তোর ব্যাপারটা কি বলবি? প্রথম দিন এসে এই যে ডুব দিলি আর খোঁজ নেই। এদিকে আশা অস্থির হয়ে আছে। ওর ধারণা তোর অসুখবিসুখ করেছে। আমি তাকে বলার চেষ্টা করেছি। অসুখবিসুখ কিছু না— তোর স্বভাবই হল ডুব মারা। তুই তোর স্বভাব মতো ডুব মেরেছিস।
আশাও তোকে একটা চিঠি দিয়েছে। খামের মুখ বন্ধ বলে কী লিখেছে। আমি পড়তে পারি নি। তুই আসার সময় অবশ্যই চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে আসবি। আমি পড়ব। মেয়েটা কেন এত বড় চিঠি লিখল জানা দরকার।
তুই অবশ্যই অবশ্যই চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবি। তোকে আল্লাহর দোহাই লাগে। আমার কথা না শুনলে তোর ওপর আল্লাহর গজব পড়বে।
ইতি
তোর খালা।
খালার চিঠি শেষ করে মুখবন্ধ খাম খুললাম। খামের উপর লেখা HEEMO, হিমু নামের ইংরেজি বানান কি HEEMO?
আশা চিঠিটা লিখেছে ইংরেজিতে। সম্ভোধন হল— Dear Sir. চিঠির ভঙ্গি এ রকম যেন স্কুলের ছাত্রী তার একজন শিক্ষককে লিখছে; চিঠিটা বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়—
প্রিয় মহোদয়,
ওই দিন আপনার সঙ্গে ঘুরে খুব আনন্দ পেয়েছি। বাড়িতে ফিরে অনেক চিন্তা করলাম–কেন আনন্দ পেয়েছি? কিছু বের করতে পারি নি। আপনি খুব মজা করে কথা বলেছেন এটা একটা আনন্দের ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু মজা করে কথা তো অনেকেই বলে। একজন মজার মানুষের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছি এটাই কি আমার আনন্দের উৎস? নাকি এর বাইরেও কিছু আছে?
পরদিন খুব আগ্রহ নিয়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আপনি আসেন নি। দুপুরে আপনার খালা বললেন— আপনি আসবেন না। কিছু দিন পরপর কাউকে কিছু না বলে আপনি ডুব দেন। তখন নাকি আপনার ছায়াও বলতে পারে না। আপনি কোথায়। আপনার স্বভাবই নাকি এ রকম।
আমি জানতে চাইলাম, স্বভাব এরকম মানে কী?
উনি বললেন, হিমু যেই বুঝে কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করছে ওমি সে ডুব মারে। ও বুঝে ফেলেছে তুই তার জন্যে অপেক্ষা করছিস; কাজেই ডুব মেরেছে। আমি বললাম, প্রতিদিন উনি এক শ ডলার করে পাবেন এটা তার কাছে কোনো ব্যাপার না?
উনি বললেন, দৈনিক এক হাজার ডলারও তার কাছে কোনো ব্যাপার না। কারণ সে হল— হিমু।
সে হিমু এটা বলে আপনার খালা এক ধরনের অহঙ্কার বোধ করলেন। আমি এতেই সবচে অবাক হয়েছি। মানুষ নিজেকে নিয়ে অহঙ্কার করে এটা স্বাভাবিক। প্রকৃতি জীব জগতের মধ্যে মানুষকে অহঙ্কারী করে পাঠিয়েছে। অস্বাভাবিক ব্যাপার হল একজন মানুষ যখন অন্য একজনকে নিয়ে অহঙ্কার করে। আপনি কি জানেন যে, আপনি সেই অসীম ভাগ্যবানদের একজন?
আপনি পরদিনও এলেন না। আপনার খালা হাসি মুখে বললেন— ও আর আসবে না। যেন আপনার না আসাটা আনন্দময় কোনো সংবাদ। আমি বললাম, উনি যদি না আসেন আমি যাব তাঁর কাছে। আপনার খালা বললেন, ও কোথায় থাকে না-থাকে তার কি কোনো ঠিক আছে নাকি।
আমি বললাম, উনার কোনো ঠিকানা নেই? আপনার খালা খুবই আনন্দিত গলায় বললেন–ওর ঠিকানা থাকলে তো কাজই হত।
উনি থাকেন কোথায়?
ও কোথাও স্থির হয়ে থাকে না। আজ এখানে কাল ওখানে। ভোজনং যত্র তত্ৰ শয়নং, হট্ট মন্দির।
শুনে আমার খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে। আমেরিকায় Hobo সম্প্রদায় বলে একটা গোষ্ঠী আছে। এরাও ইচ্ছা করে সব ঠিকানা নষ্ট করে ঠিকানা বিহীন মানুষে পরিণত হয়েছে। আজ এখানে, কাল ওখানে সময় কাটাচ্ছে। ট্রেনে করে ঘুরেছে। ক্লিপিং ব্যাগ পেতে ফুটপাতের এক কোণায় ঘুমিয়ে পড়ছে। ওদের জীবনযাত্রা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। আমি ওদের প্রচুর ছবি তুলেছি। কিছু স্লাইড আমার কাছে আছে। আপনাকে আমি দেখাব।
কিন্তু তার জন্যে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া প্রয়ােজন। আপনার স্ট্র উপর জোর খাটানোর কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধুই অনুরোধ করছি–টেলিফোনে হলেও আমার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলার জন্যে। কারণটা স্পষ্ট 2 করি আমার ধারণা আপনি কোনো কারণে আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন। কেউ ষ্ট্রে আমার উপর বিরক্ত এটা ভাবতেও আমার কাছে খারাপ লাগে। আশপাশের মানুষদের মনে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষমতা হয়তো আমার নেই, তাই বলে তাদের বিরক্ত করব কেন? কারণটা স্পষ্ট করলাম। নয়তো আপনি ভেবে বসতেন— আমি আপনার প্রমে পড়ে গেছি। পুরুষ জাতির অনেক দুর্বলতার এক দুর্বলতা হচ্ছে তারা মনে করে মেয়ে মাত্রই তার প্রেমে পড়ার জন্যে পাগল হয়ে আছে। আশা করি আপনি সেরকম নন। আপনার যেরকম স্বভাব টেলিফোন নাম্বার নিশ্চয়ই আপনার মনে নেই। কিংবা আপনি কোথাও লিখেও রাখেন নি।
বিনীতা
আশা।
আমাদের মেসে একটা টেলিফোন ম্যানেজার আবুল কালাম বসে থাকেন। নগদ টাকা দিয়ে টেলিফোন করতে হয়। আগে রেট ছিল চার টাকা এখন বেড়ে সাত টাকা হয়েছে। মেসের টেলিফোন থেকে টেলিফোনের একটাই সমস্যা – টেলিফোনের প্রতিটি কথা আবুল কালাম সাহেব অত্যন্ত মন দিয়ে শুনেন। জগতের কোনো কাজে তিনি কোনো আনন্দ পান বলে মনে হয় না। এই কাজটা করেন। খুব আনন্দ নিয়ে। টেলিফোনে কথা বলার সময় তিনি মাঝে মাঝে মাথাও খানিকটা এগিয়ে আনেন। অন্যপ্রান্ত থেকে কে কি বলছে তা শোনার চেষ্টায় এই কাজটা করা হয়। আমিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যে কথা বলার সময় মাঝে মধ্যে রিসিভারটা আবুল কালামের কানে দিয়ে দেই যাতে সে শুনতে পারে অপরপক্ষ থেকে কী বলা হচ্ছে। এই কারণে আবুল কালাম আমাকে কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়। যেমন আমি আগের রেট চার টাকায় টেলিফোন করতে পারি! মাঝে মধ্যে আমাকে বাকি দেওয়া হয়।