আমি বললাম, চল বের হয়ে পড়ি। সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
আশা খালার দিকে তাকিয়ে বলল, উনার সঙ্গে পেমেন্টের ব্যাপারটা শুরুতেই ঠিক করে ফেলা উচিত না? উনি তাঁর সার্ভিসের জন্যে কত চার্জ করবেন এবং মুড অব পেমেন্ট কেমন হবে সেটা জানলে ভালো হত।
খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, পেমেন্ট আবার কী? ও তোকে নিয়ে ঘুরবে—যেখানে যেখানে যেতে বলবি নিয়ে যাবে এর আবার পেমেন্ট কী?
শুধু শুধু উনার সার্ভিস নেব?
অবশ্যই নিবি।
উনি তার কাজকর্ম ফেলে আমার সঙ্গে ঘুরবেন?
ওর আবার কাজকর্ম আছে নাকি? ওর কাজই হচ্ছে ঘোরা।
আশা বলল, আমি একটা বাজেট করে রেখেছি প্রতিদিন একশ ইউএস ডলার।
খালার মুখ আবারো রাগি রাগি হয়ে গেল। তিনি মাথা বাঁকিয়ে বললেন— এটা আমেরিকা না। এটা বাংলাদেশ। আর হিমু জীবনে কোনোদিন এক শ ডলার চোখে দেখেছে কিনা সন্দেহ। রিকশা করে বের হলে রিকশা ভাড়া দিবি। ট্যাক্সি করে বের হলে দিবি ট্যাক্সি ভাড়া। ব্যাস ফুরিয়ে গেল।
আশা কিছু বলল না। চুপ করে গেল। তবে মনে হল খালার কথাটা তার ঠিক মনে ধরে নি। সে এক শ ডলারের ব্যাপারটা ফয়সালা না করে বের হবে না। আমি আশার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম— তুমি কি ডেইলি পেমেন্ট করবে? না মাসের শেষে একসঙ্গে করবে?
আপনার জন্যে যেটা ভালো হয় সেটাই করব।
দুপুরে লাঞ্চ, তারপর ধর সন্ধ্যায় চা বিসকিট এই সব খরচ কিন্তু তোমার।
অবশ্যই। আমি দশটা-পাঁচটা ডিউটি করব। এরচে বেশি হলে ওভারটাইম দেবে।
অবশ্যই। ওভারটাইম কত হবে সেটা কি আমরা ঠিক করে নেব?
ঘণ্টা হিসেবে ওভারটাইম হোক। প্ৰতি ঘণ্টীয় দশ ডলার কি তোমার কাছে খুব বেশি মনে হচ্ছে?
না বেশি মনে হচ্ছে না।
খালা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আমার কথাবার্তায় তিনি এতই অবাক হয়েছেন যে নিজে কথা বলতে ভুলে গেছেন। তাকে দেখাচ্ছে মাছের মতো। চোখে পলক পড়ছে না। আমি আশার দিকে তাকিয়ে সহজ ভঙ্গিতে বললাম, আজ ফেহেতু প্রথম দিন— তা ছাড়া এসেছিও দেরি করে আজ ফ্রি। আজকের জন্যে কোনো চার্জ দিতে হবে না।
আশা বলল, ধন্যবাদ।
এবারের ধন্যবাদটা জোরালো। আগের মতো অস্পষ্ট না। খালা এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি মনে মনে কি ভাবছেন কে জানে।
আশা বলল, আমি কি তা হলে তৈরি হয়ে আসবো?
আমি বললাম, অবশ্যই।
সঙ্গে কী কী জিনিস নেব?
নোট করার জন্যে খাতা কলম, ছবি তোলার জন্যে ক্যামেরা। তাৎক্ষণিকভাবে কথাবার্তা রেকর্ড করার জন্যে ক্যাসেট রেকর্ডার। ছাতা। পানির বোতল। বাসার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে একটা মোবাইল টেলিফোন। ফাস্ট এইড বক্স কি আছে? একটা ফাস্ট এইড বক্স থাকা দরকার। সুইস নাইফ থাকলে ভালো হয়; নাইলনের দড়ি অবশ্যই নিতে হবে। পৃথিবীতে দড়ির সবচে বেশি ব্যবহার হয় বাংলাদেশে। দেশলাই, মোমবাতি, টর্চ লাইটও নেবে কখন কোনটা কাজে লাগে। কে জানে। ও আর একটা ফ্লাস্ক। ফ্লাস্ক ভর্তি গরম চা।
আশা বলল, আমি দশ মিনিটের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে আসছি।
আশা ঘর থেকে বের হবার পর খালা মনে হয় তার কথা বলায় ক্ষমতা ফিরে পেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন– তুই কী শুরু করেছিস। সত্যি সত্যি তুই টাকা নিবি?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
পারিবি টাকা নিতে?
অবশ্যই পারব।
অতি সহজ। সাধারণ একটা মেয়ে, তুই তো এই মেয়ের মাথা পুরা আউলায়ে দিবি। দরকার নেই। আশাকে আমি তোর সঙ্গে ছাড়ব না। দরকার হলে আমি ওকে বাংলাদেশ দেখাব।
তাহলে আমি বিদেয় হই।
খালা দুঃখিত গলায় বললেন–বিদেয় হতে চাইলে বিদেয় হ। শুধু এই মেয়েটা যে কত ভালো এটা শুনে যা। সারাজীবন Aপ্রাস পাওয়া স্টুডেন্ট। Aপ্রাস পাওয়া স্টুডেন্ট যে কী জিনিস এটা তুই কোনোদিনও বুঝবি না। বোঝার দরকারও নেই। মেয়েটার এক বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। মেয়ের মা এক আমেরিকানকে বিয়ে করেন। এখন শুনতে পাচ্ছি। সেই বিয়েও ভেঙে গেছে কিংবা যাচ্ছে।
মহিলা কি তৃতীয় বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন?
হু।
বল কী এমন ওস্তাদ মহিলাষ্ট্র গর্ভে এমন সাদামাটা সন্তান।
সাদামাটা সন্তান মানে? কী বললা এতক্ষণ এ প্লাস স্টুডেন্ট।
ঐ আর কী ওস্তাদ মহিলার গর্ভে পড়ুয়া সন্তান।
শুধু পড়ুয়া না, আশা ছবি আঁকতে পারে, গান গাইতে পারে, ফটোগ্রাফিতে প্রাইজ পেয়েছে…
বল কী গুণাবলি তো ঝরে ঝরে পড়ছে।
ঠাট্টা করছিস?
ঠাট্টা করব কেন?
যার যে সম্মান প্রাপ্য তাকে সে সম্মানটা দিতে হয়। মেয়েটাকে তুই সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে পারছিস এটাই তোর ভাগ্য।
তুমি যে সব কথা বলছি আমার তো খালা ভয় ভয় লাগছে আমি মেয়েটার প্ৰেমে পড়ে যাব।
খালা গম্ভীর গলায় বললেন—তোর সেই ভয় নেই। আমি ভয় পাচ্ছি মেয়েটাকে নিয়ে। অতি নরম মনের মেয়ে তোর পাগলামি দেখে তার মাথা আউলায় যেতে পারে। মেয়েটার মাথা আউলায় এমন কিছুই করবি না। খবরদার।
অবশ্যই করব না।
খালা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন– আমি চাচ্ছি। খুব ভালো কোনো ছেলে পেলে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। ওর মার উপর আমার আর ভরসা নেই? তোর সন্ধানে ভালো ছেলে আছে নাকি রে?
ভালো ছেলে অবশ্যই আছে। তবে গাঁজাখোর টাইপ। অন্তর অত্যন্ত ভালো তবে গাঁজা টাজা খায়…
খালা বড় করে নিশ্বাস নিলেন। কঠিন ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি। ধমক দিতে পারলেন না–তার আগেই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আশা উপস্থিত হয়েছে। একটু আগের আশার সঙ্গে এই আশার কোনো মিল নেই। কোথায় আগরতলা কোথায় চকিরতলা টাইপ বেমিল। জিনসের প্যান্ট, লাল শার্ট। মাথায় ক্রিকেটারদের টুপির মতো টুপি। তবে টুপির রং সাদা না, নীল। পিঠে হ্যাভারস্যাক ব্যাগ। চুলেও মনে হয় কিছু করেছে যে কারণে বাঙালি মেয়ে বলে এখন আর তাকে মনেই হচ্ছে না। আশা আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে—Let us move.