আমি খালার দিকে তাকিয়ে মোটামুটি খুদিরামের মতো বললাম—বিদায় দে খালা ঘুরে আসি।
আশা শোন, আমরা বাংলাদেশ দেখতে বের হয়েছি। অনেক কিছুই আমি তোমাকে দেখাব। তুমি নোট করবে, ছবি তুলবে, চিন্তা-ভাবনা করবে। এর থেকে এক সময় হয়তো তুমি বাংলাদেশ বের করে ফেলতে পারবে।
আশা বলল, আপনি শিক্ষকের মতো কথা বলছেন কেন? সাধারণভাবে কথা বলুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে নিয়ে ক্লাস করতে বের হয়েছেন।
ক্লাস করতে বের হয়েছি তো বটেই। আশা শোন একজন পেইন্টারের কথা ভাব। এই পেইন্টারের হাতে সাতটা রঙ আছে। পেইন্টার সাতটা রঙ দিয়ে ছবি এঁকেছেন। মনে করা যাক এই সাতটা রঙের মধ্যে একটা বিশেষ রং হল বাংলাদেশ। মনে করা যাক সেই বিশেষ রংটা লাল; আমার কথা কি ফলো করছ?
অবশ্যই করছি?
পেইন্টার ছবি আঁকতে গিয়ে অনেক রঙের সঙ্গে লাল রংটাও ব্যবহার করবেন। কখনো এই রং নীলের সঙ্গে হবে খয়েরি, কখনো সবুজের সঙ্গে মিশে নীল। তোমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে পেইন্টিং থেকে লাল রং আলাদা করতে হবে। বের করতে হবে কোথায় কোথায় লাল রং অর্থাৎ বাংলাদেশ আছে। কাজটা সহজ না।
আপনার বক্তৃতা কি শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ শেষ হয়েছে।
প্ৰথমে আমরা কী দেখতে যাচ্ছি।
প্ৰথমে আমরা শশা খাওয়া দেখব।
শশা খাওয়া দেখব মানে? শশা কি?
শশার ইংরেজি আমি যতদূর জানি কুকুমবার। আমরা সেই কুকুমবার খাওয়ার দৃশ্য দেখব।
বাংলাদেশে এই শশা কি বিশেষভাবে খাওয়া হয়?
চল গিয়ে দেখি কীভাবে খাওয়া হয়। তারপর তুমিই বের করবে। এর কোনো বিশেষত্ব আছে কি না।
আমি আপনার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না; আমার ধারণা। আপনি গাইড হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। You are trying to be funny কিন্তু I mean busincss.
আমি তাকে গুলিস্তানের সামনে নিয়ে এলাম; এখানেই শশা কেটে কেটে বিক্রি হচ্ছে। লোকজন খাচ্ছে। আমি বললাম, আশা শশা খাওয়া দেখলে?
হ্যাঁ দেখলাম।
মনে হচ্ছে দৃশ্যটা দেখে তেমন মজা পাও নি।
মজা পাওয়ার কী আছে?
কিছুই নেই?
না কিছুই নেই। একটা লোক খুবই নোংরা পানিতে শশাটা ধুচ্ছে তারপর পিস করে লবণ মাখিয়ে খেতে দিচ্ছে। এর মধ্যে দেখার কী আছে?
আমি হাসলাম। আশা বলল, হাসছেন কেন?
আমার মনে হল মেয়েটা রেগে যাচ্ছে। শুরুতে মেয়েটিকে অশ্রুকন্যা বলে মনে হয়ছিল। এখন মনে হচ্ছে সে অশ্রুকন্যা না।
আশা বলল, কিছু মনে করবেন না। শশা খাবার দৃশ্য দেখা হয়েছে এখন আমি ঘরে ফিরে যেতে চাই। Enough is enough.
আমি বললাম, আশা দৃশ্যটা তুমি কিন্তু ভালো করে দেখ নি। অর্থাৎ লাল রংটা তুমি আলাদা করতে পার নি। আমি তোমাকে যেটা দেখাতে চাচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে–শশা অল্প কিছু লোক খাচ্ছে— কিন্তু তাদের ঘিরে আছে অনেক মানুষ। এদের কোনো কাজ কর্ম নেই। এরা গভীর আগ্রহে শশী খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। কেউ বসে বসে দেখছে। কেউ দাঁড়িয়ে দেখছে। যেন এটা জগতের অতি আশ্চর্য একটা দৃশ্য।
আশা চারদিকে তাকাল। তারপর শান্ত গলায় বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন।
আমি বললাম, এমন না যে এদের খুব শশা খেতে ইচ্ছা করছে বলে এরা ভিড় করে আছে। টাকা নেই বলে খেতে পারছে না। এরা শশা খাওয়ার দৃশ্যটাই আনন্দ নিয়ে দেখছে।
আমি যদি তাদের একটা ছবি তুলি তারা কি রাগ করবে?
মোটেই রাগ করবে না। খুবই আনন্দ পাবে। বাংলাদেশের মানুষ ছবি তুলতে খুব পছন্দ করে; মনে করো কোনো এক ভদ্রলোকের বাড়িঘর আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, সে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে তারমধ্যেও পত্রিকার কোনো সাংবাদিক যদি তাঁর ছবি তুলতে চায় সে কিন্তু হাসি মুখে ছবি তুলবে।
সত্যি বলছেন।
হ্যাঁ সত্যি বলছি, ১৯৭১ সনে পাকিস্তান আমী আমাদের দেশের অনেক মানষকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি কয়ে মারে। পাক আর্মীর ফটোগ্রাফার তখন কিছু কিছু ছবিও ক্যামেরায় তুলে। সেইসব ছবিতে অনেককে দেখা গেছে মুখে হাসি নিয়ে ছবির জন্যে পোজ দিয়েছে।
আপনি নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।
আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি না।
আপনার সব কথা যে আমি বিশ্বাস করছি তা না। এখন বলুন আমরা কোথায় যাব?
গর্ত দেখতে যাব।
গর্ত দেখতে যাব মানে?
টি এন্ড টি বোর্ড একটা গর্ত করছে। প্রায় দুশ লোক গোল হয়ে বসে গর্ত করা দেখছে। গভীর আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে দেখছে। কেউ কেউ সকালে এসেছে, থাকবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আশা হেসে ফেলল। আমি তার হাসি দেখে অবাক হলাম। এমন প্ৰাণময় হাসি অনেকদিন দেখি নি। সে হাসি থামিয়ে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করতে করতে বলল, আপনি আমাকে ইমপ্রেস করার একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা করছেন। ঠিক করে বলুন তো, করছেন না?
হ্যাঁ করছি। তুমি যদি আমার কর্মকাণ্ডে ইমপ্রেস না হও তা হলে আমার চাকরি থাকবে না। প্রতিদিন এক শ ডলার করে পাবার কথা সেটা পাব না; যে কোনো বুদ্ধিমান কর্মচারীর মূল কাজ মুনিবকে খুশি রাখা।
আপনার যুক্তি মানলাম। গর্ত দেখতে ইচ্ছা করছে না। গর্ত দেখা ছাড়া আর কী করা যায় বলুন।
একজন ভিক্ষুকের ইন্টারভুক্ত নিলে কেমন হয়। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। ভিক্ষুকের ইন্টারভ্যু নেওয়া হবে। আবার আপনার ক্যাসেট প্লেয়ারও পরীক্ষা করা হবে।
ক্যাসেট প্লেয়ার পরীক্ষার জন্যে ভিক্ষুকের ইন্টারভ্যু নিতে হবে কেন। আপনার ইন্টারভ্যু নিই।
হ্যাঁ নিতে পোর। তবে যে ভিক্ষুকের কাছে নিয়ে যাব সে মানুষ হিসেবে খুবই ইন্টারেস্টিং। দার্শনিক।