা চুপ করে গেল। আতংকগ্রস্ত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম, এবং গম্ভীর গলায় বললাম, আমি স্টিমারের দোতলায় আছি—বাচ্চা কান্নাকাটি করলে খবর দেবেন, এসে ভয় দেখিয়ে যাব। বাচ্চার মা লজ্জিত মুখে বলল, সরি সরি। কিছু মনে করবেন না।
‘না কিছু মনে করি নি। আপনার বাচ্চা যথেষ্ট ভয় পেয়েছে কি-না দেখুন। প্রয়োজন মনে করলে আরো খানিকটা ভয় দেখিয়ে যাই।’
মেয়েটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মেয়েটা দেখতে খানিকটা রুপার মত।
ইচ্ছা করছিল আরো খানিকক্ষণ থাকি—সম্ভব হল না। বাচ্চাটা বেশি ভয় পেয়েছে। ভয়ে হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। আমাকে যে ভয়াবহ দেখাচ্ছে তার আরো প্রমাণ পেলাম। সেকেন্ড ক্লাসে অন্য একটি বাচ্চা, তিন চার বছর বয়স হবে, আমাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করল। এই বাচ্চাটি ছিল বাবার কোলে। সেই ভদ্রলোক বিব্রত গলায় বলতে লাগল—আহা, উনি কিছু করবেন না তো। কিচ্ছু করবেন না।