You mean philosopher?
হ্যাঁ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ভিক্ষুক শ্রেণী মানুষই দার্শনিক। চলুন যাই।
চলুন যাই।
রিকশা নেব না হাঁটতে পারবো?
হাঁটতে পারব। আমরা যার কাছে যাচ্ছি। তিনি কি আপনার পূর্ব পরিচিত?
হ্যাঁ। ইনার নাম বদরুদ্দিন। ইনি ভাড়া খাটেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর ভাড়া হচ্ছে পঞ্চাশ টাকা। তুমিও ইচ্ছা করলে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে তাকে ভাড়া করতে পার।
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে তুমি ডে শিফটের জন্যে তাঁকে ভাড়া করলে। তিনি নিজে হাঁটতে পারেন না। বিয়ারিং দেওয়া চাকা লাগানো একটা বক্সে আধশোয়া অবস্থায় থাকেন। বক্স টেনে টেনে তাকে নিয়ে ঘুরতে হয়। বক্স যে টানবে তাকে খাওয়া খরচ বাদ দিয়ে বিশ টাকা দিতে হয়। সব দিয়ে বাকি যা থাকবে সবই, যে ভাড়া করবে তার। চল একটা কাজ করি আমরা বদরুদ্দিনকে এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া করে ফেলি। বৃষ্টি বাদলা না হলে এক সপ্তায় আমাদের মোটামুটি ভাল লাভ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
আপনি ঠাট্টা করছেন? না সিরিয়াসলি বলছেন?
মোটেই ঠাট্টা করছি না।
আমার তো মনে হচ্ছে আমি একটা খুবই অদ্ভুত এক দেশে উপস্থিত হয়েছি।
তুমি মোটেও কোনো অদ্ভুত দেশে উপস্থিত হও নি। ভিক্ষাবৃত্তি অতি প্রাচীন প্রথা; এ দেশের সব বড় বড় সাধু সন্তরা ভিক্ষা করেছেন। এখনো এ দেশে একটা সম্প্রদায় আছে ভিক্ষাবৃত্তি যাদের ধর্মের অংশ। কাজেই এই দিকে ভিক্ষুকদের মধ্যে প্রফেশনালিজম তৈরি হয়েছে। তুমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি যেখানে প্রফেশনালিজমকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। কাজেই ভিক্ষুকদের প্রফেশনালিজকে তুমি তুচ্ছ করবে না এটা আশা করতে পারি।
আশা বিড়বিড় করে বলল, I am so confused.
বদরুদ্দিনকে খুঁজে বের করতে খুবই সমস্যা হল। নিউ ইস্কাটনের যে বস্তিতে সে থাকত সেই বস্তি হঠাৎ উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে বস্তিবাসী চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বদরুদিনের দুই স্ত্রীর একজন থাকে বাসাবোতে। তার কাছ থেকে সন্ধান নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে বদরুদ্দিনকে খুঁজে বের করলাম। আমি ভেবেছিলাম। আশার ধৈর্যচ্যুতি হবে। তা হল না। সে আমার সঙ্গে যথেষ্ট আগ্ৰহ নিয়ে লেগে রইল।
বদরুদ্দিন মুখ গোমড়া করে বসেছিল। তার মেজাজ অত্যন্ত খারাপ কারণ গত তিন দিন তার বুকিং হয় নি। পঞ্চাশ টাকা তার রেট। কোনো পার্টিই পঞ্চাশ দিতে চায় না। চল্লিশের উপর কেউ উঠছে না। বদরুদিন থু করে থুতু ফেলে বলল, একবার চল্লিশে নামলে উপায় আছে? ভাইজান আপনে বলেন? দাম একবার যদি পড়ে আর তারে উঠানো যায় না। বরং তিন দিন না খায়া থাকব। তাও ভালো। এই বিষয়ে আপনের কী বিবেচনা ভাইবা বলেন।
আমি মাথা চুলকে বললাম, বুঝতে পারছি না।
বদরুদ্দিন বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল–আপনে লোকটা যে জ্ঞানী এইটা পরিষ্কার। জ্ঞানী না হইলে হুট কইরা একটা মত দিতেন। জ্ঞানী বইল্যাই সময় নিতাছেন। ভিক্ষা ব্যবসা বড় জটিল ব্যবসা। তার উপরে আমি হইছি। ঠিকানা হারা। পুরােনা পার্টির কেউ জানেও না। আমি কই থাকি?
আমি বললাম, বদরুদিন যাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার কাছে এসেছি তার নাম আশা। উনি আমেরিকার নিউ জার্সিতে থাকেন। তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
বদরুদ্দিন আশার দিকে তাকাল না। বিরক্ত মুখে বলল, মন মিজাজ অত্যধিক খারাপ। কী কথা বলব। কিন? তিন দিন হইয়া গেছে কোনো বুকিং নাই।
আমি বললাম, আমরা বুকিং বিষয়েই আলাপ করতে চাই। টানা এক সপ্তাহ বুকিং নিব—দর কমাতে হবে। ডেইলি পঞ্চাশ টাকা অসম্ভব ব্যাপার। ম্যাক্সিমাম চল্লিশ। খাওয়া খরচ নিজের।
মাফ করেন। না খাইয়া মরব। কিন্তু পঞ্চাশের নিচে এক পয়সা নামক না। আমার একটা ইজ্জত তো আছে? নাকি ইজ্জত নাই?
ইজ্জত তো অবশ্যই আছে। তবে পুরা সপ্তাহের জন্যে বুকিং এটা মনে রাখতে হবে। খুচরা রেট আর পাইকারীর রেট কখনো এক হয়?
বদরুদ্দিন ঝুকে এসে বলল, ভাইজান শুনেন পুরা ঢাকা শহরে দুই ঠ্যাং নাই ফকিরের সংখ্যা ছিল তের। এর মধ্যে দুই জন চলে গেছে নারায়ণগঞ্জ একজন গেছে ময়মনসিং সদরে এখন আমরা আছি মোট দশজন। দশজনের মধ্যে গান করতে পারে আমায়ে নিয়া চারজন। আমার রেইট বেশি হবে না?
অবশ্যই বেশি হবে। তবে তোমার গানের গলা তো ভালো না।
ফকিরের গানের গলা যেমন হয় আমারটাও তেমন— আমিতো আর হেমন্ত না।
দেখি আমার গেস্টকে একটা গান শুনাও।
না।
না কেন?
ইচ্ছা করতেছে না।
আশা বলল, আমি কি আপনার একটা ছবি তুলতে পারি?
বদরুদিন বলল, না।
আশা বলল, সব কিছুতেই না বলছেন কেন?
বদরুদিন থু করে একদলা থুতু ফেলে বলল, দুই বেলা না খাইয়া থাকলে আপনের মুখ দিয়া কোনো শব্দ বাইর হইত না। আমি তো তাও না বলতেছি। অনেক বিরক্ত করেচেন। এখন যান সাংবাদিকের সাথে আমি কথা বলি না।
সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন না কেন?
এরা উল্টা পাল্টা সংবাদ ছাপে। ছবি দিয়া একবার আমার সংবাদ ছেপেছে সেখানে লিখেছে আমার তিন বিবাহ। ভিক্ষার রোজগায়ে আমি নাকি তিন বউ পালি।
আপনার বিয়ে কয়টি।
দুই বিবাহ। তবে দুইটাই তালাক হয়ে গেছে। সংসার করতে যদি ইচ্ছা করে তা হলে করতে পারি। বর্তমানে সংসার ধর্মে মন নাই।
বদরুদ্দিন অন্যদিকে ফিরে সিগারেট ধরাল তাকে দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে তার যে শুধু সংসার ধর্মে মন নেই তা না, কথাবার্তা বলতেও মন নেই। আমি আশার দিকে তাকিয়ে বললাম, আজকের দিনের মত বাংলাদেশ দেখা বন্ধ করলে কেমন হয়?
ইতি তোর খালা
হিমু,