মোবারক হোসেন সাহেব আমাকে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। বিস্ময় গোপন করার কোন চেষ্টা করলেন না। তাঁর চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সারা গায়ে পানি এসেছে। হাতে-মুখে পানি এসেছে। ঘনঘন ঢোক গিলছেন।
‘হিমু,তুমি দেখা করার ব্যবস্থা করলে কি করে? কাউকেই তো দেখা করতে দিচ্ছে না। তিতলীকেও দেয়নি। অন্যের কথা বাদ দাও।’
আমি বলালম, ব্যবস্থা করেছি। দেখা করা কোন সমস্যা না। আপনার জন্য দু’প্যাকেট সিগারেট এনেছি।’
‘থ্যাংকস। মেনি থ্যাংকস। তোমাকে দেখে ভাল লাগেছ। ঐদিন তোমাকে আজেবাজে কথা বলেছি। যদি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই, যদি বের হতে পারি, তোমাকে আমি খুশি করে দেব।’
‘আমি এম্নিতেই খুশি। চাচা, আপনি সিগারেট খান। আমি দেখি।’
‘তাও জানি। ভাল লাগছে তোমাকে দেখে। এখন মনে হচ্ছে আমি একেবারে একা না। একজন হলেও আছে—যে আমার জন্যে খানিকটা হলেও অনুভব করে। তুমি আজ প্রথম আমাকে চাচা বললে, Iam feeling honoured.’
মোবারক হোসেন সাহবের চোখে পানি এসে গেল। আমি বললাম, আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন কেন?
‘দুর্বল হয়েছি কারণ নানান ধরণের অন্যায় এই জীবনে করছি। সৎ মানুষ যদি হতাম দুর্বল হতাম না। আমি সৎ মানুষ না। তোমার ভাষায় আমি হচ্ছি না-মানুষ। তবে এরা যে মামলা সাজিয়েছে তা মিথ্যা মামলা। মিথ্যা বলেই শাস্তি হয়ে যাবে। সত্য মামলার অনেক ফাঁকফোকর থাকে। মিথ্যা মামলার থাকে না। হিমু!
‘জ্বি।’
‘তোমার না-কি ইনট্যুইশন প্রবল। তোমার কি মনে হয় ওরা আমাকে ঝুলিয়ে দেবে?’
‘আমার ইনট্যুইশন কাজ করছে না।’
‘আমারটাও কাজ করছে না। তোমার মত আমার ইনট্যুইশনও প্রবল। কিন্তু এখন কিছু করতে পারছি না। ভাল কথা, তোমাকে এখানে কতক্ষণ থাকতে দেবে?’
‘এক ঘন্টা।’
‘গূড, ভেরি গূড। কথা বলার মানুষ নেই। ও আচ্ছা, তোমার ঐ বন্ধু—ওর চাকরিটা হয়েছে তো?’
‘জানি না। আমি আর খোঁজ নেইনি। ওকে খবর দিয়ে দিয়েছি।’
‘যে চাকরির জন্য এত ঝামেলা করলে সেটার শেষ অবস্থা জানলে না?’
‘একদিন যাব। খোঁজন নিয়ে আসব।’
‘জহিরের কোন খোঁজ নেই, তাই না?’
জ্বি- না।’
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘তোমার ইনট্যুইশন কি বলে জহির বেঁচে আছে? আমার কয়েকদিন থেকেই অন্য রকম মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকলে এই অবস্থায় সে লুকিয়ে থাকত না। সে তার চিঠিতে আমাতে শয়তান বলেছে। খাঁচায় ঢুকে পড়লে শয়তান আর শয়তান থাকে না। সে তখন চিড়িখানার পশূ হয়ে যায়। আমি এখন চিড়িয়াখানার চিড়িয়া।’
‘খাচা থেকে যদি বের হতে পারেন তখন কি হবেন?’
‘বলতে পারছি না। বলা খুব মুশকিল। কোন কিছুই আগেভাগে বলা যায় না।’
মোবারক হোসেন সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরালেন। ধরাতে কষ্ট হল। মনে হল তাঁর হাত কাঁপছে।
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘আমার মেয়েটার সঙ্গে ইতিমধ্যে কি তোমার দেখা হয়েছে।?’
‘না। তারা কোথায় আছে জানি না। আপনার বাড়ি তালাবন্ধ।’
‘ও পুরানো ঢাকায় আছে আগামসি লেন। ঠিকানা দিচ্ছি, একবার দেখা করবে।’
‘কিছু বলতে হবে?’
‘বলবে, ভাল আছি। চিন্তা করতে নিষেধ করতে। মেয়েটা একলা হয়ে গেছে। ওর মাকে চিকিৎসার জন্যে ওর ভাইরা সিঙ্গাপুর নিয়ে গেছে, জান বোধহয়?’
‘জানতাম না, এখন জানলাম।’
‘একঘণ্টা হয়ে গেছে হিমু?’
‘না, এখনো কুড়ি মিনিট আছে।’
‘বল কি, এখনো কুড়ি মিনিট ? এই কুড়ি মিনিট কি নিয়ে কথা বলা যায় বল তো? আমার আবার আরেক সমস্যা হয়েছে। গলা শুকিয়ে যায়। একটু পরপর ঢোক গিলতে হয়?
‘আপনার যদি কথা বলতে ইচ্ছে না হয় তাহলে আমি চলে যাই।’
‘আচ্ছা, যাও—আসলেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মোবারক হোসেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন।
ছোট মামার রাতের ট্রেনে যাবার কথা। কাপড় পরে তৈরি হয়েছেন। বেরুতে যাব, হঠাৎ বললেন—আচ্ছা বাদ দে, আরেকটা রাত থেকে যাই। তোর সাথে দেখাই হয় না। একা একা থাকিস, বড় মায়া লাগে।
‘বাড়িতে কি সব সমস্যা না-কি আছে।’
‘থাকুক সমস্যা। এক রাতে কি আর হবে? তোর সাথে গল্পগুজবই করা হয় না।’
‘বেশ তো মামা, আসুন গল্পগুজব করি।’
‘তুই এবার একটা বিয়ে-টিয়ে কর। একা একা কত দিন থাকবি। অবশ্যি একা থাকায়ও আরাম আছে। তাই বলে সারা জীবন তো একা থাকা যায় না। ঠিক না?’
‘জ্বি মামা ঠিক।’
‘দেখে শুনে পাত্রী ঠিক করতে হবে। নন মেট্রিক হলে ভাল হয়। এইসব মেয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে। যা বলবি শুনবে। পড়াশোনা জানা মেয়ে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করবে। কালো মেয়ে খুঁজে বের করতে হবে। মুখের ছিরি ছাঁদ আছে কিন্তু রং কালো। ফর্সা মেয়েদের মেজাজ থাকে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কালো মেয়ে দশ চড়েও শব্দ করবে না। মেয়ে দেখব না-কি হিমু?’
‘এখন না মামা। চাকরি-বাকরি নেই, খাওয়াবো কি?’
‘খাওয়ানোর মালিক আল্লাহপাক। কে খাওয়াবে এই সব নিয়ে চিন্তা করা মহাপাপের সামিল। এই জগতের সমস্ত পশুপাখি, মানুষ, জ্বিন সবার খাওয়ার দায়িত্ব আল্লাহপাক নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন। এই ধর—পিপড়া, পিপড়ার কখনো খাওয়ার অভাব হয়? হয় না। আল্লাহপাক তার খাওয়ার ব্যাবস্থা করে রেখেছেন। পিপড়ার মত এত ক্ষুদ্র প্রাণীর খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, আর মানুষের থাকবে না? তাই এইসব নিয়ে চিন্তা করিস না।’‘চাকরি-টাকরি হোক। তারপর তোমাকে বলব। মেয়ে দেখতে বেশি দিন তো লাগবে না।’
‘কি বলিস বেশিদিন লাগবে না? বিচার বিবেচনা আছে না? হালের গরু আর ঘরের জরু এই দু’জিনিস বিচার বিবেচনা করে আনতে হয়। চাকরি চাকরি করে মাথা খারাপ করিস না—চাকরিতে বরকত নাই। বরকত হল ব্যবসায়। নবীজীও ব্যবসা করতেন। তোকে ব্যবসায় লাগিয়ে দেব।’
‘কিসের ব্যবসা?’
‘কাপড়ের ব্যবসা। সাহূদের বড় একটা কাপড়ের দোকান আছে আমাদের অঞ্চলে। হারামজাদাকে স্ক্রু টাইট দিতেছি। এমন টাইট দিতেছি যে জলের দামে দোকান বেচে ইন্ডিয়ায় ভাগা ছাড়া গতি নেই। ঐ দোকান তোকে কিনে দিয়ে দেব। দোতলা ঘর আছে। এক তলায় দোকান,দোতলায় তুই বৌ নিয়ে থাকবি। কি রাজি? হাসতেছিস কেন? হাসির কি বললাম?’
‘রাস্তায় হাঁটতে যাবে মামা?’
‘রাতদুপুরে রাস্তায় হাঁটব কি জন্য? তোর একেবারে পাগলের স্বভাব হয়ে গেছে। দুপুর রাতে রাস্তায় কে হাঁটে? চোর হাঁটে আর পুলিশ হাঁটে; তুই চোরও না, পুলিশও না। তুই খামাখা হাঁটবি কেন?’