দুপুর দু’টা, চৈত্র মাসের দুপুর দু’টা কারো বাড়িতে যাবার উৎকৃষ্ট সময় নয়। তারপরেও যাচ্ছি কারণ অসময়ে মানুষের বাড়িতে উপস্থিত হবার অন্য রকম মজা আছে। আমি অল্প যে কটি বাড়িতে যাই, ইচ্ছা করে অদ্ভুদ অদ্ভুদ সময়ে উপস্থিত হই। জহিরদের বাড়িতে একবার রাত দেড়টায় উপস্থিত হলাম। জহিরের বাবা তখনও মন্ত্রী হননি। হব হব করছেন এমন অবস্থা। কলিংবেল শুনে হবু মন্ত্রী ব্যারিস্টার মোবারক হোসেন ভীতমুখে নিজেই নেমে এলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। দু’জন কাজের লোক। তিনি হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে? হু আর ইউ?
আমি বিনীতভাবে বললাম, আমার ডাক নাম হিমু। ভাল নাম হিমালয়। স্যার ভাল আছেন?’
তিনি উত্তেজনায় দু’ইঞ্চির মত লম্বা হয়ে বললেন, আই সি। ব্যাপারটা কি?’
‘জহির আছে? আমি জহিরের বন্ধু। ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’
ব্যারিষ্টার সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর ছেলের যে এই জাতীয় বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে তাই তাঁর মাথায় ঢুকছে না। অধিক শোকে পাস্তুরীভুত অবস্থা।
‘তুমি জহিরের বন্ধু?’
‘জ্বি চাচা। খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা ঢাকা কলেজে একসঙ্গে পড়েছি?’
‘আই সি।’
আমি মুখের বিনয়ী ভাব সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে ব্যারিষ্টার সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, চাচী ভাল আছেন? উনি সঙ্গে সঙ্গে একটু দুরে সরে গেলেন। জহিরের বাবা বললেন, এত রাতে কী ব্যাপার?’
‘ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘রাত ক’টা বাজে জান?’
‘ওয়ান ফর্টি। রাত একটা চল্লিশে কেউ কারোর বাড়িতে অকারণে আসে আমার জানা ছিল না।’
‘অকারণে আসিনি স্যার—অনেকদিন দেখা হয় না। ও ভাল আছে তো?’
‘হ্যাঁ ভাল আছে। তোমার নাম কি যেন বললে? এভারেস্ট?’
‘জ্বি না, এভারেস্ট না। হিমালয়। বাবা শখ করে রেখেছিলেন। উনার ইচ্ছা ছিল আমি হিমালয়ের মত হই। হা হা হা।’
‘শোন হিমালয়, এখন বাসায় যাও। আমার ধারণা, তুমি নেশা টেশা করে এসেছ। নেশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে হৈ চৈ করে লাভ নেই বলে চুপ করে আছি। জহিরের সঙ্গে দেখা করতে হলে সকালে বা বিকেলে আসবে। আন আর্থলি টাইমে অাসবে না। মনে থাকবে?’
‘জ্বি স্যার মনে থাকবে।’
আমি পা ছুঁয়ে সালাম করবার জন্যে নিচু হলাম। দু’জনিই খানিটা সরে গেলেন। ঠিক তখন, ‘‘কার সঙ্গে কথা বলছ মা?’’ বলতে বলতে জহিরের ছোট বোন তিতলী এসে দাঁড়াল। আমি হাসিমুখে বললাম, তিতলী ভাল আছ? এখনও ঘুমাওনি? একটা চল্লিশ বাজে। তিতলীও তার বাবা-মা’র মত কিংবা তাদের চেয়েও রকম চমকাল। কারণ সে আমাকে চেনে না, দেখেনি কোনদিন।আমি জহিরের কাছ থেকে ওর নাম জানি। চেহারায় মিল দেখে আন্দাজে তিতলী বললাম। একটা পুরো পরিবারকে হকচকিয়ে দেবার মধ্যে আনন্দ আছে। জহিরদের পরিবার নিয়ে এ জাতীয় আনন্দ আরো কয়েকবার পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তা সম্ভব হয়নি। কারণ ঐ ঘটনার ছ’মাসের মধ্যে জহিরের বাবা মন্ত্রী হয়ে গেলেন।
কিছু কিছু লোক মন্ত্রী-কপাল নিয়ে জন্মায়। জিয়া, এরশাদ যেই থাকুক, এরা মন্ত্রী হবেই। জহিরের বাবা এরকম একজন ভাগ্যবান মানুষ। মন্ত্রীদের বাড়ি রাত দেড়টা বা দু’টোর সময় যাওয়া সম্ভব না। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে বাঁশডলা দেবে। দুপুরের দিকে যাওয়া যায়। এই সময় দর্শনার্থীর ভীড় থাকে না। তবে দুপুরে ঢুকলেও সরাসরি বাড়িতে যাওয়া যায় না। গেটে পুলিশের কাছে স্লিপ দিতে হয়। সেই স্লিপ একজন ভেতরে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার কাজটা করে নিতান্তই অনিচ্ছায়। যেন সে হাঁটা ভুলে গেছে। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে নতুন হাঁটা শিখছে।
জহিরের আচার আচরণ, ভাবভঙ্গি কোনটাই মন্ত্রীর ছেলের উপযোগী নয়। কোন কালেও ছিল না। বোহেমিয়ান ধরণের ছেলে। ঘর-পালানো রোগ আছে। কোন কারণ ছাড়াই দেখা যাবে হঠ্যাৎ একদিন হাঁটা ধরেছে। কোনবারই নিজ থেকে ফিরে না। লোকজন পাঠিয়ে ধরিয়ে আনতে হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়। তবে বছর কয়েকের মধ্যে পালায়নি। রোগ সম্ভবত সেরেছে। তাকে দেখলাম গেটের পুলিশ দু’জনের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। মুখভর্তি পান। চিবুক গড়িয়ে পানের রস পড়ছে। আমি কোন একটা মজার গল্পের মাঝামাঝি উপস্থিত হলাম। পুলিশ দু’জন অত্যন্ত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে লাগল। চাদর গায়ে মন্ত্রীদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা সম্ভবত নিষেধ। দু’জন পুলিশই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার চাদরের দিকে। জহির পানের পিক ফেলে উঠে এল। আমাকে হাত ধরে রাস্তার ও-পাশে নিয়ে নিচু গলায় বলল, কি কাজে এসেছিস চট করে বলে চলে যা দোস্ত। বাবা এসে যদি দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছি, সর্বনাশ হয়ে যাবে। পুলিশের সঙ্গে মাঝে মধ্যে আড্ডা দেই। এতেই বাবা সারাক্ষণ নাইনটি নাইন হয়ে থাকে। বাড়িতে তোর পজিশন পুলিশের চেয়েও খারাপ। মন্ত্রী হবার পর বাবার মেজাজ যা হয়েছে। আমাকে দেখতেই পারে না। শুল কিভাবে বানানো যায় এই কায়দা জানা থাকলে বাবা নিজেই কাঠমিস্ত্রি ডাকিয়ে একটা শুল বানিয়ে রাখত। সকাল বিকাল আমাকে শুলে চড়াত। লাইফ হেল হয়ে যাচ্ছে দোস্ত।
‘বাসায় তোর অবস্থা তাহলে কাহিল?’
‘কাহিল বলে কাহিল—‘Gone’ অবস্থা।’
‘কাজকর্ম কিছু করছিস?’
‘কাজকর্ম জানি যে করব? কাগজে কলমে এক প্লাস্টিক কোম্পানির এ্যাডভাইজার। মাসে দশ হাজার টাকা দিয়ে যায়। তাও আমার কাছে না—বাবার কাছে।
‘তুই প্লাস্টিক কোম্পানির এ্যাডভাইজার? কি এ্যাডভাইজ করিস?’
‘আরে দূর দূল, কি এ্যাডভাইজ করব?আমি প্লাস্টিকের জানি কি? সকালবেলা ওদের গাড়ি এসে নিয়ে যায়। আমার একটা ঘর আছে,ঐখানে বসে তিন চার কাপ কফি খাই, চলে আসি। এখন বল দোস্ত কি জন্যে এসেছিস? টাকা ধার চাইতে এলে কিচ্ছু করতে পারব না। হাতে একটা ফুটো পয়সাও নাই। বিশ্বাস কর। বন্ধুবান্ধবরা আসে—চাকরি বাকরি নাই—বড় মায়া লাগে। চাকরির ব্যবস্থা তো দূরের কথা, ঘরে নিয়ে যে এককাপ চা খাওয়াব সেই উপায় নেই…আমার কোন বন্ধুবান্ধব ঘরে ঢুকতে পারবে না। বাবার হুকুম। কি জন্যে এসেছিস তাড়াতাড়ি বলে চলে যা দোস্ত। বাবা যে কোন সময় চলে আসবে। আজকাল তিনটার সময় আসে। দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে আবার বিদায়। তিনটা বোধহয় বাজে। তুই কোন সুপারিশ নিয়ে আসিসনি তো?’
‘না।’
‘বাঁচালি। বন্ধুবান্ধব কেউ এলেই বুকে ধাক্কা লাগে। মনে হয সুপারিশ নিয়ে এসেছে। তোর ব্যাপারটা কি?’
আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম, এক জায়গায় যাবি আমার সাথে?’
‘কোথায়?’
‘জায়গাটার নাম ড্রেজার কলোনী। নারায়নগঞ্জের কাছাকাছি।’
‘সেখানে কি?’
‘খুব ইন্টারেস্টিং জায়গা। ড্রেজার দিয়ে নদী খুঁড়ে সেই বালি জমা করে কলোনী বানানো হয়েছে। চারদিকে চিক চিক করছে বালি। চাঁদের আলো যখন সেই বালিতে পড়ে—অসাধারণ দৃশ্য! আজ আবার পূর্ণিমা পড়ে গেল।’
‘বলিস কি?’
জহিরের চোখ চকচক করতে লাগল। আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ইন্টারেস্টিং একটা প্লান করে রেখেছি। রফিককে তো চিনিস। ও থাকে ড্রেজার কলোনীতে। রফিক নদীর কাছাকাছি দু’টা গর্ত খুঁড়ে রাখবে। গলা পর্যন্ত হাইটে গর্ত। আমরা দু’জন গর্তে ঢুকে বসে থাকব। ঠেসে বালি দেয়া হবে। শুধু দু’জনের মাথা বের হয়ে থাকবে।
জহিরের চোখের ঝকঝকে ভাব আরো বাড়ল। কয়েকবার ঢোঁক গিলল। তার ঢোঁক গেলা মাছের টোপ গেলার মত। সে ফিসফিস করে বলল, এক্সাইটিং হবে বলে মনে হচ্ছে।
আমি গলার স্বর আরো নিচু করে বললাম, অবশ্যই এক্সাইটিং। তাছাড়া জিনিসটাও খুবই সায়েন্টিফিক।
‘এর মধ্যে সায়েন্টিফিক আবার কি?’
‘পুকুরে গোসল করার সময় আমরা কি করি? সারা শরীর পানিতে ডুবিয়ে মাথা বের করে রাখি। এখানেও তাই করব। সারা শরীর মাটিতে ডুবিয়ে মাথা বের করে রাখব।’
‘তাতে লাভ কি?’
‘মাটির সঙ্গে একাত্মতা।’
‘এটা কি তোর অরিজিনাল আইডিয়া?’
‘না, এই আইডিয়া ধার করা। জগদীশচন্দ্র বসু এই জিনিস করতেন। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে যখন বেড়াতে যেতেন তখনি পদ্মার চরে গর্ত খুড়ে মাথা বের করে পড়ে থাকতেন। তাঁর ধারণা, এত শরীরে বায়োকারেন্ট তৈরি হয়। সেই বায়োকারেন্টের অনেক উপকারী দিক আছে।’
জহির আরো দু’বার ঢোঁক গিলে ফিসফিস করে বলল, ইন্টারেস্টিং হবে তো?
‘অবশ্যই ইন্টারেস্টিং। কল্পনায় দৃশ্যটা দেখ। ধূ ধূ করছে বালি। মাথার উপরে পূর্ণ চন্দ্র। জোছনার বান ডেকেছে। কোথাও জনমানব নেই। চাঁদের আলোয় শুধু দু’টা মাথা দেখা যাচ্ছে।
‘দু’টা মাথা না, একটা মাথা। শুধু তোরটা দেখা যাচ্ছে। আমি গর্তে ঢুকব না। ঘটনাটা কোন কারণে লিক হয়ে পড়লে বাবা সত্যি সত্যি আমাকে গর্তে ঢুকিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিবে। মাথা বের করে রাখার কনসেশান দেবে না। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। তবে আমি অবজার্ভার হিসেবে থাকব। চল যাই।’