মেসে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। রূপাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। রূপাদের বাড়িটি প্রাচীন। উঁচু দেয়াল-ঘেরা দোতলা বাড়ি। রূপা যে খাটে ঘুমায় তা আমি কোনদিন দেখিনি, তবে আমি নিশ্চিত সেটা বিশাল একটা খাট।
রাত যদিও অনেক হয়েছে রূপা নিশ্চয়ই ঘুমায়নি।তার এম. এ. পরীক্ষা চলছে। সে অনেক রাত জেগে পড়ে। সে নিশ্চয়ই হেঁটে হেঁটে বই হাতে নিয়ে পড়ছে। তাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের রাস্তায় দাঁড়ালেই রূপার শোবার ঘরের জানালা দেখা যায়।যদি দেখি জানালার আলো জ্বলছে তাহলে তাকে একটা টেলিফোন করা যেতে পারে। আমাদের মেসের সামনে কিসমত রেস্টুরেন্ট সারারাত খোলা থাকে। তাদের একটা টেলিফোন আছে। পাঁচটাকা দিলেই রেস্টুরেন্টের মালিক একটা টেলিফোন করতে দেবে। সমস্যা একটাই, রূপা কি টেলিফোন ধরবে? সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। নিশিরাতের টেলিফোন অবিবাহিত কুমারী মেয়েরা কখনো ধরে না।রাতের টেলিফোন ধরার দায়িত্ব বাড়ির পুরুষদের। রিং হওয়ামাত্র রূপার বাবা গম্ভীর গলায় বলবেন, কে? উনি কখনো ‘হ্যালো’ বলেন না। বিনয় করে জিজ্ঞেস করেন না, আপনি কে বলছেন? ধমকের স্বরে জানতে চান—কে?
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসে ভেজা গন্ধ। গত রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। মনে হয় আজ রাতেও হবে। বাড়ি ফিরে যাওয়াটাই ঠিক করলাম। কিছুদুর এগুতেই বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করল। দৌড়ে গাছের নিচে আশ্রয় নেবার কোন মানে হয় না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ধীরে সুস্থে এগুনোই ভাল। মেসে পৌঁছলাম। কাকভেজা হয়ে।
ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছে।মেসবাড়ি অন্ধকার। সিঁড়ি ঘরের ছাদ হয়নি বলে বৃষ্টি হলেই সিঁড়ি ভিজে থাকে। খুব সাবধানে রেলিং ধরে ধরে উঠতে হয়। কয়েক পা এগুতেই সিঁড়িতে টর্চের আলো পড়ল। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আলো ফেলেছেন বায়েজিদ সাহেব। আমি হাল্কা গলায় বললাম, কি ব্যাপার , বায়েজিদ সাহেব এখনো জেগে আছেন?
‘আপনার জন্যে জেগে আছি।’
‘কেন বলুন তো?’
‘দুপুর বেলায় আপনার বন্ধু এসেছিলেন; রফিক সাহেব। উনি রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেলেন। উনার মা মারা গেছেন এ খবরটা দিতে এসেছিলেন।’
‘কিভাবে মারা গেলেন?’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি কিছু বললেন না। উনি প্রশ্ন করলে উত্তর দেন না।’
আমি ঘরে ঢুকলাম না। ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকে লাভ নেই। আবার ভিজতে হবে। বায়েজিদ সাহেব নিচু গলায় বললেন, আপনি এখন নারায়নগঞ্জ যাবেন?
‘জ্বী।’
‘এত রাতে তো বাস টাস কিছু পাবেন না। তার উপর বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘হেটে চলে যাব।’
‘এখুনি কি রওনা দেবেন?’
‘হ্যাঁ এখুনি, দেরি করে লাভ নেই। রফিক অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।’
বায়েজিদ সাহেব নিচু গলায় বললেন, আমার ঘরে কেরোসিন কুকার আছে। এক কাপ গরম চা বানিয়ে দেই। চা খেয়ে যান। শরীরটা গরম থাকবে।
‘আচ্ছা বানান, এক কাপ খাই। রফিক শুধু তার মা’র মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে,
আর কিছুই বলেনি?’
‘জ্বি-না।’
আমি আবার রাস্তায় নামলাম, রাত একটা দশ মিনিট। ঘোর দুর্যোগ। ক্রমাগত বৃষ্টি হচেছ। রাস্তায় একহাঁটু পানি। পানি ভেঙ্গে এগুচ্ছি। চরম দুর্যোগে মানুষকে একা পথে চলতে দেখলে কোত্থেকে একটা কুকুর এসে তার সঙ্গি। ব্যাপারটা আমি আগেও অনেকবার লক্ষ্য করেছি। আজ আবার করলাম। আমি হাঁটছি। আমার পেছনে পেছন আসছে যমের অরুচি টাইপ কুকুর। আমি থামলে সেও থামে, আমি চলতে শুরু করলে সেও চলে।
রফিকদের একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। মৃত বাড়ির এক ধরণের চরিত্র আছে। অনেক দূর থেকে বোঝা যায় এই বাড়ির একজন কেউ নেই। যত রাতই হোক বাড়ির লোকজন জেগে থাকে। সবার চোখে-মুখে দিশাহারা ভাব থাকে। এরা হাঁটা চলা করে নিঃশব্দে, কিন্তু কথা বলে উঁচুগলায়। গলার স্বরও বদলে যায়। যে কারণে চেনা মানুষ কথা বললেও মনে হয় অচেনা কেউ। যে কথা বলে সে নিজেও নিজের গলার স্বরে চমকে চমকে ওঠে। মৃত বাড়িতে কখনো বিড়াল থাকে না। এরা নিঃশব্দে বিদেয় হয়। আবার যখন সব শান্ত হয়ে আসে, এদের দেখা পাওয়া যায়।
রফিকের এটা নিজেদের বাড়ি। আত্মীয়স্বজন সব এবাড়িতেই আসবে, এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি অন্ধকার। বাইরে বারান্দায় বেঞ্চের উপর একটা বিড়াল শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে না। মাথা উঁচু করে সম্ভবত বৃষ্টি দেখছে। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর বাতি জ্বলল। দরজা খুলে দিল যূথী। শাশুড়ির মৃত্যুতে একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয়—সে বাপের বাড়ি থেকে এসেছে এবাড়িতে।
মনে হচ্ছে সেও ঘুম থেকে উঠে এসেছে।
যূথী ক্লান্ত স্বরে বলল, ভেতরে আসুন। ও ঘুমুচ্ছে। তিনদিন, তিনরাত কেউ এক পলকের জন্যেও ঘুমুতে পারিনি। যা ঝামেলা গেছে! ইস, ভিজে টিজে কি অবস্থা! এত রাতে আসার দরকার ছিল না।
আমি বললাম, কবর দেয়া হয়ে গেছে?
‘জ্বি, বাদ আছর কবর হয়েছে। আত্মীয়স্বজন যাঁরা এসেছিলেন সব রাত আটটার মধ্যে চলে গেছেন। এই বাড়িতে এখন শুধু আমি আর আপনার বন্ধু আছে। আর কেউ নেই। একটা কাজের লোক ছিল, মার অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি হল তখন সে আমাদের টিভিটা নিয়ে পালিয়ে গেল।’
যূথী কথা বলছে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। যেন মৃত্যু কিছুই না। আলাদা গুরুত্ব পাবার মত ঘটনা না। একজন মারা গেছে, তাকে কবর দেয়া হয়েছে। ব্যাস, ফুরিয়ে গেল । যূথী হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট বার ইঞ্চি টিভি। বিয়ের সময় আমার যে মামা সিঙ্গাপুরে থাকেন উনি প্রেজেন্ট করেছিলেন। খুব সুন্দর ডিজাইন ছিল। ভায়োলেট কালার। নবগুলি সোনালি। চোর নিয়ে গেছে, কি আর করা যাবে বলুন! কিন্তু মা’র আফসোস যদি দেখতেন। মরবার আধঘণ্টা আগেও আমাকে বললেন, ও বৌমা, টিভিটা যে নিয়ে গেল। আমি বললাম, আপনি এত অস্থির হবেন না মা। ও আরেকটা কিনে নেব। মা বললেন, ও কোথেকে কিনবে? ওর কি চাকরি আছে?
তওবা করবার জন্যে এক মৌলানা সাহেবকে ডেকে এনেছিলাম। মা ঠিকই তওবা করলেন। ইশারায় দু’রাকাত নামাজ পড়লেন। তারপর মৌলানা সাহেবকে বললেন, হুজুর আমাদের টিভিটা চুরি হয়ে গেছে। দোয়া কালাম দিয়ে কিছু করা যাবে?
মানুষ মরবার সময় আল্লাহর নাম নিতে নিতে মারা যায়। আম্মা টিভির জন্যে আহাজারি করতে করতে মারা গেলেন। বুঝলেন হিমুদা, ওর যদি টাকা থাকতো ওকে বলতাম একটা টিভি কিনে আনতে। একটা টাকা নেই ওর কাছে। রাস্তায় যে ভিখিরীরা থাকে ওদের কাছেও পাঁচ দশ টাকা থাকে। ওর কাছে তাও নেই। আমার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা এন এখানকার খরচ সামলালাম। খরচও তো কম না। হিমুদা, আপনি বাথরুমে ঢুকে গোসল করে নিন। সাবান গামছা আছে। মরা বাড়ি। চুলা ধরানোর নিয়ম নেই। আমি খবরের কাগজ জ্বালিয়ে আপনাকে এককাপ চা করে দি। আপনি গোসল করে ওর একটা লুঙ্গি পরে ফেলুন। লুঙ্গি অবশ্যি ধোয়া নেই, ময়লা। ময়লা লুঙ্গি পরতে যদি ঘেন্না লাগে তাহলে আমার একটা সুতির শাড়ি লুঙ্গির মত পেঁচিয়ে পরতে পারেন। নতুন শাড়ি। আমি এখনো পরিনি।
‘আমাকে লুঙ্গিই দিন।’
বাথরুম থেকে বের হয়ে চমৎকৃত হলাম। এর মধ্যেই যূথী চা বানিয়ে ফেলেছে। মেঝেতে পাটি পেতে চায়ের কাপ, একবাড়ি মুড়ি, এক গ্লাস পানি সাজানো।
‘হিমুদা, একথাল মুড়ি খান, ঘরে আর কিছুই নেই। চায়ে চিনি ঠিক হয়েছে কি-না দেখুন। আপনি তো আবার চায়ে চিনি বেশি খান।’
‘চা খুব ভাল হয়েছে।’
‘ওকে কি ডেকে তুলব? আপনি এসেছেন দেখলে সে বড় খুশি হত। অবশ্যি ওর খুশি বোঝা খুব মুশকিল। ও খুশি না ব্যাজার সেটা কি আপনি বুঝতে পারেন?’
‘পারি।’
‘আমিও পারি। ও সবচে’ খুশি হয় কখন জানেন? যখন আপনার সঙ্গে দেখা হয়। আর কি যে ভরসা আপনার উপর। ওর ধারণা, আপনি সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন। আমার বড় মামা যিনি সিঙ্গাপুর থাকেন, তিনি এসেছিলেন।
ওকে ডেকে বললেন, চাকরিটা পাওয়া যায় কিনা দেখ। না পাওয়া গেলে বিকল্প কিছু চিন্তা কর। ছোটাছু্টি কর। চুপচাপ বসে থাকলে তো হবে না। ও কি বলল জানেন? ও বলল, হিমুকে বলেছি। ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। আপনি কি কিছু করতে পেরেছেন?’
‘চেষ্টা করছি।’
‘ভাইয়া বলে চেষ্টা-চেষ্টায় কিছু হবে না। আর হলেও ঐ চাকরি টিকবে না। সাব- হউমেন স্পেসিসকে কে চাকরিতে রাখবে? দু’দিন পরে আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে?
‘আপনার ভাইয়ার কথা ঠিক না।’
‘ভাইয়ার কথা সব ঠিক হয়। ভাইয়া না ভেবে চিন্তে কিছু বলেন না। এই বিয়েতে ভাইয়ার কোন মত ছিল না। ভাইয়ার কথা আমাদের পরিবারে কেউ ফেলে না। তারপরেও কি করে যেন এই বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পর ভাইয়া বলল, তোর হাসবেন্ড কি করে চাকরি করছে কে জানে। বেশিদিন চাকরি করতে পারার তো কথা না। দেখবি, হুট করে চাকরি চলে যাবে। তুই পড়বি দশহাত পানির নিচে। হলও তাই।’
আমি বললাম, রফিকের ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ কি আপনার ভাই এখনো দিচ্ছেন?
‘এখন সবই দিচ্ছে। আমার মামাও সেদিন বললেন। মামা খুব বড় লোক তো, তাঁর কথা কেউ ফেলবে না। বড়লোকদের অন্যায় কথাও মনে হয় ন্যায়।’
‘তা হলে তো সমস্যা।’
‘শুধু সমস্যা, বিরাট সমস্যা। ভাইয়া বলছিলেন, তোর এখনো ছেলেপুলে হয়নি। তুই একা আছিস। কোন বন্ধন নেই। এখনও তুই ভাল চিন্তা করতে পারিস। নয়ত পরে খুব আফসোস করবি। তোর হাসবেন্ড মানুষ না। সাব-হিউমেড স্পেসিস। তার বুদ্ধির চেয়ে খানিকটা বেশি। এখনও সময় আছে।’
‘কিসের সময় আছে?’
‘আলাদা হয়ে যাবার সময়। ভাইয়া বলছে একটা হাফম্যানের সঙ্গে জীবন কাটাতেই হবে এমন তো কথা না।’
‘আপনারও কি ধারণা রফিক হাফম্যান?’
‘ আমি জানি না। তবে ভাইয়া সব সময় সত্যি কথাই বলে।’
‘রফিক কি আপনাকে প্রচণ্ড রকম ভালবাসে না?’
‘ও কি করে ভালবাসতে হয় তা-ই জানে না। চুপচাপ বসে থাকা কি ভালবাসা? তবু ভাইয়াকে আমি মিথ্যা করে বলেছি ও আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসে।
ভালবাসার কথা বড়ভাইকে বলা লজ্জার ব্যাপার, তবু বললাম।’
‘তিনি কি বললেন?’
‘ভাইয়া বলল, কুকুর বিড়ালও তো মানুষকে ভালবাসে। ভালবাসা কোন ব্যাপার না।’
‘আপনি আলাদা হয়ে যাবার কথা ভাবছেন না তো?’
‘যখন ভাইয়ার কথা শুনি, তখন তার কথাই ঠিক মনে হয়। আবার যখন ওকে দেখি এত মায়া লাগে!’
আমি যূথীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললাম, একটা গোপন কথা বলছি, আপনাদের দু’জনের একসঙ্গে থাকা ভয়ংকর জরুরি।
‘জরুরি কেন?’
‘আপনাদের দু’জনকে নিয়ে প্রকৃতির বড় ধরনের কোন পরিকল্পনা আছে।
আমার মনে হয়, আপনারা জন্ম দেবেন এমন একটি শিশু, যে ভুবনবিখ্যাত হবে।’
যূথী একই সঙ্গে অবিশ্বাসী ও আনন্দিত গলায় বলল, এসব কে বলল আপনাকে?
‘কেউ বলেনি। আমি অনুমান করছি। আপনাদের দু’জনের চরিত্রে কোন মিল নেই আবার একইসঙ্গে অসম্ভব মিল। ও আপনাকে যে পরিমাণ ভালবাসে আপনিও তাকে ঠিক সেই পরিমাণ ভালবাসেন। আবার ভালবাসেনও না। আবার দু’জনের চরিত্রে এক ধরনের নির্লিপ্ততা আছে। যেন কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না। চোরের টিভি নিয়ে যাওয়া এবং বাড়ির প্রধান ব্যক্তির মৃত্যু—দুটি ঘটনা আপনাদের কাছে এক রকম। মায়ের মৃত্যুতে রফিক নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করেনি??
‘না করেনি।’
‘আপনি যে নিজ থেকে চলে এসেছেন এই নিয়েও সে নিশ্চয়ই কোন মাতামাতি করেনি।’
‘মাতামাতি করা ওর স্বভাব না। মা মারা গেছে, একফোটা চোখের জল নেই। আরাম করে ঘুমাচ্ছে।’
‘আপনিও শুয়ে পড়ুন। তিনদিন তিনরাত ঘুম হয়নি। নিশ্চয়ই আপনার ও ঘুম পাচ্ছে। আর আমার কথা হেলাফেলা করে ফেলে দেবেন না। আমার ইনট্যুইশন ক্ষমতা খুব ভাল। আপনাদের দু’জনের ব্যাপারে যা বলছি তা শুধু অনুমান থেকে বলছি না, ইনট্যুইশন থেকে বলছি। আপনি ওকে ছেড়ে যাবেন না।’
‘ছেড়ে তো যাচ্ছি না। ছেড়ে যাবার কথা বলছেন কেন?’
‘রফিকের চাকরি-বাকরি নেই। ও এখন নানান অভাব অনটনের মধ্যে থাকবে। আপনার ভাইয়া ক্রমাগল আপনাকে বুঝিয়ে যাবেন, এই জন্যেই বলছি। প্রকৃতির সুন্দর একটা পরিকল্পনা নষ্ট করা ঠিক হবে না।’
‘যূথী গম্ভীর গলায় বলল, পরিকল্পনা যদি প্রকৃতির হয় তাহলে তো প্রকৃতিই সেই পরিকল্পনা নষ্ট হতে দেবে না।’
‘প্রকৃতি তার পরিকল্পনা ঠিক রাখার চেষ্টা খানিকটা করে। বেশি না। দু’জন স্বাধীন মানুষকে প্রকৃতি দড়ি দিয়ে পাশাপাশি বেঁধে রাখবে না।’
যূথী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে খিল খিল করে হেসে উঠল। রফিকের ঘুম ভাঙল হাসির শব্দে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে এল। আমাকে দেখে মোটেই বিস্মিত হল না। যেন এটাই স্বাভাবিক। সে আমার সামনে বসতে বসতে বলল, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, তুই মোটেই দুঃস্বপ্ন দেখিস নি। সুবেহ সাদেকের সময় কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে না। রফিক শুকনো মুখে বলল, আমি তো দেখলাম। মাকে স্বপ্নে দেখলাম। মা বলল, এই রফিক তোর তো চাকরি বাকরি কিছু হবে না। তুই খাবি কি? বৌমা সঙ্গে থাকলেও একটা কথা ছিল। সেও থাকবে না।
আমি আবার বললাম, সুবেহ সাদেকের সময় কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে না। তোর ঠিকই চাকরি হবে আর যূথীও তোকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।
‘স্বপ্নটা এত স্পষ্ট। মা আমার বিছানার পাশে বসেছিল। আমার বাঁ হাতটা ধরেছিল।’
যূথী আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল। কে বলবে আজই এ বাড়িতে একজন মানুষ মারা গেছে। হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে বোধহয় বিড়ালটা ঘরে ঢুকেছে। সম্ভবত সে বুঝতে পারছে এ বাড়িতে এখন আর মৃতের ছায়া নেই।
দরজার ওপাশে – ০৬
পত্রিকার প্রথম পাতার খবর ছাপা হয়েছে। শিরোনামঃ মন্ত্রী অপসারিত। তদন্ত টিম। মোবারক হোসেন সাহেবের যে ছবি হয়েছে তা দেখে সবার মনে হতে পারে, তিনি অপসারিত হওয়ার কারণে খুব সুন্দর আনন্দ পাচ্ছেন। তাঁর মুখ হাসিতে ভরা। ডান হাতের দু’টি আঙ্গুলে বিজয়ের ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন। সাংবাদিকদের রসবোধ প্রবল। বেছে বেছে এই ছবিটিই তারা ছেপেছে।
ভেতর খবরের সঙ্গে বিজয়ের ‘ভি’ চিহ্ন মোটেই সম্পর্কিত নয়। খবর হল—মোবারক হোসেন মন্ত্রী থাকাকালিন সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারে ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন করেছেন। সরকার এই সমস্ত অভিযোগ তদন্তের জন্যে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছেন। মন্ত্রীর পাসপোর্ট আটক করা হয়েছে এবং তাঁর দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
জমাট খবর। বিশেষ প্রতিবেদকের নেয়া ইন্টারভ্যু ছাপা হয়েছেঃ
প্রতিবেদকঃ আপনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কি?
মোবারকঃ আটাচল্লিশ ঘণ্টা পর আপনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছেন?
প্রতিবেদকঃ খবর শোনার পর পর আপনার মনের অবস্থা কি হয়েছিল?
মোবারকঃ বিস্মিত হয়েছিলাম।
প্রতিবেদকঃ দুঃখিত হন নি?
মোবারকঃ দুঃখিত হবার কারণ ঘটেনি। মন্ত্রীত্ব এমন লোভনীয় কিছু না।
প্রতিবেদকঃ মন্ত্রীত্ব লোভনীয় না হতে পারে, কিন্তু শোনা যাচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হতে পারে।
মোবারকঃ হতে পারে বলছেন কেন? অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হওয়াটাই কি অবশ্যম্ভাবী নয়?
প্রতিবেদকঃ আপনার কি ধারণা, অভিযোগ প্রমাণিত হবে?
মোবারকঃ অভিযোগ কি তাই এখনো জানি না। জানলে বুঝতে পারতাম অভিযোগ প্রমাণিত হবে কি-না।
প্রতিবেদকঃ আপনার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এটা কি সত্য?
মোবারকঃ সত্য নয়। আমার পাসপোর্ট আমার সঙ্গেই আছে। সঙ্গে না থাকলেও কোন ক্ষতি ছিল না। এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যাবার আমার কোন ইচ্ছা নেই।
প্রতিবেদকঃ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যা কি?
মোবারকঃ ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে। এর বেশি কিছু না।
প্রতিবেদকঃ আপনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবার কথা ভাবছেন, এটা কি সত্যি?
মোবারকঃ আমি নিজে কি ভাবছি না ভাবছি তা আমার চেয়ে সাংবাদিকরা বেশি জানেন বলে সব সময় লক্ষ্য করেছি। কাজেই কিছু বলতে চাচ্ছি না।
ইন্টারভ্যু এখানে শেষ হলেও ‘স্টোরি’ শেষ না। প্রতিবেদক এর পরেও কিছু লিখেছেন। যেমন, প্রাক্তন মন্ত্রী মহোদয়কে সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। যদিও এই আপাতঃখুশির পুরোটাই যে অভিনয় তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না। কারণ এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি প্রাক্তন মন্ত্রী মহোদয়ের পারিবারিক জীবনেও সংকট দেখা যাচ্ছে। তাঁর একমাত্র পুত্র দীর্ঘদিন যাবৎ নিখোঁজ। ব্যাপক অনুসন্ধানেও তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাক্তন মন্ত্রী মহোদয়কে তাঁর পুত্র সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন—“নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করব না।” প্রক্তান মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রীও গুরুতর অসুস্থতার কারণে সম্প্রতি গুলশানের এক ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রক্তান মন্ত্রীর একমাত্র কন্যাও মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি দীর্ঘদিন যাবত একজন মনোবিশ্লেষণ চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন। জানা গেছে, তার অসুস্থতা সম্প্রতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
খবরের কাগজের কোন খবর দ্বিতীয়বার পড়া যায় না। এটাই আমি দ্বিতীয়বার পড়লাম। দ্বিতীয়বার পড়ে মনে হল, প্রতিবেদক সাক্ষাৎকারে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। মোবারক হোসেন সাহেব তাঁকে কোনঠাসা করে ফেলেছিলেন। সেই শোধ তিনি নিয়েছেন কন্যার অসুস্থতার খবর দিয়ে। সত্যের সঙ্গে খানিকটা মিথ্যা চুকিয়ে দিয়েছেন।
“দশটি সত্যের সঙ্গে একটা মিথ্যা মিশিয়ে দাও, দেখবে মিথ্যটি সত্য বলে মনে হবে। কেউ এই মিথ্যা আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু দশটি মিথ্যার সঙ্গে যদি একটি সত্যি মিশাও তাহলেও কিন্তু সত্য সত্যই থাকবে। মিথ্যা হবে না।”
এটা আমার বাবার বাণী নয়, এটা আমার নিজের কথা। এসব এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে আছে। পরীক্ষা শেষ হলে আমি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হই, তাহলে লিখে ফেলা যাবে।
মোবারক হোসেন সাহেবের বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার। কখন যাব বুঝতে পারছি না। সবচে’ভাল হয় গভীর রাতে উপস্থিত হলে। রাত দশটায় কোন বিশিষ্ট মানুষের বাড়িতে গেলে সম্ভাবনা প্রায় একশ’ভাগ যে বলা হবে এত রাতে উনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। এগারোটার দিকে গেলে বলা হবে উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু রাত একটার উপস্থিত হলে সম্ভাবনা প্রায় নব্বই ভাগ যে বিশিষ্ট ব্যক্তি উদ্বিগ্ন মুখে উঠে আসবেন। কাজেই গভীর রাতের দিকে যাওয়াই ভাল।
আমি পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম , বড় ফুপার অফিসে যাব। মাসের এক তারিখ। টাকাটা নিয়ে আসা দরকার। টাকা পেলে এ মাসেও ফুপার বাড়িতে যাব না। ফুপা অফিসে ছিলেন। আমাকে দেখে বিরস গলায় বললেন , এসো এসো । মনে মনে তোমাকে এক্সপেক্ট করছিলাম।
‘টাকা নিতে এসেছি,ফুপা।’
‘বুঝতে পারছি। টাকার কথা সবারই মনে থাকে। সৎসারত্যাগী সাধু-সন্ন্যাসীদের সবচে’বেশি মনে থাকে। বোস চা খাও।’
‘আপনার সামনাসামনি বসব, না খানিকটা দূরে বসব?’
‘সামনেই বস।’
‘আপনি ভাল আছেন তো ফুপা?’
‘ভাল আছি। বাসার অন্য সবাইও ভাল আছে। কাজেই সামাজিক প্রশ্ন-উত্তরপর্ব শেষ। চা কি দিতে বলব?’
‘কফি দিতে বলুন। বড়দরের কোন অফিসারের কাছে গেলে কফি খেতে ইচ্ছে করে।’
‘ইচ্ছে করলেও খেতে পারবে না। কফি নেই।’
‘বেশ, তাহলে চা।’
ফুপা চায়ের কথা বললেন। তার সেক্রেটারিকে বললেন, খানিক্ষণ ব্যস্ত থাকবেন। কেউ যেন না আসে। ফুপার মুখ থেকে বিরস ভাবটা কেটে যেতে শুরু করেছে।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
ফুপা ভুরু কুঁচকে বললেন, স্যার বলছ কেন? তোমার উদ্রট ধরনের রসিকতা আমার সঙ্গে কখনো করবে না। আমি তোমাকে গোটাদশকে প্রশ্ন করব। তুমি ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ এর মধ্যে জবাব দেবে।
‘সব প্রশ্নের জবাব তো ফুপা ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দিয়ে দেয়া যায় না।’
‘আমি এমনভাবে প্রশ্ন করব যেন ‘হ্যাঁ’ ‘না’ দিয়ে জবাব দেয়া যায়।’
‘ফুপা, কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ দিয়ে জবাব দিলেও জবাব সম্পূর্ণ হয় না। যেমন আমি এখন আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি যার জবাব ‘হ্যাঁ’ ‘না’ দিয়ে দেয়া সম্ভব, কিন্তু জবাব হয় না।’
‘উদাহরণ দাও।’
‘যেমন ধরুন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি আগে যেমন চুরি করতেন এখনো কি করেন? এর উত্তর কি ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দিয়ে হবে? আপনি যদি বলেন ‘না, তার মানে হবে এখন আপনি চুরি করেন না ঠিকই কিন্তু আগে করতেন।’
‘চুপ কর।’
‘জ্বি ফুপা, চুপ করলাম।’
‘তোমার টাকা আলাদা করে রেখেছি, নিয়ে যাও।’
‘থ্যাংকস।’
চা দিয়ে গেছে। ফুপা গম্ভীর মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে অষুধ খাচ্ছেন। অথচ চা-টা ভাল হয়েছে। এসি লাগানো ঠাণ্ডা ঘরে বসে গরম চা খাওয়ার আনন্দই আলাদা ।
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘তুমি কি মিথ্যা কথা বল?’
‘আগে কম বলতাম, এখন একটু বেশি বলি।’
‘কেন বল?’
‘একটা পরীক্ষা করছি ফুপা। দশটা সত্যের সঙ্গে একটা মিথ্যা বলে পরীক্ষা করছি সত্যের ক্ষমতা কেমন। এক ধরনেরে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা…’
‘থাম।’
‘আমি থামলাম। ফুপা ড্রয়ার থেকে খাম বের করলেন। তিনি টাকা ঠিকই আলাদা করে রেখেছেন। খামের উপর আমার নাম লেখা।
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘মিথ্যা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করব সত্যিই জবাব দেবে। তুমি আমার বাড়িতে যাওনি ঠিকই কিন্তু আমার ধারণা বাদল এর মধ্যে কয়েকবার তোমার সঙ্গে দেখা করেছে। সত্যি না মিথ্যা?’
‘আংশিক সত্য। কয়েকবার আসেনি। একবার এসেছে। তবে বেশিক্ষণ ছিল না। অল্প কিছু সময় ছিল।’
‘আমরা ধারণা, এই আধঘণ্টা তুমি তাকে গাছ বিষয়ক কোন বক্তৃতা দিয়েছে।’
‘আপরার ধারণা, সত্যি। আমি গাছের রোগ নিরাময়ের ক্ষমতার কথা ওকে বলেছি। আফ্রিকান জুলু জাতির মধ্যে এক ধরনের নিয়ম প্রচলিত। গুরুতর অসুস্থ কোন মানুষ শেষ চিকিৎসা হিসেবে স্বাস্থ্যবান কোন গাছকে জড়িয়ে ধরে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। তাদের ধারণা, এতে গাছ তাকে জীবনীশক্তি দেয়। প্রায় সময়ই দেখা যায় স্বাস্থ্যবান গাছটা রোগগ্রস্ত হয়, মানুষটা সেরে উঠে।’
ফুপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমিও তাই ধারণা করেছিলাম। ও আইডিয়া পেয়েছে তোমার কাছ থেকে। কয়েকদিন ধরেই দেখছি ও আমাদের বাড়ির পেছনের আমগাছটা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এসব কি? জবাব দেয় না, হাসে।’
‘ওর তো কোন অসুখ-বিসুখ নেই। শুধু শুধু গাছ জড়িয়ে ধরে আছে কেন?’
‘অসুখ-বিসুখ নেই বলছ কেন? ওর অসুখ ওর মাথায়। ওর ব্রেইন ডিফেক্ট।’
আমি নিচু গলায় বললাম, ব্রেইন ডিফেক্টর ক্ষেত্রে গাছে চিকিৎসায় লাভ হবে কি-না কে জানে। কাজ হলে একটা ইন্টাররেস্টিং ব্যাপার হবে। দেখা যাবে, বাদল সুস্থ হয়ে গেল কিন্তু গাছটার হয়ে গেল ব্রেইন ডিফেক্ট।
‘হিমু, তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছ?’
‘জ্বি না, ফুপা। আমি সিরিয়াসলি ভাবছি—গাছের ব্রেইন ডিফেক্ট হয় কি না।
যদি হয় তাহলে গাছ কি করে?’
শোন হিমু, তোমার কাছে আমি আরেকটা প্রপোজাল দিচ্ছি।’
‘দিন।’
‘তুমি এই মেস ছেড়ে দিয়ে অন্য মেসে যাও, যাতে বাদল তোমাকে খুঁজে বের করতে না পারে। পাঁচশ’র বদলে আমি তোমাকে এক হাজার করে টাকা দেব। শুধু তাই না। আই উইল রিমেইন এভারগ্রেটফূল। ছেলেটাকে তোমার ইনফ্লুয়েন্স থেকে বাঁচাতে হবে। সবচে’ ভাল হত যদি তোমাকে সারিয়ে তোলা যেত। এতে সমাজের একটা উপকার হত। আচ্ছা, তুমি কি বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হবার কথা ভাব?’
‘প্রায়ই ভাবি।’
‘তাহলে বিয়ে করে ফেল। বিয়ের যাবতীয় খরচ আমি দেব। একটা শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে কর। আমি মেয়েটার জন্যে ছেড়ে দেব। ধীরে সুস্থে তোমরা আলাদা সংসার শুরু করবে।’
‘প্রস্তাব খুব লোভনীয় মনে হচ্ছে ফুপা।’
‘আমি শুধু যে প্রস্তাব দিচ্ছি তাই না—আই মিন ইট। তোমার যে একজন পরিচিত মেয়ে আছে—রুপা, ও কি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?’
‘আছে।’
‘Then call her.ask her.’
ফুপা টেলিফোন সেট এগিয়ে দিলেন। আমি হালকা গলায় বললাম. এত তাড়া কিসের ফুপা?
‘তাড়া আছে। তুমি টেলিফোন কর; আমার সামনে কথা বলতে তোমার যদি অস্বস্তিবোধ হয় আমি উঠে যাচ্ছি।’
‘আপনাকে উঠতে হবে না।’
রুপাকে পাওয়া গেল। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কেমন আছ রুপা? সে অনেক্ষণ কোন কথা বলল না।
‘হ্যালো রুপা?’
‘বল,শুনছি।’
‘পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?’
‘ভাল।’
‘কি রকম ভাল?’
‘বেশ ভাল। তুমি হঠাৎ এতদিন পর টেলিফোন করলে কি মনে করে?’
‘জরুরি কাজে টেলিফোন করলাম।’
‘আমার সঙ্গে তো কোন জরুরি কাজ থাকার কথা না।’
‘রেগে রেগে কথা বলছ কেন, রুপা?’
‘রেগে রেগে কথা বলার কারণ আছে বলেই রেগে রেগে বলছি। তুমি তোমার আস্তানা আবার বদলেছ। পুরানো ঠিকানায় খোঁজ নিতে গিয়ে আমি হতভম্ব। তুমি যে ঘরে থাকতে সেখানে গুণ্ডা ধরনের এক লোক লাল রঙের একটা হাফপেণ্ট পরে শুয়েছিল। আমি হতভম্ব। কি যে ভয় পেয়েছিলাম! তোমার কি উচিত ছিল না আমাকে ঠিকানা বদলের ব্যাপারটা জানানো?’
‘অবশ্যই উচিত ছিল।’
‘তোমার কি উচিত ছিল না আমার জন্মদিনে আসা? আমি রাত এগারোটা পর্যন্ত তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছি। থাক এসব, এখন তোমার জরুরি কথা বল।’
‘রূপা, তুমি কি বিয়ের কথা ভাবছ?’
‘কি বললে?’
‘তুমি বিয়ে-টিয়ের কথা ভাবছ না-কি?’
‘পরিষ্কার করে বল কি বলতে চাও?’
‘জানতে চাচ্ছিলাম—আমি যদি তোমাকে বিয়ের কথা বলি, তুমি কি রাজি হবে? অল্প কথায় উত্তর দাও। কুইজ ধরনের প্রশ্ন। হ্যাঁ অথবা না।
রূপা শীতল গলায় বলল, তোমার এ জাতীয় রসিকতার আমার ভাল লাগে না। তুমি যে জীবন যাপন কর তাতে এ ধরনের রসিকতার হয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। আমার জীবনে নেই। তুমি নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্ট তোমার জীবন নিয়ে করতে পার। আমি পারি না।
‘তুমি আসল প্রশ্নের উত্তর দাও নি।’
‘সত্যি যদি উত্তর চাও তাহলে বলছি—তুমি চাইলে আমি রাজি হব। আমি জানি তা হবে আমার জীবনের সবচে’ বড় ভুল। তারপরেও রাজি হব। আমি যে রাজি হব তাও কিন্তু তোমার জানা।’
‘আচ্ছা রূপা রাখি, কেমন?’
টেলিফোন নামিয়ে আমি করুণ চোখে ফুপার দিকে তাকালাম। ফুপা বললেন, মেয়ে কি বলল? আমি র্দীঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, হেসে ফেলল। এখনো বোধহয় হাসছে। আপনরা কথায় টেলিফোন করতে গিয়ে আমি একটা লজ্জার মধ্যে পড়লাম। রূপা এমনভাবে হাসছে যেন পাগলের প্রলাপ শুনল। ফুপা আজ উঠি?
ফুপা ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ তারিখ কত?
‘আজ হল আপনার ২২ চৈত্র।’
‘বাংলা তারিখ দিয়ে কি করব? ইংরেজীটা বল।’
‘এপ্রিলের পাঁচ তারিখ।’
‘দিন তারিখ কি সব মুখস্থ থাকে?’
‘সব দিন থাকে না। আজকেরটা আছে। আজ পূর্ণিমা। প্রতিপাদ শুরু হবে ১/১৫/৫৫-এ’
‘প্রতিপাদ ব্যাপারটা কি?’
ব্যাপারটা কি বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই ফুপা আমাকে থামিয়ে দিলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, তুমি যাও। পূর্ণিমা দেখ গিয়ে। ভাল করে দেখ।
আসলেই অনেকদিন পূর্ণিমা দেখা হচ্ছ না। জোছনা রাতে পথে বের হলেই পূর্ণিমা দেখা যায় না। তার জন্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি লাগে।
পূর্ণিমা দেখতে হলে শরীর হালকা করতে হয় । সারাদিন কখনো গুরুভোজন করা যাবে না। অল্প আহার – ফলমূল, দুধ। দিনে কখনো চোখ মেলা যাবে না। সূর্যলোক দেখা বা গায়ে রোদ লাগানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ। চাঁদ আকাশের মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠলে তবেই চোখ মেলা যাবে। তবে তার আগে বরফ-শীতল পানিতে গোসল করে নিতে হবে। পূর্ণিমা দেখতে হবে বনে গিয়ে। আশেপাশে ইলেকট্রিকের আলো, কূপীর আলো বা মোমের আলো কিছুই থাকবে না। জোছনা দেখা যাবে, তবে চাঁদের দিকে একবারও তাকানো যাবে না। সঙ্গে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি থাকতে পারবে না।
এমন কঠিন নিয়ম-কানুনে এখনো জোছনা দেখা হয়নি। তাছাড়া এভাবে জোছনা দেখা দুর্বলচিত্ত মানুষের জন্যে নিষিদ্ধ। এরা সৌন্দর্যের এই রূপ সহ্য করতে পারে না। প্রচণ্ড ভাবাবেশ হয়। যার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। জোছনার অলৌকিক জগতে একবার ঢুকে গেলে লৌকিক জগতে ফিরে আসা নাকি কখনোই সম্ভব হয় না।
খুব শিগগিরই এক রাতে জোছনা দেখতে যাব। এদিকের কাজটা একটু গুছিয়ে নেই। রফিকের সমস্যাটা মিটে যাক। মনে অশান্তি রেখে চন্দ্রস্নাত পৃথিবী দেখার নিয়ম নেই।
দরজার ওপাশে – ০৭
বেল টিপতেই মোবারক হোসেন সাহেব নিজেই দরজা খুলে দিলেন। সহজ গলায় বললেন,এস হিমু। যেন তিনি আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
সাধারণ মানুষ থেকে মন্ত্রী পর্যায়ে উঠা খুব কঠিন, কিন্তু নেমে আসাটা অত্যন্ত সহজ। মোবারক সাহেবকে দেখে তাই মনে হচ্ছে। উনার পরণে সাদা লুঙ্গি। খালি গা। কাঁধে ভেজা গামছা।
তিনি সহজ গলায় বললেন, শরীরটা তেতে আছে। ভিজে গামছা দিয়ে রাখলাম। এতে শীরর ঠাণ্ডা থাকে। কোন খবর আছে হিমু?
‘না কোন খবর নেই। আপনার খবর নিতে এসেছি।’
‘আমার খবর নেবার জন্যে তো বাড়িতে আসার দরকার পড়ে না। পত্রপত্রিকায় রোজই কিছু না কিছু বেরুচ্ছে। পত্রিকা পড় না?’
‘মাঝে মাঝে পড়ি।’
‘আমার খবর সব আপ-টু-ডেট জান তো?’
‘কিছু কিছু জানি।’
‘ব্যাংক একাউণ্ট ফ্রীজ করা হয়েছে, এটা জান?’
‘না।’
‘ব্যাংক একাউণ্ট ফ্রীজ করা হয়েছে। বুদ্ধিমান লোক মাঝে মাঝে প্রথম শ্রেণীর বোকার মত কাজ করে, আমিও তাই করেছি। টাকা-পয়সা অনেক ব্যাংকেই ছিল। ছিল আমার নিজের নামে। কিছু যে অন্যের নামে রাখা দরকার, কিছু ক্যাশ দরকার, এটা কখনো মনে হয়নি।’
‘আপনার ব্যাংকে কত টাকা আছে?’
জবাব দেবার আগে মোবারক সাহেব কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, পাঁচ কোটি টাকার মত।
আমার ঠিক আগের মত বারান্দায় বসলাম। মোবারক হোসেন সাহেব ইজিচেয়ারে শুয়ে মোড়ায় পা তুলে দিলেন। তিতলীকে ডেকে বললেন টক দৈ দিতে।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘পাঁচ কোটি টাকা আছে জানার পরেও তুমি দেখি তেমন অবাক হওনি। পাঁচ কোটি টাকা যে কত টাকা সে সম্পর্কে বোধহয় তোমার ধারণা নেই।’
‘অনেক টাকা বুঝতে পারছি।’
‘পারছ বলে মনে হয় না। অনেক তো বটেই । সেই অনেকটা কত অনেক তা কি জান? পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে কি করা যায় বল তো?’
‘পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে দিয়াশলাই কেনা যায়। একটা দেয়াশলাইয়ের দাম এক টাকা। তবে একসঙ্গে এত টাকার দেয়াশলাই কিনলে কিছুটা বোধহয় সস্তায় দেবে। আট আনা পিস পাওয়া যেতে পারে। তাহলে দশ কোটি দেয়াশলাই পাওয়া যাবে। এই জীবনে আর দেয়াশলাই কিনতে হবে না।’
‘তুমি ব্যাপারটাকে ফানি সাইডে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছ। ফানি সাইডে নেবার দরকার নেই—পাঁচ কোটি টাকা যে কি পরিমাণ টাকা আমি অন্যভাবে তোমাকে ধারণা দেই। ধর, টাকাটা তুমি যদি শুধু ব্যাংকে রেখে দাও তাহলে কি হবে? ফিফটিন পারসেন্ট রেটে ইন্টারেস্ট কত আসে? মনে মনে হিসেব করতে পার। ফাইভ টাইমস ফিফটিন, ডিভাইডেড বাই….’
আমি তাকিয়ে আছি । মোবারক হোসেন সাহেব চোখ বন্ধ করে হিসেব করে যাচ্ছেন। তিতলী যখন এসে বলল, বাবা দৈ নাও, তখন বিরক্ত মুখে চোখ মেললেন। তাঁর হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। অসময়ে আসার জন্যে তিনি মেয়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। তিতলী বলল, বাবা, আমি তোদের সঙ্গে বসব?’
‘আমাদের সঙ্গে বসার দরকার কি?’
‘বারান্দায় চা দিতে বলেছি এই জন্যেই বসতে চাচ্ছি।’
সে আমার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল। বাবাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাকে বলল, ভাইয়ার কোন খোঁজ পেয়েছেন?
‘না।’
‘খোঁজার চেষ্টা করেছেন?’
‘না, তাও করিনি।’
‘এই সত্যি কথাটি যে বললেন, তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। এসেছেন কি জন্যে? আমাদের দুর্দশা দেখতে?’
আমি সহজ গলায় বললাম, আমি আসলে একটা সুপারিশ নিয়ে এসেছি। একজনের চাকরি-বিষয়ে একটা সুপারিশ। আমার এক বন্ধুর চাকরি চলে গেছে। পুরোপুরি এখনো যায়নি, সামান্য সুতায় ঝুলছে। আপনার বাবার সুপারিশে হয়ত তার চাকরিটা হবে।
তিতলী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। মোবারক হোসেন সাহেব কৌতুহলী গলায় বললেন, তুমি কি সত্যি সুপারিশ নিতে এসেছ?
‘জ্বি স্যার। সবাই তো মন্ত্রীত্ব থাকাকালিন সময়ে নানান সুপারিশ নিয়ে আসে, আমি এসেছি যখন আপনার মন্ত্রীত্ব নেই। কিছুই নেই।’
‘তুমি তাহলে জেনেশুনেই এসেছ আমার সুপারিশে কাজ হবে না?’
‘তা নয় স্যার। আমি জানি, আপনার সুপারিশে এখন অনেক বেশি কাজ হবে। কারণ সবাই জানে, আপনি আবার স্টেজে আসবেন। আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যদিও এখন আপনি কেউ না—নো বডি; তবু ভবিষৎতের কথা ভেবে তারা আপনাকে খুশি রাখবে।’
‘যার সুপারিশ করতে এসেছে তার নাম কি? সুপারিশ কার কাছে করতে হবে?’
আমি পকেট থেকে কাগজ বের করতে করতে বললাম, সব এখানে লেখা আছে স্যার। ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর নাম রফিক।
‘তুমি বস, আমি টেলিফোন করে দেখি। তোমার কথা সত্যি কি-না পরীক্ষা হয়ে যাক।’
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। তিতলী নামের রাগী এবং অহংকারী মেয়েটি আমার সামনে বসে আছে। তার ঠোঁট হাসির ক্ষীণ আভাস। কি মনে করে সে হাসছে কে জানে। আমি বললাম, আপনার মা কেমন আছেন?
‘ভাল না।’
‘উনার ঠিকানাটা আমাকে দেবেন,উনাকে একটু দেখতে যাব?’
‘কেন?’
‘এম্নি যাব।’
‘আপনি বিনা উদ্দেশ্যে কিছু করেন না। আপনার কোন একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা বলুন। তারপর ঠিকানা দেব।’
উদ্দেশ্য বলার সময় হল না। মোবারক হোসন সাহেব ফিরে এসেছেন। তিনি ইজিচেয়ারে বসতে বসতে বললেন, হিমু,তুমি তোমার বন্ধুকে আগামীকাল চাকরিতে জয়েন করতে বল। আমি কথা বলেছি।
‘ধন্যবাদ স্যার, আমি তাহলে উঠি?’
‘বোস, চা খেয়ে যাও। চা আনছে।’
এদের বাড়ির বড়বুবু চা দিয়ে গেছে। মোবারক হোসেন সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তিতলী চায়ের কাপ মুখের কাছে নিয়ে নামিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে কিছু বলবে, কি বলবে তা গুছাতে সময় লাগছে। সে বাবার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। মোবারক সাহবে বললেন, তোর কি হয়েছে?
‘কিছু হয়নি।’
‘এরকম করে তাকাচ্ছিস কেন?’
‘যেভাবে আমি তাকাই সেই ভাবেই তাকাচ্ছি।’
‘তুই এখান থেকে যা। আমি হিমুর সঙ্গে কথা বলব।’
‘যা বলার আমার সামনেই বল। আমি কোথাও যাব না।’
সে আবারো চায়ের কাপে মুখের কাছে নিল, আবারো নামিয়ে রাখল। মেয়েটির এই হঠাৎ পরিবর্তনের কোন কারণ ধরতে পারছি না। আমি চা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, স্যার আজ যাই। অন্য আরেক দিন আসব। তিতলী বলল, অন্যদিন টন্যদিন না। আপনি আর এ বাড়িতে আসবেন না। আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানি ভাইয়া নিখোঁজ হয়েছে আপনার কারণে। আপনাকে আমি এত সহজে ছাড়ব না।
আমি আবার বসে পড়লাম। মোবারক সাহেব বললেন, কটা বাজে দেখতো হিমু।
‘স্যার আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই।’
মোবারক সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর ঘড়িতে কটা বাজ মা? তিতলী জবাব না দিয়ে উঠে পড়ল। তেজী ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে গেল। মোবারক সাহেব বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়েটা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ছে। টেনশান নিতে পারছে না। ঘন ঘন ইমোশনাল আউটবাস্ট হচ্ছে। সুখের কথা হচ্ছে এইসব আউটবাস্টের স্থায়িত্ব অল্প। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নেবে। হিমু ঐ শোবার ঘরে ঢুকে দেয়াল ঘড়িতে সময় কত হয়েছে দেখ তো?’
আমি ঘড়ি দেখলাম, ন’টা একুশ। তিনি আবার র্দীঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজের মনে কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, তিতলীর মা’কে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্যে নেয়া দরকার। ব্যাংককের আমেরিকান হাসপাতাল ভাল চিকিৎসা করে সেখানেই নেয়ার কথা, নিতে পারছি না। টাকার সমস্যা তো আছেই, তার চেয়েও বড় সমস্যা আমাকে বাইরে যেতে দেবে না। একজনের কাছে টাকা চেয়েছিলাম, রাত আটটায় তার দিয়ে যাবার কথা। মনে হয় সে আর আসবে না। তোমার কি মনে হয়?
‘না আসার সম্ভাবনাই বেশি।’
‘মানুষকে চেনা বড়ই মুশকিল। যার টাকা নিয়ে আসার কথা সেও বলতে গেলে কোটিপতি।
তাকে কোটিপতি করেছি আমি। প্রয়োজনীয় পারমিটগুলির আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি। হিমু. তোমার কি ধারণা এই পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ আছে?
স্যর. পৃথিবীতে মাত্র দু’ ধরনে মানুষ আছে।’
’দু’ ধরনের?’
’জ্বি. আমি সমস্ত মানুষকে দুভাগে ভাগ করেছি। প্রথম ভাগে আছে ‘হ্যাঁ- মানুষ ।’ এরাই দলে ভারী। বলতে গেলে সবাই এই দলে। মানুষের সব গুণ তাদের মধ্যে আছে, আবার দোষও আছে। কোনটাই বেশি না। সমান সমান। প্রকৃতি সাম্যাবস্থা পছন্দ করে। একটা পরমাণুর কথাই ধরুণ না কেন, পরমাণুতে নেগেটিভ চার্জের যতগুলি ইলেকট্রন আছে পজিটিভ চার্জের ঠিক ততগুলিই প্রোটন আছে।
‘হ্যাঁ মানুষ’গুলি পরমাণুর মত।
দ্বিতীয় দলে আছে, ‘না-মানুষ।’ মানুষের কোন কিছুই তাদের মধ্যে নেই, তারা শুধু দেখতেই মানুষের মত। আসলে এরা পিশাচ ধরনের। প্রকৃতির সাম্যাবস্থা নীতি এদের মধ্যে কাজ করে না। এদের মনে কোন রকম মমতা নেই। একটা খুন করে এসে হাত মুখ ধুয়ে ভাত খাবে, পান খাবে, সিগারেট টানতে টানতে দু’একটা মজার গল্প করে ঘুমুতে যাবে। তাদের ঘুমের কোন সমস্যা হবে না। কারণ ‘না-মানুষ’রা সাধারণত স্বপ্ন দেখে না। আর দেখলেও দুঃস্বপ্ন কখনো দেখে না।’
‘এই জাতীয় মানুষ তুমি দেখেছ?’
‘জ্বি দেখেছি, এই জাতীয় মানুষদের সঙ্গে আমি অনেকদিন ছিলাম। আমরা মামারা সবাই এই জাতীয় মানুষ।’
‘‘বল কি?’
‘‘আমার বড় মামা নিজে খুন হয়েছিলেন। কিন্তু লোকজন মাছ মারার বড় থোর দিয়ে তাঁকে এফোড় ওফোড় করে ফেলেছিল। এই অবস্থাতেও তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ ডেথ বেড কনফেসন করে চারজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন এরাই তাকে মেরেছে। ডেথ বেড কনফেসনের কারণে ঐ চারজনের যাবজ্জীবন হয়ে গেছে।’
‘আশ্চার্য।’
‘আমার মেজো মামা গোটা পাঁচেক খুন করেছেন। অতি ধুরুন্দর ব্যক্তি। তাকে কেউ ফাঁসাতে পারেনি। বহাল তবিয়তে এখনো বেঁচে আছেন—সত্তুরের উপর বয়স। চোখে দেখতে পান না। কেউ কাছে গিয়ে বসলে খুনের গল্প করেন। এই গল্প বলতে পারলে খুব আনন্দ পান। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি মানুষ জবেহ করলে কণ্ঠনালী দিয়ে ফুস করে বাতাস বের হয়।’
‘চুপ কর।’
আমি গল্প থামিয়ে মোবারক সাহেবের মতই পা নাচাতে লাগলাম। মোবারক সাহেব আধশোয়া অবস্থা উঠে বসলেন, তিক্ত গলায় বললেন, ‘অবলীলায় তুমি এই গল্প করলে। তোমার খারাপ লাগলনা?’
‘না।’
‘ওদের রক্ততো তোমার শরীরেও আছে।’
‘ তা আছে। আমার বাবা দেখে শুনে ঐ পরিবারে বিয়ে করেছিলেন যাতে আমি মায়ের দিক থেকে তেইশটি ভয়াবহ ক্রমোজম নিয়ে আসতে পারি।’
‘আনতে পেরেছ?’
‘ঠিক ধরতে পারছি না।’
‘না-মানুষদের কথা শুনলাম। সাধু সন্ন্যাসীরা কোন শ্রেণীর? যারা মহাপুরুষ তাদের দলটা কি?’
‘তারাও না-মানুষ। পিশাচ এবং মহাপুরুষ সবাই এক দলে। এরা মানুষ নন।’
‘এই জাতীয় কথাবার্তা কি তুমি সব সময় বল, না আজ আমাকে বলছ?’
‘সব সময় বলার সুযোগ হয় না। সুযোগ হলে বলার চেষ্টা করি। আমার কিছু শিষ্য আছে। এরা আগ্রহ করে আমার কথা শুনে, বিশ্বাসও করে।’
‘তুমি নিজেকে কোন দলে ফেল?’ না-মানুষে’র দলে?’
‘জ্বি না। তবে ‘না-মানুষ’ হবার চেষ্টা করছি,যদিওবা জানি চেষ্টা করে ‘না-মানুষ’ হওয়া খুব কঠিন। জন্মসুত্রে হতে হয়। আপনি যেমন জন্মসূত্রে না-মানুষ।’
‘পিশাচ অর্থে বলছ নিশ্চয়ই।’
‘জ্বি পিশাচ অর্থেই বলছি। তবে পিশাচ ‘না-মানুষ’দের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এরা খুব সহজেই মহাপুরুষ ‘না-মানুষ’ হতে পারে। ‘হ্যাঁ-মানুষ’রা তা কখনোই পারবে না।’
‘তুমি কি আমাকে ‘প্রীচ’ করার জন্যে এসব কথা বলছ?’
‘জ্বি-না, আমি ধর্ম প্রচারক না। আমি একজন সাধারণ ‘হ্যাঁ-মানুষ’, যে একজন বন্ধুর চাকরির জন্যে মন্ত্রীর কাছে ছোটাছুটি করে। মহাপুরুষরা এই কাজ কখনো করবেন না। তাঁদের মমতা কখনো একজনের জন্যে না—অনেকের জন্যে। তাঁরা ব্যক্তিকে দেখেন না, তাঁরা সমস্টিকে দেখেন।’
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘যাও বাড়ি যাও। একটা কথা তোমাকে বলি—তুমি অতিশয় ধুরন্দর ব্যক্তি। সূঁচ হয়ে ঢোকার চেষ্টায় আছ। আমার ব্যাপারে এই চেষ্টা করবে না। শিষ্য হবার বয়স আমার না। এই বয়সে তোমার শিষ্য হবে এরকম মনে করার কোন কারণ ঘটেনি। আল্লা,খোদা, পাপ, পুণ্য এসব নিয়ে আমি কোন দিনই মাথা ঘামাইনি। ভবিষ্যতেও ঘামাব না। যাবার আগে আরেকটি কথা শুনে যাও—তুমি যে কাজে এসেছিলে সে কাজ হয়ে গেছে—বন্ধুর চাকরি হয়েছে। কাজেই এ বাড়িতে আর আসবে না।’
‘জ্বি আচ্ছা স্যার। জহিরের কোন খোঁজ যদি পাই তাহলে কি আসব?’
‘না। তাহলেও আসবে না। ভাল কথা জহিরও কি তোমার শিষ্য?’
‘জ্বি না। এ পর্যন্ত মাত্র দু’জন শিষ্য পেয়েছি। আমার ফুফাতো ভাই বাদল, তার তরঙ্গিনী ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরের সেলস-ম্যান আসাদ।’
‘উপদেশ দেয়া আমার স্বভাব না। তবু একটা উপদেশ দেই, শিষ্যের সংখ্যা আর বাড়িও না।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘তুমি কর কি? কাজকর্মের কথা বলছি না। কাজকর্ম যে কিছু কর না তা বুঝতে পারছি—তারপরেও মানুষ কিছু করে, সেটাই জানতে চাচ্ছি।’
‘আমি ঘুরে বেড়াই। ইন্টারেস্টিং কোন কিছু চোখে পড়লে আগ্রহ নিয়ে দেখি।’
‘একটা ইন্টারেস্টিং জিনিসের কথা বল, তাহলে বুঝতে পারব কোনটা তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং কোনটা নয়।’
‘সব কিছুই আমার কাছে মোটামুটি ইন্টারেস্টিং লাগে। তবে একটা দৃশ্য একবার দেখলেই ইন্টারেস্ট নষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করে না। সেই অর্থে সব ইন্টারেস্টিং জিনিসই মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। দু’একটা বাকি। সেগুলি দেখা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘আমাকে বল,দেখি আমি পারি কি না।’
‘একটা মানুষকে যখন ফাঁসি দেয়া হয় তখন সে কি করে তা আমার খুব দেখার শখ। অর্থাৎ ফাঁসির মঞ্চে উঠবার আগে সে কি করে তাকায়, কিভাবে নিঃশ্বাস নেয়। অবধারিত মৃত্যুর কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মৃত্যুক্ষণ জানি না বলে ব্যাপারটা বুঝতে পারি না। যদি মৃত্যুক্ষণটা জেনে যাই তখন কি হয় সেটাই আমার দেখার বিষয়।’
‘মানুষদের যে দু’টি শ্রেণীর কথা বললে তার বাইরেও একটা শ্রেণী আছে—উণ্মাদ শ্রেণী। তুমি সেই শ্রেণীর। এমন উণ্মাদ যা চট করে বোঝা যায় না। আমার আগে কি তোমাকে এই কথা কেউ বলেছে?’
‘আমার ফুপা প্রায়ই বলেন?’
‘তাঁকে আমার রিগার্ডস দেবে। তিনি নিশ্চয়ই তাঁর বাড়িতে তোমাকে ঢুকতে পাঁচশ টাকা পাই।’
‘শুনে ভাল লাগল। আচ্ছা তুমি যাও। তুমি আমার যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছ, আর না।’
রাস্তায় নেমে অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম কোথায় যাব। রফিককে চাকরির খবরটা দেয়ার জন্যে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া দরকার। যেতে ইচ্ছে করছে না, মাথায় চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে ভয়ংকর ব্যথা আবার আসছে। ব্যথাটা পথের মধ্যে আমাকে কাবু করার আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার। দরজা জানালা বন্ধ করে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে। মাথা ঢেকে রাখতে হবে ভেজা গামছায়। কিছু খেয়ে নেয়াও দরকার। একবার ব্যথা শুরু হলে চব্বিশ ঘণ্টা কিছু মুখে দিতে পারব না। কড়া কিছু ঘুমের অষুধ খেয়ে নিলে হয়? এমন ডোজ খেতে হবে যাতে চব্বিশ ঘণ্টা মরার মত ঘুমিয়ে থাকি। ঘুম ভাঙ্গলে দেখব মাথায় যন্ত্রণা নেই। বড় দেখে একটা ফার্মেসীতে ঢুকে পড়লাম।
‘কড়া কিছু ঘুমের অষুধ দিতে পারবেন?’
‘ফামের্সীর মাঝবয়েসী কর্মচারী নির্লিপ্ত গলায় বলল, ডাক্তারের প্রেক্রিপসন ছাড়া পারব না।’
‘ডাক্তার এখন কোথায় পাব বলুন। বিরাট সমস্যা—আমার এক ছোটভাই আছে মেটাল কেইস। খুব তাড়াতাড়ি করলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এখন খুব বাড়াবাড়ি করছে অথচ ঘরে অষুধ নেই।’
‘উনার প্রেসক্রিপসনটা নিয়ে আসেন।’
‘ছুটে বের হয়ে এসেছি, প্রেসক্রিপসনের কথা মনে ছিল না ভাই। কি যে যন্ত্রণা করছে—লম্বা লাঠি নিয়ে সবাইকে তাড়া করছে। এই সময় কি আর প্রেসক্রিপসনের কথা মনে থাকে?’
‘তাকে কোন অষুধ দেয়া হয় সেটা জানা দরকার না?’
‘এতদিন ফার্মেসী চালাচ্ছেন, আপনি কি ডাক্তারের চেয়ে কম জানেন নাকি? এমন একটা কিছু দিন যাতে চব্বিশঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকে।’
‘হিপনল নিয়ে যান। দশ মিলিগ্রামের চারটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেন। চব্বিশ ঘণ্টা নড়াচড়া করবে না।’
‘মরে যাবে নাতো?’
‘আরে না। মানুষ মরা কি এত সহজ?’
‘খাওয়ার কতক্ষণ পর এ্যাকশন হয়?’
‘আধ ঘণ্টার মধ্যে এ্যাকশন শুরু হবে।’
‘দিন তাহলে চারটা হিপনল।’
চারটা হিপনল ফার্মেসীর কর্মচারীর সামনেই মুখে দিয়ে গিলে ফেললাম। হাসি মুখে বললাম, একগ্লাস পানি দিন—মুখ তিতা লাগছে।
ভদ্রলোক কোন উচ্চবাচ্চ্য করলেন না। তার চোখ অবশ্যি বড় বড় হয়ে গেল। পানি এনে দিলেন। আমি এক চুমুকে পানি খেয়ে হাই তুলতে তুলতে বললাম, একটা টেলিফোন করব। টেলিফোনটা দিন। ভয় নেই, কল পিছু পাঁচটা করে টাকা দেব। আমার বন্ধুকে একটা খবর দিতে হবে। ওর চাকরি হয়েছে সেই খবর। অবশ্যি বন্ধুর বাড়িতে টেলিফোন নেই। ওদের পাশের বাসায় একটা টেলিফোন আছে—অন রিকোয়েষ্ট। অর্থাৎ বিনীত গলায় বললে ওরা ডেকে দেয়।
‘টেলিফোন তালাবন্ধ।’
‘তালাবন্ধ থাকলে খোলবার ব্যবস্থা করুন। যত তাড়াতাড়ি করবেন ততই ভাল। বেশি দেরি হলে আপনার দোকানে ঘুমিয়ে পড়ব। আমার হার্ট খুবই দুর্বল। যে কড়া ঘুমের অষুধ খাইয়েছেন—এখানেই ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যেতে পারে। তখন আপনি বিপদে পড়বেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন ছাড়া ওষুধ দিয়েছেন।’
ভদ্রলোক শংকিত ভঙ্গিতে টেলিফোন বের করে দিলেন। তালাও খোলা হল। আমি ডায়াল করতে করতে বললাম, মিথ্যা কথা বলবেন না ভাই। ছোটখাট মিথ্যা বলতে বলতে পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। একদিন দেখবেন ক্রমাগত মিথ্যা বলছেন। এই যে নাম্বারটা ডায়াল করছি ওদের যখন বলব পাশের বাসার রফিককে একটু ডেকে দিন ওরা বলবে এখন সম্ভব হবে না। বাসায় কাজের লোক নেই। ওরা একটা মিথ্যা কথা বলবে, যে কারণে ওদেরকে রাজি করানোর জন্যে আমাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হবে। মিথ্যা নিয়ে আসি মিথ্যা । সত্য জন্ম দেয় সত্যের। বুঝতে পারছেন তো ভাই সাহেব?
‘হ্যালো?, হ্যালো।’
ও পাশ থেকে অল্প বয়সী মেয়ের গলা পাওয়া গেল। রিণরিণে মিষ্টি গলা, আপনি কাকে চাচ্ছেন?
‘তোমাদের পাশের বাড়ির রফিককে যার মা মারা গেছেন।’
‘উনাকে তো এখন ডাকা যাবে না। আমাদের বাসায় এখন কাজের লোক নেই।
‘কাজের লোক কখন আসবে? অর্থাৎ কখন টেলিফোন করলে রফিককে ডেকে দেয়া যাবে?’]
‘আমাদের কাজের লোকতো ছুটিতে দেশে গেছে। কবে আসবে কে জানে?’
‘তাহলে তো তোমাদের খুব সমস্যা হল।’
‘আপনি কে?’
‘আমি একজন অকাজের লোক। শোন খুকি, এই বয়সেই মিথ্যা কথা বলা শুরু করেছ কেন? রফিককে ডাকা যাবে না এটা সরাসরি বলে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। মাঝখান থেকে মিথ্যা করে কাজের লোকের কথা বলছ।’
‘আমি তো মিথ্যা বলছি না।’
‘বেশ ধরে নিলাম মিথ্যাবলছ না—সত্যি তোমাদের বাসায় কাজের লোক নেই, তাহলেওতো তুমি চট করে তাকে খবরটা দিতে পার। পার না?’
‘না পারি না। কারণ চিকেন পক্স। আমাকে মশারির ভেতর থাকতে হয়।’
‘খুকী, আবার মিথ্যা কথা বলছ? একটা মিথ্যা বললে দশটা মিথ্যা বলতে হয়। কাজের লোক দিয়ে শুরু করেছ—এখন চলে এসেছো জল বসন্তে। আরো খানিকক্ষণ কথা বললে আরো মিথ্যা বলবে।’
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ফেলল। হাসিটা শুনে ভাল লাগল। এত আন্তরিক ভঙ্গির আনন্দময় হাসি অনেকদিন শুনিনি। সঙ্গে সঙ্গে মন ভাল হয়ে গেল। মাথার যন্ত্রণা চট করে খানিকটা কমে গেল। আমি কোমল গলায় বললাম, হাসছ কেন খুকী?
‘আপনার পাগলামী ধরনের কথাবার্তা শুনে খুব মজা লাগল। এই জন্যে হাসছি। আপনি ধরুন, আমি রফিক ভাইয়াকে ডেকে দিচ্ছি।’
মেয়েটি আরো খানিকক্ষণ হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমাকে খুকী খুকী করছেন এই জন্যেও খুব মজা লাগল। আমি মোটেই খুকী না। মেডিক্যাল কলেজে ফিফথ ইয়ারে পড়ি। এবং আমার সত্যি সত্যি চিকেন পক্স। বাসায় শুধু যে কাজের লোক নেই তাই না, কেউই নেই। সবাই বিয়ে বাড়িতে গেছে। আমার খালাত বোনের বিয়ে। আমার কথা কি সত্যি বলে মনে হচ্ছে?
‘হ্যাঁ হচ্ছে।’
‘ধরে থাকুন, আমি ভাইয়াকে ডাকছি।’
‘তাকে ডাকতে হবে না। তাকে শুধু একটা খবর দিয়ে দেবেন যে, তার চাকরির ঝামেলা মিটেছে। সে যেন কালই অফিসে যায়। আর আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।’
‘আপনাকে ক্ষমা করা হল।’
মেয়েটা আবারো হাসছে। আমি টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। মাথার যন্ত্রণা পুরোপুরি চলে গেছে। আমি ফার্মেসীর কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। সে শিউরে উঠল। আমি বললাম, কই ঘুম তো আসছে না। আরো দু’টা হিপনল দিন। এক গ্লাস পানি আনুন। আরেকটা কথা ভাই সাহেব, আপনার দোকানেই আজ ঘুমাব বলে স্থির করেছি। আপনি কি কোন বেঞ্চ-টেঞ্চ দিতে পারেন? ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া ওষুধ দেয়ার বিপদ দেখলেন?
দরজার ওপাশে – ০৮
মোবারক হোসেন সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। নিধু বৈরাগী হত্যা মামলা। চার বছর আগের হত্যাকাণ্ড। নিধু বৈরাগীর ছোটভাই নিতাই বৈরাগীর ছোটভাই নিতাই বৈরাগী চার বছর পর মোবারক হোসেনকে আসামী করে মামলা করেছে। মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে সিআইডি পুলিশের উপর। তদন্তকারী অফিসার সাংবাদিকদের বলেছেন, তদন্তের গতি সন্তোষজনক। এমন সব এভিডেন্দ পাওয়া গেছে যা এত সহজে চট করে পাওয়া যায় না। মোবারক হোসেন সাহেবকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়েছে।
ঐ বাড়িতে আমার যাওয়া নিষেধ, তবু একদিন গেলাম। বাড়ির গেটে তালা ঝুলছে। বিরাট তালা। বাড়ির লোকজন কোথায় কেউ বলতে পারল না। কোথায় গেলে খোঁজ পাওয়া যাবে তাও কেউ জানে না। মানুষজন না থাকলে অতি দ্রুত বাড়ির মৃত্যু ঘটে। বাড়ির আশেপাশে দাঁড়ালেই গা ছমছমানোর ভাব হয়। বাড়ির সামনে পান সিগারেটের দোকানের ছেলেটা বলল, উনার দেশের বাড়ির যান। ঐখানে খোঁজ পাইবেন।
‘দেশের বাড়ি কোথায়?’
‘কুমিল্লা।’
‘কুমিল্লার কোথায়?’
‘তা তো ভাইজান জানি না।’
‘বাড়ি তালাবন্দ থাকে. কেউ খোঁজ নিতে আসে না?’
‘মন্ত্রী সাহেবের মেয়ে একদিন আসছিলেন। খুব কান্নাকাটি করলেন।’
‘কবে এসেছিল?’
তাও ধরেন এক হপ্তা।’
গূলশানের কোন এক ক্লিনিক উনার স্ত্রী ছিলেন। গূলশান এলাকার যত ক্লিনিক ছিল সব খোঁজলাম। মোবারক হোসেনের স্ত্রী তার কোনটিতেই নেই। কোন দিন না-কি ছিলেন ও না। এদের কোন খোঁজ বের করার একমাত্র উপায় হল মোবারক হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করা। সেটা কি করে সম্ভব তাও বুঝতে পারছি না। জেলখানায় গেটে গিয়ে যদি বলি—আমি প্রাক্তন মন্ত্রী মোবারক হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই. তাহলে তারা যে খুব আনন্দের সঙ্গে আমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে তা মনে করার কোন কারণ নেই। নারায়ণগঞ্চ থানার ওসি সাহেবকে টেলিফোন করলাম। উনি যদি কোন সাহায্য করতে পারেন। ভদ্রলোক বিমর্ষ গলায় বললেন—আমি সামন্য ওসি। আমার স্থান চুনোপুটিরও নিচে—আর এই মামলা, রুই-কাতলার মামলা। দেখা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
‘তবু চেষ্টা করে দেখি। কি করতে হবে বলুন তো?’
‘নিয়মকানুন আমিও ঠিক জানি না। ডি আই জি প্রিজনকে এ্যাডড্রেস করে দরখাস্ত করতে হবে। কেন দেখা করতে চান, আসামীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি—সব দরখাস্তে থাকতে হবে। আমি খোঁজ-খবর করে একটা দরখাস্ত না হয় আপনার জবানীতে লিখে নিয়ে আসি।’
‘এতটা কষ্ট আপনি করবেন?’
‘অবশ্যই করব। আপনি বিকেলে আপনার মেসে থাকবেন। আমি সব তৈরি করে নিয়ে আসব। কাজ হবে কি-না তা জানি না।’
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। রাখি তাহলে?’
‘এক সেকেন্ড হিমু সাহেব, আপনি কি দু’মিনিটের জন্যে আমার স্ত্রীকে একটু দেখতে যাবেন? ওকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্যানসার ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছি। এখন সে একেবারে শেষের অবস্থায় আছে। আমি দিনরাত প্রার্থনা করি শেষটা যেন তাড়াতাড়ি আসে। আমি নিজেই সহ্য করতে পারছি না। হিমু সাহেব, ভাই যাবেন? আমি আমার স্ত্রীকে আপনার কথা বলেছি।’
‘আসুন এক সঙ্গে যাব।’
‘ও এখন কথা বলতে পারে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে লিখে জবাব দেয়।’
‘আমি উনাকে কি বলব?’
‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি পাশে কিছুক্ষণ থাকলেই ওর ভাল লাগবে। আপনার সম্পর্কে আমি ওকে বলেছি।’
‘কি বলেছেন?’
‘তেমন কিছু না। বলেছি, আপনি সাধক প্রকৃতির মানুষ। আপনি পাশে দাঁড়ালেই ও সাহস পাবে। অন্য একটা জগতে যাত্রা। সে যাচ্ছে ও একা একা। খুব ভয় পাচ্ছে।’
ওসি সাহেবের গলা ধরে এল। কথা জড়িয়ে এল। আমি শান্ত স্বরে বললাম, ওসি সাহেব, আপনি কাঁদছেন না-কি? সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় বললেন, কাঁদছি না। আমরা পুলিশ। এত সহজে কাঁদলে কি আমাদের চলে?