ভদ্রমহিলা বোধহয় ঘুমুচ্ছিলেন। ওসি সাহেবকে নিয়ে পাশে দাঁড়াতেই তাঁর ঘুম ভাঙ্গল। ভদ্রমহিলা এককালে রুপবর্তী কি ছিলেন না আজ তার কিছুই বোঝার উপায় নেই। কুৎসিত চেহারা। মাথায় কোন চুল নেই। মুখের চামড়া শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে লেগে গেছে। একটা জীবন্ত মানুষ, পড়ে আছে নোংরা শুকনো মাংসের দলার মত। প্রকৃতি এর সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, কি ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা।
কিন্তু সব কি নিতে পেরেছে? আমি ভদ্র মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। কি সুন্দর চোখ! শুধু পৃথিবীতে নয়, অনন্ত নক্ষত্রবহীন সমগ্র সৌন্দর্য এই দু’চোখে ছায়া ফেলেছে। এত সুন্দর চোখ কোন মানবীর হতে পারে না।
আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, রানু আপা, কেমন আছেন?
ভদ্রমহিলা একটু চমকালেন। তারপর স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। তিনি হাসলেন। তাঁর সেই হাসি মুখে ধরা পড়ল না, চোখে ধরা পড়ল। ঝিকমিক করে উঠল চোখ। আমি বললাম, রানু আপা, আপনার চোখ এত সুন্দর কেন বলুন তো? এত সুন্দর চোখ মানুষের থাকা উচিত না। এটা অন্যায়।
‘ভদ্রমহিলা বালিশের নিচ থেকে হাতড়ে হাতড়ে নেটিবই বের করলেন। পেনসিল বের করলেন। অনেক সময় নিয়ে কি যেন লিখলেন। বাড়িয়ে দিলেন সেই লেখা। অস্পষ্ট হাতের লেখায় তিনি লিখেছেন—
‘কেমন আছেন ভাই?’
আমি বললাম, আমি ভাল আছি। আপনিও কিন্তু ভাল আছেন। আমি আপনার চোখ দেখেই বুঝতে পারছি। শারিরীক কষ্ট আপনি জয় করেছেন।
তিনি আবার নোটবই হাতে নিলেন। আমি বললাম, আপা, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনার চোখের দিকে তাকিয়েই আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি চাচ্ছেন আপনি যেন আপনার কপালে হাত রেখে একটু প্রার্থনা করি। কি ঠিক বললাম না? আমি আপনার কপালে হাত রাখছি—প্রর্থনা কিন্তু করব না আপা। প্রর্থনা আপনার প্রয়োজন নেই।
তার চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে গিয়েও পড়ছে না। দীর্ঘ আঁখিপল্লবের কোণায় মুক্তার মত জমে আছে।
আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই মহিলার চোখের ভাষা আমি সত্যি সত্যি পড়তে পারছি। ঈশ্বর তাঁর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন চোখে।
ভদ্রমহিলার চোখে খুব সুন্দর করে আমাকে বলল, ভাই, আমি সারাক্ষণ একা থাকি। এইটাই আমার কষ্ট, অন্য কোন কষ্ট নেই। তুমি কি জান আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানেও কি আমাকে একা থাকতে হবে?
আমি নিচু গলায় বললাম, আপা, আমি জানি না। আমি আসলে কিছুই জানি না। জানার জন্যে এর কাছে তার কাছে যাই-তারাও জানে না। আপনি যদি কিছু জানেন আমাকে জানিয়ে যান।
তিনি হাসলেন। তাঁর চোখ ঝিকমিক করে উঠল। ওসি সাহেব বললেন, হিমু ভাই, আসুন আমরা যাই। ওসি সাহেবের চোখ ভেজা। কিন্তু গলার স্বর স্বাভাবিক। হাসপাতালের বাইরে এসে আমি বললাম, আপনি কি অপনার স্ত্রীর চোখের ভাষা পড়তে পারেন?’
‘আগে পারতাম না, কিছুদিন হল পারছি। আগে ভাবতাম মনের ভুল,উইসফুল থিংকিং। এখন বুঝছি মনের ভুল নয়। চোখ দিয়ে মানুষ আসলেই কথা বলতে পারে। হিমু সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। আমাকে বদলি করা হয়েছে চিটাগাং হিলট্রেক্টে। আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছি। ও মারা যাবার পরপরই চলে যাব। যদি কোনদিন পাহাড় জঙ্গল দেখতে ইচ্ছে করে আসবেন আমার কাছে।’
‘আমার মনে থাকবে।’
‘আপনার কাগজপত্র সব তৈরি করে এনেছি। আপনি নাম সই করে আমার কাছে দিন, আমি জমা দিয়ে দেব। তবে আমার মনে হচ্ছে লাভ হবে না।’
‘চেষ্টা করে দেখি।’
‘দেখুন, চেষ্টা করে দেখুন। কিছু হবে না জেনেও তো আমার চেষ্টা করি।’
‘আপনি কি আবার হাসপাতালে যাবেন?’
‘জ্বি-না। বাসায় চলে যাব। দু’টা ছোট ছোট বাচ্চা বাসায়। পুলিশের ছেলেমেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ওরা অসম্ভব ভীতু।’
‘তারা মা’কে দেখতে আসতে চায় না?’
‘চায়। আমি আনি না। আপনার কি মনে হয় আনা উচিত?’
‘ওদের যদি আসতে ইচ্ছা করে অবশ্যই আনা উচিত। চলুন ওসি সাহেব, কোন একটা রেস্টুরেণ্টে বসে এক কাপ চা খাই। চলুন।’
কিছুদূর এগুতেই রেস্টুরেণ্ট পাওয়া গেল। চা খাওয়া হল নিঃশব্দে। আমি কাগজপত্র সই করে দিলাম। বেশ কয়েকটা দরখাস্ত। একটি পাবলিক প্রসিকিউটারের কাছে, একটা ডিআইজি প্রিজনের কাছে, একটা মোবারক সাহেবের উকিলের কাছে।
তিনি কাগজপত্র ব্যাগে রাখতে রাখতে বললেন, হিমু সাহেব, আজ উঠি।
আমি বললাম,চলুন আপনাকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আসি।
‘এগিয়ে দিতে হবে না। আপনি আমার জন্যে অনেক করেছেন।’
তিনি দ্রুত পা ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
দরখাস্তে কোন লাভ হল না। অনুমতি পাওয়া গেল না।
জেলখানা, পুলিশ, কোর্ট-কাছারি এইসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন আমার ছোট মামা। ছোট মামাকে চিঠি লিখলাম। চিঠি পাঠাবার তৃতীয় দিনের দিন তিনি চলে এলেন। আসবেন তা জানতাম। আমার প্রতি মামাদের ভালবাসা সীমাহীন।
একটা হ্যাণ্ডব্যাগ,একটা ছাতা, বগলে ভাজ করা কম্বল নিয়ে রাতদুপুরে মামা উপস্থিত। এমনভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছেন যেন ভেঙ্গে ফেলবেন। মেসের অর্ধেক লোক জেগে গেল। আমি হস্তদস্ত হয়ে দরজা খুললাম। ছোট মামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, বিষয় কি রে, আমি খুবই চিন্তাগ্রস্ত। বাড়িতে বিরাট যন্ত্রণা—না বললে বুঝবি না। তারপরে ও চিঠি পেয়ে স্থির থাকতে পারলাম না। শরীর ভাল?
‘জ্বি ভাল।’
‘কই, কদমবুসি তো করলি না।’
‘আমি কদমবুসি করলাম। মামা খুশি খুশি গলায় বললেন, থাক থাক, লাগবে না। আল্লাহ বাঁচায়ে রাখুক। তোর গায়ের রঙটা ময়লা হয়ে গেছে। রোদে ঘোরাঘুরি এখনও ছাড়লি না।
‘হাত-মুখ ধোন, মামা।’
‘হাত-মুখ আর ধোব না। একবারে গোসল করে ফেলব। ঘরে জায়নামাজ আছে? নামাজ ক্বাজা হয়ে গেছে। ক্বাজা আদায় করতে হবে। নামাজ শেষ করে তোর বিষয় কি শুনব। ঝামেলা বাঁধিয়েছিস?
‘হুঁ।’
‘পুলিশী ঝামেলা?’
‘হু।’
মামার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। হাসিমুখে বললেন, কোন চিন্তা করিস না। পুলিশ কোন ব্যপারেই না। আমরা তো বেঁচে আছি, এখনো মরি নাই। তোর চিঠি পড়েই বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। চিঠি পেলাম একটায়, চারটায় পাড়ি ধরলাম। তোর আমি চিল্লাচিল্লি করতেছিল – দিলাম ধমক। মেয়ে ছেলে অবস্থার গুরুত্ব বুঝে না। তাকে বললাম, অবস্থা সিরিয়াস না হলে হিমু চিঠি লেখে? সেকি চিঠি লেখার লোক?
মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন। দীর্ঘ সময় লাগালো নামাজ শেষ করতে। তাঁর চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মত। ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি। মোনাজাত করবার সময় টপটপ করে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। আমি অবাক হয়ে এই দূশ্য দেখলাম।
‘তারপর বল, কি ব্যাপার?’
‘একজন লোক জেলখানায় আছে মামা। ওর সঙ্গে দেখা দরকার দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না। দরখাস্ত করেছি, লাভ হয়নি।’
‘খুনের আসামী? তিনশ’ বার ধারা?’
‘কোন ধারা তা জানি না তবে খুনের আসামী?’
‘এটা কোন ব্যাপারই না। টাকা খাওয়াতে হবে। এই দেশে এমন কোন জিনিস নাই যা টাকায় হয় না।’
‘টাকা তো মামা আমার নেই।’
‘টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি না-কি? আমরা আছি কি জন্যে? মরে তো যাই নাই। টাকা সাথে নিয়ে আসছি। দরকার হলে জমি বেচে দিব। খুনের মামলাটা কি রকম বল শুনি। আসামী ছাড়ায়ে আনতে হবে?
‘তুমি পারবে না মামা। তোমার ক্ষমতার বাইরে।’
‘আগে বল, তারপর বুঝব পারব কি পারব না। টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোন ব্যাপারই না। এক লাখ টাকা থাকলে দু’টা খুন করা যায়। প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার। পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে।
আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম। মামা গালে হাত দিয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে শূনলেন। সব শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশের সাজানো মামলা—পেছনে আছে বড় খুঁটি। কিছু করা যাবে না।ট্রাইব্যুনাল করলে কোন আশা নেই। সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে। জাজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে। আগে জাজ সাহেবেরা টাকা খেত না। এখন খায়। অনেক জাজ দেখেছি কাতলা মাছের মত হা করে থাকে। কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি।
‘তুমি কি করবে?’
‘সাক্ষী যে কয়টা আছে সবার মনে একটা ভয় ঢুকায়ে দিতে হবে। বলতে হবে সাক্ষী হয়েছে কি জান শেষ। এই সব কথা এরা বিশ্বাস করবে না। তখন একটাকে মেরে ফেলতে হবে। একটা শেষ হয়ে গেলেই বাকীগুলো ভয় পেয়ে যাবে। এছাড়াও আরো ব্যাপার আছে। তুই ছেলেমানুষ বুঝবি না। তুই আমারে খবর দিস, চলে আসব।’
‘মামলা মোকদ্দমা তোমার খুবই ভাল লাগে?’
‘এইসব ভাল লাগার ব্যাপার? তুই একটা ঝামেলায় পড়েছিস….
‘আমি কোন ঝামেলায় পড়েনি মামা।’
‘তোর চেনাজানা একজন পড়েছে। ব্যাপার একই। ভাই বেরাদার, বন্ধু এদের না দেখলে দেখব কাকে? পাড়ার লোককে দেখব?
‘মামা কিছু খাবনে? হোটেল সারারাত খোলা থাকে। চলুন যাই।’
‘না কিছু খাব না।
ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাব।’ এতক্ষণ জেগে থাকবেন?
‘কোরান তেলাওয়াত করব, তুই ঘুমা।’
মামা ফজরের নামাজ পড়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে গেলেন। ভোরবেলা জেগে উঠে দেখি মামা নেই। সারাদিন অপেক্ষা করলাম। তিনি ফিরলেন ঠিক সন্ধ্যায়। আমার সঙ্গে একটি কথাও না বলে মাগরেবের নামাজ শেষ করে আমাকে ডাকলেন। খুশি খুশি গলায় বললেন, ব্যবস্থা করে এসেছি। কাল সকাল দশটায় জেলগেটে চলে যাবি। আর শোন হিমু, আমি আর থাকতে পারব না। বাড়িতে বিরাট যন্ত্রণা রেখে এসেছি। কেলেংকারী অবস্থা। গিয়ে সামাল দিতে হবে। এখানকার মামলা শুরু হোক। তুই খবর দিস। খবর দিলেই চলে আসব। তোর জন্যে মনটা সবসময় কাঁদে।
আমি মামাকে রাতের ট্রেনে তুলে দিতে গেলাম। দু’জন প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছি—গার্ড সবুজ বাতি দেখয়ে দিয়েছে, মামা বললেন, তাড়াতাড়ি কদমবুসি করে ফেল। ট্রেন ছেড়ে দিবে।
আমি কদমবুসি করতেই মামা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। মামা বললেন, থাক, বাদ দে। একদিন তোর সাথে থেকেই যাই। কাল রাতের ট্রেনে গেলেই হবে। আসছি যখন মীরপুরের মাজার শরীফটা জিয়ারত করে যাই। খুব গরম মাজার।
না-মানুষদের অন্তরে ভালবাসা থাকে না এটা ঠিক না। না-মানুষদের অন্তরে ভালবাসা তীব্র ভাবেই থাকে।