‘খানিকক্ষণ রাস্তায় না হাঁটলে আমার ঘুম আসে না মামা। তুমি শুয়ে পড়। আমি খানিকক্ষণ হেঁটে আসি।’
‘হাঁটাহাঁটির একমাত্র অষুধ বিবাহ। বিয়ের পর দেখবি হাতি দিয়ে টেনেও তোকে বউয়ের কাছ থেকে সরানো যাবে না। বাহিরমুখী পুরুষ বউ অন্তপ্রাণ হয়, শাস্ত্রকথা …।’
পথে নেমেই মনে হল সেতু মেয়েটির সঙ্গে আজ দেখা হবে। সে কিছু টাকা ফেরত দেবার জন্য পথে পথে ঘুরছে।
অনেকক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। দেখা হল না। একটা ষোল-সতেরো বছরের ছেলে এসে একসময় জিজ্ঞেস করল, স্যার কাউরে খুঁজেন? আমি বললাম, না। সে বয়স্কদের মত ভারী গলায় বলল, একটা ভাল জায়গা আছে , যাইবেন?
‘না।’
সে তবু পেছন ছাড়ল না। আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ঠিক পাশাপাশি না, খানিকটা দূরত্ব রেখে। আমি এক সময় বললাম, আমার সঙ্গে কুড়ি টাকার একটা নোট আছে। তোমার দরকার থাকলে নিতে পার। ধার হিসেবে, পরে ফেরত দিতে হবে।
ছেলেটি ধার নেয়ার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখাল না। তবে এবার আর দুরে দুরে রইল না। কাছে এগিয়ে এল। আমরা দু’জন হাঁটছি। কেউ কাউকে চিনি না।
দরজার ওপাশে – ০৯
আরে হিমু, প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ, এসো এসো।’
আমি পুরোপু্রি হকচকিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হবার কোন কারণ নেই, কিন্তু বড় ফুপা উচ্ছ্বসিত। তাঁর মুখভর্তি হাসি। আমি শংকিতে বোধ করলাম, মুখে হাসি টেনে এনে বললাম, আজ এক তারিখ ফুপা।
‘অবশ্যই আজ এক তারিখ। তোমার এ্যালাউন্স খামে ভরে রেখেছি। এখন বল কি খাবে? গতবার কফি খেতে চেয়েছিলেন,দিতে পারি নি। দিস টাইম আই হ্যাভ কফি। গুড কফি। খাবে?’
‘আরাম করে বোস। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর তোমাকে দেখছি।’
‘আপনাকে এতে খুশি খুশি লাগছে কেন?’
‘খুশি খুশি লাগছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘খুশির কারণ ঘটেছে।কারণটা বলার আগে তোমার উপর যে এমবারগো ছিল তা উঠিয়ে নেয়া হল।নো এমবারগো। ইচ্ছে করলে তুমি এখন আমার বাড়িতে যেতে পার। এজ এ ম্যাটার অব ফেক্ট আমাদের সঙ্গে বাস করতে পার। এক কাজ করতে পার, আজই আস। সন্ধ্যার পর আস। ডিনার কর আমাদের সঙ্গে।’
‘ঠিক আছে ফুপা, যাব। এখন যাই।’
বড় ফুপা বিস্মিত হয়ে বললেন, এমবারগো কি জন্যে উঠিয়ে দেয়া হল জানতে চাচ্ছ না?’
‘না।’
‘আশ্চর্য ব্যাপার! সামান্য কৌতুহলও কি বোধ করছ না?’
‘এমবারগো নেই। এটাই বড় কথা। কেন নেই তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাচ্ছি না।’
‘বোস তো। বলি কি জন্যে এমবারগো বাতিল হয়েছে।’
‘সন্ধ্যাবেলা যখন খেতে যাব তখন শুনব।’
‘আহা এখনি শোন। তোমার কৌতুহল না থাকতে পারে, আমার বলার আগ্রহের দাম দেবে না? আরাম করে বোস। তোমার পা উঠিয়ে বসার অভ্যাস। পা উঠিয়ে বোস। কফি খাও। এই কফিটা তোমার জন্যেই আনানো। ঐদিন কফি খেতে চাইলে –দিতে পারলাম না।’
আমি বসলাম। আনন্দিত মানুষের মুখের দিকে তাকানোও আনন্দময় ব্যাপার। ফুপাকে দেখে ভাল লাগছে। তাছাড়া মুখে যা’ই বলুন, আমাকে বেশ পছন্দ করেন।
‘হিমু।”
‘জ্বি।’
‘বাদল বলে তোমার নাকি অনেক ক্ষমতা-টমতা আছে। বল দেখি আমি কি জন্যে খুশি?’
‘বাদল সম্পর্কে আপনার দুঃশ্চিন্তা দূর হয়েছে বলেই আপনি খুশি। ও দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। খুব সম্ভব আমেরিকা।’
ফুপা অনেকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রেইলেন। হতভম্ভ ভাব খানিকটা কাটার পর বিড় বিড় করে বললেন, আসলেই তোমার ক্ষমতা আছে। ইয়েস, ইউ হ্যাভ পাওয়ার। বাদল ভুল বলেনি। আমি ইমপ্রেসড্। থরোলি ইমপ্রেসড্।
ফুপা ঘোর-লাগা চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি তাঁর ঘোর অনেকখানি কাটিয়ে দিতে পারি। বাদল বাইরে চলে যাচ্ছে এটা বলার জন্যে কোন ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। আমি অনুমান থেকে বলেছি। যেহেতু ফুপা আমার উপর থেকে এমবারগো তুলে নিচ্ছেন সেহেতু আমি ধরে নিয়েছি বাদলকে নিয়ে তাঁর আর ভয় নেই। আমেরিকা যাত্রার ব্যাপারটাও সহজ অনুমান—বাদলের বড়বোন রিনিকি আছে আমেরিকায়।
সেই ব্যবস্থা করেছে।
‘হিমু।’
‘জ্বি ফুপা।’
‘আমি সত্যি অবাক হয়েছি। সুপারন্যাচারাল পাওয়ার তাহলে মানুষের আছে!’
‘তা আছে।’
‘ভবিষ্যৎ তুমি কি কিছু বলতে পার?’
‘সবাই খানিকটা পারে।’
‘না না, সবাই পারে না। এটা সবার পারার ব্যাপার না। আচ্ছা আমার ভবিষ্যৎ কি বল তো?’
‘আপনার ভবিষ্যৎ খুব ভয়াবহ।’
ফুপা হকচকিয়ে গেলেন। চট করে তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তিনি জড়ানো গলায় বললেন, কেন?’
‘আপনার জীবন হবে নিঃসঙ্গ। প্রচুর মদ্যপান করবেন। দু’বছরের মাথায় বড় ধরনের স্ট্রোক হবে। যদি বেঁচে যান তাহলেও সমস্যা। ফুপুর সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকবে। শেষটায় এমন দাঁড়াবে যে দু’জন থাকবেন দু’বাড়িতে।’
‘এসব তুমি কি বলছ?’
‘যা ঘটবে তাই বলছি ফুপা।’
‘তোমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থেকে বলছ না অনুমান করছ?’
‘আধাত্মিক ক্ষমতা থেকে বলছি, তবে লজিকও একে সাপোর্ট করবে। মেয়ে কাছে নেই, ছেলেও চলে যাচ্ছে। নিঃসঙ্গ হওয়াটা তো স্বাভাবিক। সামনের বছর রিটায়ার করছেন। কাজেই মেজাজ থাকবে খারাপ। এম্নিতেই আপনি সিগারেট বেশি খান। তার পরিমাণ আরো বাড়বে। নিঃসঙ্গতার দূর করার জন্যে মদ্যপানের মাত্রা দেবেন বাড়িয়ে। স্ট্রোক হবে। যতই দিন যাচ্ছে, ফুপুর সঙ্গে ততই আপনার দুরুত্ব বাড়ছে। যেহেতু বাড়ি ছাড়াও ঢাকায় আপনার একটি এ্যাপর্টমেন্ট আছে, কাজেই অনুমান করছি শেষের ভয়ংকর দিনগুলিতে দু’জন থাকবেন দু’জায়গায়।’
কফি চলে এসেছে। ফুপা শুকনো মুখে কফির পেয়ালার চুমুক দিচ্ছেন। ফুপার মুখের ভাব দেখে আমার মায়াই লাগল। আমি কফি শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, এতটা মন খারাপ করার কিছু নেই ফুপা। আগেভাগে সমস্যা জানা থাকলে সমস্যা এড়ানো যায়।
ফুপা গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি যা বলছ তাই হবে। আমি সমস্যা এড়াতে পারব না। আমার সেই ক্ষমতাই নেই। তুমি তো খবর রাখ না, মদ্যপান তিনগুণ বেরেছে। এখন রোজই খাই। ফুপুর সঙ্গে বাক্যালাপ সাতদিনের ভেতর দু’দিনই থাকে বন্ধ। তুমি এসো, আজ সন্ধ্যায় কথা বলব।
ফুপার বাড়িতে যাবার আগে আগে পুরানো ঢাকায় গেলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিতলী যে বাড়িতে থাকে সেটা বের করলাম। ভঙ্গুর দশার এক দোতলা বাড়ি। আধঘণ্টার মত কড়া নাড়ার পর বুড়ো মত এক লোক বের হয়ে এলেন। আমি তিতলীর সঙ্গে দেখা করতে চাই শুনে তিনি খুবই সন্দেহজনক চোখে আমাকে দেখতে লাগলেন।
‘তিতলী এ বাড়িতে থাকে আপনাকে কে বলল?’
‘তার বাবা বলেছেন।’
‘তিনি বলবেন কিভাবে? তিনি তো জেলে।’
‘ব্যাখ্যা করতে হলে অনেক সময় লাগবে। আপনি তিতলীকে দয়া করে বলুন হিমু এসেছে।’
‘আপনি কোথেকে এসেছেন?’
‘এতসব জানার কোন দরকার নেই। আমার নাম বললেই হবে।’
‘কি নাম বললেন?’
‘হিমু। হিমালয়।’
‘দাঁড়ান এইখানে।’
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম।ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। নেমে এলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বিরস মুখে বললেন, তিতলী বলেছে দেখা হবে না।
‘আপনি কি আমার নাম বলেছিলেন?’
‘বলেছিলাম।’
‘গুবলেট পাকননি তো। একটা বলতে গিয়ে আরেকটা বলেননি তো?’
‘বলেছি হিমু দেখা করতে চায়। হিমালয়।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
ভদ্রলোক ভেতরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে ভদ্রলোক আবার দরজা খুলে বলবেন—অপ্রস্তুত গলায় বলবেন, আপনাকে বসতে বলেছে। ইনট্যুশন কাজ করল না। আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরেও দরজা খুলল না।
ফুপার পুরো বাড়ি অন্ধকার। পোর্চেও আলো নেই। ব্যাপার কি কিছুই বুঝতে পারছি না। গেট খুলে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলাম। মনে হচ্ছে বাড়ি খা খা করছে। কেউ নেই। বারান্দায় পা দিতেই ফুপা বললেন, এসো হিমু, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
‘বাড়ি অন্ধকার কেন?’
‘বুঝতে পারছি না। সব বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে, শুধু এখানেই নেই। কোন মানে হয় বল তো? ইলেট্রিসিয়ানকে খবর দিয়েছিলাম—সে বলল কাট-আউট চুরি হয়ে গেছে। কাট-আউট কোন বাড়িতে চুরি হয়? চোর কাট-আউট দিয়ে কি করবে বল দেখি?’
‘কাট-আউট লাগিয়ে দিলেই হয়।’
‘এখানে যেসব পাওয়া যায় সেগুলি ফিট করে না। ব্যাংকক থেকে এনেছিলাম। ড্রাইভারকে পাঠিয়েছি খুঁজে দেখতে কোথাও পায় কিনা।’
‘বাড়িতে কেউ নেই?’
‘তোমার ফুপু নেই। সমান্য একটু আর্গুমেন্ট হয়েছে। স্যুটকেস গুছিয়ে সন্ধ্যাবেলা চলে গেল।’
‘গেছেন কোথায়/’
‘বলে গেছে হোটেলে গিয়ে উঠবে। যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। ইট ইজ হাই টাইম দ্যাট সামথিং হ্যাজ টু বি ডান। মনে হয় না এই মহিলার সঙ্গে বাস করতে পারব।’
‘বাদল বাড়িতে নেই?’
‘আছে। ঘরে বসে কি সব যেন করছে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়া।’
‘আমি ওর সঙ্গে একটু গল্প করে আসি ফুপা। অনেক দিন কথা হয় না।’
‘যাও। ও, আরেকটা কথা, তোমাকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছিলাম, সরি, এব্যাউট দ্যাট কিছু রান্নাই হয় নি। কাজের মেয়ে দু’জন আছে, ওরা রাঁধতে পারত। তোমার ফুপু তাদের নিষেধ করে দিয়েছে। দু’জনকেই ছুটি দেয়া হয়েছে।’
‘এটা কোন সমস্যা না ফুপা। পাউরুটি আছে তো, ঐ খেয়ে নেব।’
‘পাউরুটি খেতে হবে না। ড্রাইভারকে বলেছি যা পায় নিয়ে আসতে। বাদলের সঙ্গে কথাবার্তা যা বলার বলে তুমি ছাদে চলে এসো।’