বাদলের ঘরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের সামনে সে পদ্মাসন হয়ে বসে আছে। তার পরণে গেরুয়া চাদর।
‘হচ্ছে কি এসব?’
‘মনটা স্থিতি করার চেষ্টা করছি। তুমি বলেছিলে না—মন বিক্ষিপ্ত হলে প্রদীপের দিকে তাকিয়ে মন স্থিতি করা যায়।’
‘বলেছিলাম নাকি।’
‘কি আশ্চার্য! না বললে আমি জানব কোথেকে?’
‘মন কি খানিকটা স্থিতি হয়েছে?’
‘বুঝতে পারছি না হিমুদা। এসো ঘরে এসো।’
‘তোর সাধনায় বিঘ্ন হবে না তো?’
‘কি যে তুমি বল।’
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমি বললাম, কাট-আউট তুই-ই চুরি করেছিস?
বাদল বিস্মিত হয়ে বলল, কি করে বুঝলে? ও আচ্ছা, তুমি তো বুঝবেই। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার না করলে প্রদীপের আলো স্পষ্ট বোঝা যায় না। এইজন্যেই কাট-আউট খুলে ড্রয়ারে রেখেছি। ভাল করিনি হিমুদা?
বাদল উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ঠিকই আছে। শুনলাম তুই আমেরিকা যাচ্ছিস? বাদল হাসল।
‘কি পড়বি সেখানে?’
‘আমেরিকা গেলে তবে তো পড়বে?’
‘যাচ্ছিস না?’
‘তুমি পাগল হলে হিমুদা? আমি আমেরিকা যাব কেন?’
‘তাহলে যাওয়া হচ্ছে না?’
‘অফকোর্স না এম্নিতে অবশ্যি কাউকে কিছু বলছি না। সবাই ভাবছে আমি যাচ্ছি। কাজেই আমাকে কেউ ঘাটাচ্ছে না। যা ইচ্ছা করতে পারছি। হিমুদা, আমি এইখানেই থাকব।’
‘ফুপা-ফুপু মনে কষ্ট পাবেন।’
‘আমি চলে গেলে আরো কষ্ট পাবেন।’
‘তা ঠিক। তবে নিজের জীবন নিয়ে ওতো ভাবতে হবে। বড় হয়ে কি করবি?’
‘তুমি যা করছ আমি তাই করব। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। হিমুদা, এখন তুমি আমাকে মন স্থিতি করার কৌশলটা ভালমত শিখিয়ে দাও। প্রদীপটা শুধু কাঁপছে। দরজা জানালা বন্ধ করে দেব। পদ্মসনটা কি ঠিকমত হয়েছে?’
‘সবই ঠিক আছে। দরজা খোলা রাখাই ভাল। এতে শরীর ঠাণ্ডা থাকবে। ফ্যান বন্ধ করে দে।’
‘চাদরটা খুলে খালি গা হব?’
‘রেশমী কাপড় গায়ে থাকলে ভাল? তোর মটকা পাঞ্জাবি আছে না? ঐ একটা পরে নে।’
‘ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে হিমু দা। তুমি না এলে কি যে হত।’
‘তুই সাধনা চালিয়ে যা।আমি ফুপার সঙ্গে দেখা করে আসি।’
‘না না, তুমি এখানে বস।’
‘এখানে বসলে হবে কি করে? তুইতো এখন সাধনা করবি।’
‘ও আচ্ছা, তাও তো কথা। আচ্ছা তুমি যাও।’
যা ভেবেছিলাম, তাই। বড় ফুপা পানের যাবতীয় আয়োজন নিয়ে ছাদে বসেছেন। আইসবক্সে বরফ। ঝাল মরিচ মাখানো চিনা বাদাম। তিনি বসে আছেন শীতল পাটিতে। ঠিক বসে নেই—আধশোয়া হয়ে আছেন।
‘বস হিমু। তোমার ফুপু চলে যাওয়ার একদিকে ভাল হয়েছে। ক্যাট ক্যাট করে কথা শুনাবে না। মুখ গম্ভীর করে থাকবে না। পুরো বোতল শেষ করলেও কারো কিছু বলার নেই।
‘পুরো বোতল শেষ করবেন?’
‘না। শরীরে সহ্য হয় না। পাঁচ পেগের বেশি এখন আর পারি না। এর কম হলে ঘুমের অসুবিধা হয়। বেশি হলে বমি বমি ভাব গয়।’
‘আপনি কি নিয়মিতই পাঁচ করে চালাচ্ছেন?’
‘কাল একটু বেশি হয়ে গেল। দশ ক্রস করে ফেললাম। তারপর বমি টমি করে কেলেংকারী অবস্থা। তবে কাল ঘুম খুব ভাল হয়েছিল। এক ঘুমে রাত কাবার। এখন বল হিমু তুমি কেমন আছ?’
‘ভাল।’
ফুপা গ্লাসে লম্বা চুমুক দিতে দিতে বললেন,নেশাটা ঠিকমত ধরুক, তারপর হায়ার ফিলসফি নিয়ে আলাপ করব। মনের তরল অবস্থায় হায়ার ফিলসফি নিয়ে আলাপ করতে ভাল লাগে। আচ্ছা, তুমি কি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর কবিতা পড়েছ?
‘না।’
‘আমিও পড়ি নি। শুনেছি—উনি মদ্যপান নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা লিখেছেন। ভাল কাজ করলেও লোকে ভাল কথা বলে না। মদ্যপান তো কোন ভাল কাজ না। এই নিয়েও একটা লোক ভাল বলবে ভাবাই যায় না। পড়ে দেখা দরকার। কি বল হিমু?’
আপনি দেখি অতি দ্রুত চালিয়ে যাচ্ছেন ফুপা।’
‘প্রথম তিনটা অতিদ্রুত খেতে হয়। তারপর স্লো। স্টিডি হয়ে যেতে হয়। এটাই নিয়ম।’
‘আজকে আপনি পাঁচের ভেতর থাকবেন, না সীমা অতিক্রম করবেন?’
‘তোমার ফুপু নেই। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে হা হা হা –সীমা অতিক্রম করার আনন্দ আছে হিমু। আনন্দ আছে বলেই সবাই সীমা অতিক্রম করতে চায়। অবশ্যি আমাদের হলি বুকে সীমা অতিক্রম করতে নিষেধ করা হয়েছে। হা হা হা।’
‘আপনি শুধু শুধু হাসছেন ফুপা।’
‘শুধু শুধু হাসছি না-কি? যা ভাবছ তা না। এখনো নেশা হয়নি। আনন্দে হাসছি। তোমার ফুপু বাড়িতে নেই এই জন্যেই আনন্দ বোধ হচ্ছে। আই হেই দিস উইম্যান। সারা জীবন হেট করেছি, মুখে কখনো বলিনি। ভদ্রতা করে বলিনি। আজ তোমাকে বললাম।’
আমি তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে অন্ধকারেও ফুপার চোখে চকচক করছে। বিড়ালের চোখের মত জ্বলছে।
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘মাঝে মাঝে ঐ মহিলাকে আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমাকে খুশি করার জন্য সে আবার কখনো কখনো আহ্লাদী ধরনের কথা বলে। আমি মনে মনে বলি, “চুপ হারামজাদী”। কিন্তু বাইরে এমন ভাব দেখাই যেন বড় আনন্দিত।’
‘ফুপু কি আপনাকে পছন্দ করেন?’
‘কে জানে করে কি-না। হু কেয়ারস? বুঝলে হিমু, আমার জীবনটা আমি নষ্ট করে ফেলেছি।তেইশ বছর এমন একজন মহিলার সঙ্গে কাটালাম যাকে আমি সহ্যই করতে পারি না।’
‘ফুপা আর খাবেন না। আপনি ঠিকমত কথা বলতে পারছেন না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।’
কথা জড়ালে কিছু যায় আসে না। কি বলছি তা বুঝতে পারছ তো? বুঝতে পারলেই হল। একটু সরে বস। হঠাৎ করে বমি-টমি হয়ে যেতে পারে। কি যেন তোমাকে বলছিলাম—কি পরিমাণ ঘৃণা তোমার ফুপুকে করি সেটা ব্যাখ্যা করছিলাম। উদাহরণ দিলে তুমি বুঝবে। উদাহরণ না দিলে বুঝবে না। চার বছর আগের কথা। অফিসে গেছি, রিনকি কাঁদতে কাঁদতে টেলিফোন করেছে। ডিম ভাজতে গিয়ে না-কি তার মার শাড়িতে আগুন লেগে গেছে। সমস্ত শরীর পুড়ে গেছে। খবরটা শুনে এমন একটা আনন্দ হল, তোমাকে কি বলব হিমু। বারবার মনে হতে লাগল, আপদ গেছে, আপদ গেছে। বাঁচলাম, বাঁচলাম। ভাগ্যিস মানুষের মনের কথা কেউই বুঝে না। মনের কথা বুঝতে পারলে বিরাট কেলেংকারী হয়ে যেত। মনের কথা বুঝতে পারে না বলে কেউ কিছু বুঝল না। আমি এমন একটা ভাব করলাম যে মনের দুঃখে মারা যাচ্ছি। সারা রাত না ঘুমিয়ে তোমার ফুপুর পাশে বসে থাকি। হা-হা-হা।’
‘ফুপা।’
‘বল।’
‘বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লে কেমন হয়? আপনি যেভাবে মাথা দুলাচ্ছেন তাতে মনে হয়…’
‘মাতাল হয়ে গেছি বলে ভয় পাচ্ছ? মোটেই না। মাতাল হলে ‘ডাবল-ভিসন’ হয়। সব জিনিস দুটা করে দেখা যায়। আমি কিন্তু একটাই হিমু দেখতে পাচ্ছি। ওনলি ওয়ান হিমু। বড় আনন্দ লাগছে। সত্যি কথা বলার আনন্দ।’
‘আপনি কিন্তু ফুপা সত্যি কথা বলছেন না?’
‘সত্যি বলছি না।’
‘এক বিন্দুও না। ফুপুর গা যখন আগুনে পুড়ে গেল তখন আপনি ভয়ংকর মন খারাপ করেছিলেন।’
‘তোমার তাই ধারণা?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওটা ছিল অভিনয়। আমি তোমাদের আসাদুজ্জামান নুরের চেয়ে অনেক ভাল অভিনয় জানি। ওই ছাগলা দাড়িকে আমি অভিনয় শেখাতে পারি। হা-হা-হা।’
‘আপনি তাহলে জেনে শুনে এমন ভয়ংকর জীবন যাপন করছেন কেন?’
‘উপায় নেই বলেই করছি।’
‘উপায় যে একেবারে নেই তাই-ই বা বলছেন কেন?’
‘উপায়টা কি?’
‘এক সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাত-মখ ধুবেন। নাশতা খাবেন, চা খাবেন। পরপর দু’কাপ চা, দু’টা সিগারেট। তারপর শিষ দিতে দিতে ঘর থেকে বের হবেন। একটা রিকশা নেবেন। পাঁচ টাকার রিকশা যতদূর যেতে চায় ততদূর যাবেন। তারপর রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করবেন। হাঁটতেই থাকবেন। হাঁটতেই থাকবেন। মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্যে থঅমতে পারেন। কিন্তু কখনোই পেছনের দিকে তাকাবেন না।’
‘কতদিন হাঁটব?’
‘পাঁচ বছর,দশ বছর, কুড়ি বছর। নির্ভর করে কতদিন আপনি বাঁচবেন তার উপর।’
‘হিমু, তুমি আসলেই পাগল। খারাপ ধরনের পাগল। এ ডেনজারাস মেড ম্যান। ডেনজারাস বলছি কারণ তোমার আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘পছন্দ না হবার কারণ নেই ফুপা। এই পৃথিবী, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কোনটাই স্থির না। সব কিছু প্রচণ্ড গতিময়। ইলেকট্রন ঘুরছে নিউক্লিয়াসের চারদিকে, নিউক্লিয়াস ঘুরছে, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরছে। ছায়াপথ ছুটে ছুটে যাচ্ছে। শুধু মানুষ হাঁটা বন্ধ করে দিয়েছে। এক সময় কিন্তু মানুষও ঘুরে বেড়াতো যাযাবরের মত এক জাযগা থেকে আরেক জায়গায় যেত। পাখিদের দেখুন, তারা মহাসমুদ্র উড়ে পার হয়। শীতের দেশ থেকে আসে গরমের দেশে। আবার উড়ে যায় শীতের দেশে। সারাক্ষণই উড়ছে। সমুদ্রের মাছের ঝাঁকও তাই করে। মানুষেরও তাই করা উচিত।’
‘তাই করলে আজকের সভ্যতা, আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কি হত।’
‘এইসবের প্রয়োজন নেই ফুপা?’
‘প্রয়োজন নেই?’
‘না—From dust I have come, dust I will be.’
‘তুমি পাগল হিমু। পাগল। বদ্ধ উন্মাদ।’
‘আমরা সবাই পাগল ফুপা। পৃথিবীটাই একটা ম্যাড হাউস। আমি আজ উঠি, মাথা ধরেছে। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকব।’
‘এক্ষুণি খাবার নিয়ে আসবে।’
‘আসুক। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। মাথা ধরলে আমি কিছু মুখে দিতে পারি না।’
ঘরে ফিরলাম অনেক রাতে। বায়েজীদ সাহেব আমার ঘরের সামনের মোড়ায় একা একা বসে আছেন। আমি বললাম, এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছেন, কি ব্যাপার বায়েজীদ সাহেব?
বায়েজীদ সাহেব নরম গলায় বললেন, একটা ভাল খবর ছিল।এত আনন্দ হচ্ছে, আপনাকে খবরটা না দিয়ে ঘুমুতে পারছি না।
‘মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?’
‘জ্বি। আপনি যেমন বলেছিলেন ঠিক সে রকম ছেলে। চাকরি করে। দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়ায়।’
‘খুব ভাল খবর বায়েজীদ সাহেব।’
‘আপনার জন্যই হয়েছে। ছেলের একটা ছবি আছে আমার কাছে। ছবিটা কি একটু দেখবেন?’
‘অন্য একদিন দেখব। আজ প্রচণ্ড মাথা ধরছে। অবশ্যি ছবি দেখার দরকার নেই। আমি জানি ছেলে সুন্দর। সুন্দর না?’
‘রাজপুত্রের মত ছেলে। সব আপনার জন্যেই হয়েছে। সব আপনার জন্যে। ‘আমি জানতাম হবে। যেদিন আপনাকে বলেছি সেদিনই আমি জানি। মেয়েকে চিঠিও লিখলাম।’
বায়েজীদ সাহেব চোখ মুছছেন।
দুঃখে মানুষ কাঁদে, আবার আনন্দেও কাঁদে।
আনন্দে মানুষ হাসে আবার প্রবল দুঃখেও মানুষ হাসে। এখান থেকে আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি – আনন্দ এবং দুঃখ আলাদা কিছু না?
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, কিছু ভাবতে পারছি না।
বায়েজীদ সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, আপনি শুয়ে থাকুন, আমি একটু হাওয়া করি।
‘আপনাকে কিছু করতে হবে না। দয়া করে আমাকে একা থাকতে দিন।প্লীজ।’
ঘরে কি ঘুমের অষুধ আছে? একগাদা হিপনল খেয়ে শুয়ে থাকব। মাথার যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না।
দরজার ওপাশে – ১০
মাথার যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পেলাম। এই যন্ত্রণা দীর্ঘ দিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। দিন এবং রাত্রির ব্যবধান মুছে গেল। মনে হত সব সময় দিন, সব সময় রাত। মেস থেকে তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিল। হাসপাতালের ওয়ার্ডটি বিশাল। রুগীরা শুয়ে আছে। আমিও তাদের সঙ্গে শুয়ে আছি। স্থান কাল সম্পের্কেও বিভ্রমের মত হল। এই মনে হয় হাসপাতাল , এই মনে হয় হাসপাতাল নয় স্টীমারের খোলা ডেক। সিটি বাজিয়ে স্টীমার চলছে। আমরা খুব দুলছি।
ক্রমাগতই লোকজন আসছে আমাকে দেখতে। এগুলি মনে হয় বিভ্রম। মস্তিষ্ক কল্পনা করে নিচ্ছে। বড় মামাকে একদিন দেখলাম। তিনি আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বিড় বিড় করে বলছেন—একি সমস্যা বাধালি তো। এই দূশ্য অবশ্যই বিভ্রম। বড় মামা মারা গেছেন অনেকদিন আগে।
এক গভীর রাতে রূপাকে দেখলাম। সে রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে—কত কষ্ট করে তোমার ঠিকানা বের করেছি তা কি তুমি জান? আমি তোমাকে হাসপাতালে রাখব না, বাড়িতে নিয়ে যাব।
‘তোমার বাবা-মা—তাঁরা কি বলবেন?’
‘যা বলার বলুক।’
একদিন সেতু এল এক হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে। তার মুখ শুকানো। সে লজ্জিত ও বিব্রত। মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, আপনার টাকাটা নিয়ে এসেছি। এটা কি বালিশের নিচে রাখব?
‘রাখ?’
‘আমি যদি খানিকক্ষণ আপনার বিছানার কাছে বসে থাকি তাহলে কি আপনি রাগ করবেন?’
‘না।’
এই সব দূশ্যের সবই কি কল্পনা? বোঝার কোন উপায় নেই। এক সময় তিতালী এসে উপস্থিত। তার পরণে আকাশী রঙের শাড়ি। হাত ভরতি সবুজ চুড়ি। সে হাতের চুড়ির টুনটুন শব্দ করতে করতে বলল,
‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘পারছি। আপনি তিতালী।’
‘আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি ভাল নেই।’
‘তাই তো দেখেছি। কি রোগা হয়ে গেছেন! কি হয়েছে আপনার?’
‘জানি না কি হয়েছে। সম্ভবত মারা যাচ্ছি। প্রায়ই প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হয়। ইদানীং এর সঙ্গে জ্বর হচ্ছে।’
‘কে দেখছে আপনাকে?’
‘সবাই দেখছে। মেসের একজন ঝি—সে তার দেশ থেকে মাথায় মাখার একটা তেল এনে দিয়েছে। ঐটা মাথায় মাখি। মাথায় মাখলে খুব আরাম হয়।’
‘আপনার আত্মীয়-স্বজনরা আপনাকে দেখছেন না?’
‘দেখছে। সবাই দেখছে। মৃত আত্মীয়স্বজনরাও নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন। আমার বড় মামা তো প্রায়ই রাতে আমার সঙ্গে ঘুমান। ছোট বিছানা, দু’জনের চাপাচাপি হয়। উপায় কি? শুধু বাদল আসছে না। অসুখের সময় ও পাশে থাকলে ভাল লাগতো।’
‘ও কোথায়?’
‘ও আমেরিকা গিয়েছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।’
‘আমি যদি বিছানায় আপনার পাশে কিছুক্ষণের জন্যে বসি আপনি কি রাগ করবেন?’
‘না রাগ করব কেন?’
‘আমার বাবারও মাথা ধরার রোগ আছে। মাথায় যন্ত্রণায় উনি যখন ছটফট করতেন আমি হাত বুলিয়ে দিতাম। বাবার ধারণা, আমি হাত বুলালেই বাবার মাথা-ধরা সেরে যেত। আমি কি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?’
‘না।’
‘আপনি কি আমার বাবার খবর জানেন?’
‘না।’
‘স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে।’
‘আপনার বাবা কি আপিল করেছেন?’
‘আপিল করেছেন।?’
‘আপনি যে খুব শান্ত ভঙ্গিতে ব্যাপারটা গ্রহণ করেছেন তা দেখে আমার ভাল লাগছে।’
‘আমার বাবা আমাকে শান্ত থাকতে বলেছেন। আমি শান্ত হয়ে আছি।’
‘ভাল। খুব ভাল।’
‘আমার ধারণা, আমার বাবা একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।’
‘আপনার ধারণা ঠিক আছে। পৃথিবীতে অশ্রেষ্ঠ মানুষ বলে কিছু নেই। সব মানুষই শ্রেষ্ঠ।’
‘বাবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি কি যাবেন? আপনার শরীর এত খারাপ। আমার বলতে লজ্জা লাগছে।’
‘আমি যাব। অবশ্যই যাব।’
স্বপ্নদৃশ্যগুলিতেও কিছু সত্যি থাকে?’
কারণ পুরোপুরি সুস্থ হবার পর শুনলাম—আসলেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মোবারক হোসেন সাহেবের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আপিল করেছেন, অতে লাভ হয়নি। মার্সি পিটিশন করেছেন। তার ফলাফল এখনো জানা যাচ্ছে না।
একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
মোবারক হোসেন সাহেব খুশি খুশি গলায় বললেন,হিমু কেমন আছ?
‘ভাল।’
‘শুনেছ নিশ্চয় আমাকে ওরা ঝুলিয়ে দিচ্ছে।’
‘শুনেছি।’
‘দিনক্ষণ এখনো ঠিক করেনি। কিংবা কে জানে হয়ত ঠিক করেছে, আমাকে কিছু বলছে না। ও, ভাল কথা, পরে আবার জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাব। তোমার বন্ধুর চাকরিটা কি হয়েছে?’
‘জানি না। আমি খোঁজ নেইনি।’
‘কিছুই জান না?’
‘জ্বি না।’
‘তুমি শুনলে অবাক হবে আমি তোমার ঐ বন্ধুকে একদিন স্বপ্নে দেখলাম? সে আমাকে বলছে—স্যার, একটু দোয়া করবেন আমাদের একটা বাচ্চা হবে। তোমার বন্ধুর সঙ্গে খুব সুন্দর মত একটি মেয়ে। মেয়েটা স্বামীর কথায় খুব লজ্জা পাচ্ছে। আমি তোমার ঐ বন্ধুকে কোনদিন দেখিনি, কিন্তু স্বপ্নে সঙ্গে চিনে ফেললাম।’
মোবারক হোসেন সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, আপনি কেমন আছেন?’
মোবারক হোসেন সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, বুঝতে পারি না। কিছুই বুঝতে পারি না। হিমু!
‘জ্বি।’
‘আমার মাথাটা বোধহয় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে—আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছে সেখান থেকে একশ’গজ দুরে জেলখানার ফাঁকা মাঠ। মাঝে মাঝে কয়েদীরা সেই মাঠে ফুটবল খেলে। একরাতে কি হয়েছে জান? হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানলার শিক ধরে মাঠটার দিকে তাকালাম। দেখি কি জান? মাঠটার মাঝখানে একটা গাছ। বেশ বড় একটা গাছ। চারদিক ধু ধু করছে। আর কিছুই নেই। গাছ কোথেকে এল বল তো?’
তিনি আমার জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিছু গলায় বললেন, তোমাকে কয়েকটা জরুরী কথা বলার জন্যে ডেকেছিলাম। জরুরী কথাগুলি একটাও এখন মনে পড়ছে না।জহির সম্পর্কে কি যেন বলতে চাচ্ছিলাম মনে করতে পারছি না। জহির তোমার ভাল বন্ধু ছিল, তাই না হিমু?’
‘জ্বি।’
‘সে ছেলে কেমন ছিল বল তো?’
‘সে অসাধারণ একটি ছেলে।’
মোবারক হোসেন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, অতি খারাপ মানুষ হয়েও অসাধারণ একটি ছেলের জন্ম দিয়েছি। এই তো কম কথা না, কি বল?
‘তা তো ঠিকই।’
‘তুমি চলে যাও হিমু বেশিক্ষণ কথা বলতে ভাল লাগে না।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মোবারক হোসেন সাহেব বললেন, তোমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেছে হিমু। স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখবে। রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করবে না।
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘আমি জেল কর্তৃপক্ষকে বলে রেখেছি ফাঁসির দিন-তারিখ হলে তোমাকে যেন জানানো হয়, যেন তোমাকে এই দৃশ্যটা দেখার অনুমতি দেয়া হয়। তুমি একবার বলেছিল তোমার খুব শখ এই দৃশ্য দেখার। এরা আমার এই অনুরোধ হয়ত রাখবে।’
আমি চুপ করে রইলাম। তিনি নিচু গলায় বললেন, তোমার জন্যে সামান্য কিছু হলেও করতে পারছি এই জন্যে একটু ভাল লাগছে। তুমি কি চলে যাবার আগে কিছু বলবে? সান্ত্বনার কোন বাণী?
আমি নিচু গলায় বললাম, Dust we will be.
‘কি বললে?’
‘কিছু বলিনি চাচা।’
‘আচ্ছা যাও। তোমাকে অনুমতি দিলে চলে এসো, কেমন? আচ্ছা হিমু, আজ কি পূণিমা? তুমি তো আবার চন্দ্র-সূর্যের হিসাব খুব ভাল রাখ।’
‘আজ পূণিমা না।’
‘শুনেছি এরা ফাঁসি দিনের বেলায় দেয়। ভোরবেলা। ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে ওদের যদি বলি—আমার বেলায় নিয়মের ব্যতিক্রম করে যদি রাতে করে তাহলে কেমন হয়। ভরা পূণিমার রাতে। তাহলে কি ব্যাপারটা আরেকটু ইন্টারেস্টিং হবে না?’
‘চাচা যাই?’
‘আচ্ছা যাও। আমার কতাবার্তায় কিছু মনে করো না। আজকাল কি বলি না বলি তার হিসাব রাখতে পারি না।’
দরজার ওপাশে – ১১ (শেষ)
জেল কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়েছি। বিশেষ বিবেচনায় তাঁরা মোবারক হোসেন সাহেবের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন। আমাকে আগামীকাল ভোর চারটায় যেতে বলা হয়েছে। ডিআইজি প্রিজন আমাকে একটি পাস দিয়েছেন। এটা দেখালেই জেলখানায় আমাকে ঢুকতে দেবে।
আমি কি যাব দেখতে?
অবশ্যই যাব। আমাকে যেতে হবে। এই নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা প্রকৃতি নিজের হাতে করেছে। একে অগ্রাহ্য করার পথ কোথায়?