বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটির চেহারা এবং পোশাকআশাক দেখে মনে হচ্ছে মফস্বলের মেয়ে বাবার সঙ্গে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছে। চিড়িয়াখানা দেখবে, আহসান মঞ্জিল দেখবে। বাড়ি ফেরার আগে আগে শাড়ি কিনবে, ডালা থেকে স্যান্ডেল। কিনবে। মেয়ের বাবা স্টুডিওতে মেয়ের কিছু ছবিও তুলবেন। বিয়ের সময় এইসব ছবি কাজে লাগবে। বরপক্ষকে এইসব ছবি পাঠানো হবে। এমন শান্ত এবং কোমল চেহারার মেয়ে আমি অনেকদিন দেখি নি। এ ধরনের মেয়েদের একটা নাম আছে— অশ্রুকন্যা। এদের চোখে সব সময় জল ছলছল করে। তবে এরা প্ৰায় কখনোই কঁদে না কিন্তু এদের দেখেই মনে হয়। এরা কাদার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে।
আপনি বরঞ্চ চলে যান। ইহাই হবে উভয় পক্ষের জন্যে কল্যাণকর। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, খালা সরবত খেতে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এক্ষুনি মরজিনাকে ডেকে সরবতের কথা বলবেন। আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
সরবত খেতে বলবেন কেন?
এটাই উনার নিয়ম। অনেকক্ষণ রাগারগি করে তারপর স্বাভাবিক হয়ে যান। ভালো কথা তুমি কে?
আমি আপনার খালার দূর সম্পর্কের নিস। আমার নাম আশা।
তুমি কি দেশের বাইরে থাক?
জি। আমি নিউজার্সিতে থাকি। এবার হাইস্কুল পাস করেছি। ইউনিৰ্ভাসিটিতে ঢুকবো। ইউসিএল এ সুযোগ পেয়েছি।
প্ৰথম বাংলাদেশে এসেছ?
খুব ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম। কিছু মনে নেই। আপনি কথা বলে সময়ের অপচয় না করে অতি দ্রুত নিষ্কৃতি হয়ে যান। আমার ভয় লাগছে!
অতি দ্রুত নিষ্কৃতি হয়ে যাবার কোনোই দরকার নেই। দেখবে এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথা শেষ হবার আগেই খালা বের হলেন। তার মাথা ভেজা। অর্থাৎ মাথায় পানি দেওয়া হয়েছে। মাথায় পানি দেওয়ায় তেমন লাভ হয়েছে বলে। মনে হল না। মুখ থম থম করছে। চোখ লাল। খালা আগের মতোই হুঙ্কার দিয়ে বললেন— তোকে খুব কম করে হলেও দশবার বলেছি। সকাল আটটার আগে আসিবি। আমার খুব জরুরি দরকার। যেহেতু সকাল আটটায় আসতে বলেছি–তুই ইচ্ছা করে এলি সাড়ে এগারোটায়। আর কিছু না একটা ভাব দেখালি। যদি বলতাম দুপুরে আসিস তা হলে আসতি সকাল সাতটায়। ভাব না ধরলে আলাদা হওয়া যায় না। প্রমাণ করতে হবে না— আলাদা। আমাদের বিখ্যাত হিমু সাহেব। ঢাকার রাজপথ পর্যটক। রামছাগলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়িস না। তুই ল্যাম্পপোস্ট না যে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বোস। সরবত খাবি?
না।
তা কেন খাবি? শরীরের উপকার হয় এমন কিছু খেলে তুই যে আলাদা একটা প্রমাণ হবে কেন? শরীর পুরোপুরি নষ্ট হয় এমন কিছু খা। গাজটাজা খা। গাজা ধরেছিস না?
এখনো ধরি নি।
দেরি করছিস কোন ধরে ফেল; আর ধরার দরকার ও নেই। গাজাখোরদের আশপাশেই তো থাকিস। ওতেই ভোজন হয়ে যায়।
খালা আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আশার দিকে তাকিয়ে বললেন— হিমুকে বেশি করে লেবু দিয়ে একগ্লাস লেবুর সরবত বানিয়ে দে। রোদে রোদে ঘুরে, ওর ভিটামিন সি খুবই দরকার }
আশা বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণায় চাপা। হাসির আভাস। তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্ৰচণ্ড ভয়ে সে অস্থির হয়েছিল। হঠাৎ সব ভয় কেটে গেছে। অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়েছে ঝলমলে সূর্যের আলো।
আমি বেতের সোফায় বসেছি। খালা বসেছেন। আমার সামনে। টাওয়েল দিয়ে মাথার ভেজা চুল শুষছেন। তার চোেখ মুখ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তিনি বললেন–আসতে দেরি করলি কেন?
রাতে ঘুম ভালো হয় নি। ঘরে চোর ঢুকে পড়েছিল। চোরের সঙ্গে গল্পগুজব করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
চোরের সঙ্গে গল্পগুজব করতে দেরি হল?
হ্যাঁ।
ওকে চা বিসকিট খাওয়ালি।
চা খাওয়াই নি বিসকিট খাইয়েছি।
উদ্ভট অজুহাত আমাকে দিবি না হিমু। অসহ্য।
আচ্ছা যাও দেব না।
আটটার সময় তোর আসার কথা। তুই আসছিস না। আশা হয়ে গেল অস্থির। বাঙালি মেয়ে হলেও সারাজীবন মানুষ হয়েছে বিদেশে। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলা হল এদের অভ্যাস।
আমার আসার সঙ্গে এই বিদেশিনীর অস্থির হবার সম্পর্কটা কী?
সম্পর্ক আছে। এই মেয়ে এক মাসের জন্যে বাংলাদেশে এসেছে। এই একমাস সে বাংলাদেশে ঘুরবে। ছবিটবি তুলবে তারপর ফিরে গিয়ে বই লিখবে। বই এর নামও ঠিক হয়ে আছে Discovering Bangla!
তায় বই লেখার দরকার কী?
তার বই লেখার দরকার কী সেটা সে জানে। আমি সেটা তাকে জিজ্ঞেস করি নি। বেচারি শখ করে এসেছে শখটা মিটলেই হল।
আমাকে কী করতে হবে? তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ দেখাতে হবে?
হ্যাঁ। তাতে কোনো অসুবিধা আছে?
না অসুবিধা কী? আমি নিজেও বাংলাদেশ দেখি নি। তার সঙ্গে থেকে থেকে আমিও যদি বাংলাদেশ দেখে ফেলি তা হলেতো ভালোই। এক ঢিলে দুই পাখি। One stone two birds.
তোর এই কথার মানে কী? তুই বাংলাদেশ দেখিস নি?
না।
না মানে?
যে পোকা আমের ভেতর জন্মে সে কী করে বুঝবে আম কী? আমি তো বাংলাদেশেই ঘোরাফিরা করছি। বুঝব কী করে বাংলাদেশ কী?
খালা কঠিন কোনো কথা বলতে যাচ্ছিলেন। বলতে পারলেন না। তার আগেই আশা লেবুর সরবত নিয়ে উপস্থিত হল। খালা বললেন– আশা এই ছেলের নাম হিমালয়। ডাক নাম হিমু। তুমি যা যা দেখতে চাও এ দেখাবে। তার সঙ্গে তুমি নিশ্চিত মনে ঘুরতে পোর। কোনো সমস্যা নেই।
আশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল— ধন্যবাদ।
ধন্যবাদটা তেমন জোরালো হল না। মনে হল সে ঠিক ভরসা পাচ্ছে না।