বাবা ঘুমুতে দাও। আরাম করে ঘুমুচ্ছি।
গৌতম বুদ্ধ কোথায় জন্মেছিলেন?
লুম্বিনীর শালবনে।
হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের অনেক বাণী তোকে শিখিয়েছিলাম। মনে আছে?
না।
সব ভুল মেরে বসে আছিস?
বসে নেই বাবা শুয়ে আছি।
আমার সঙ্গে আবৃত্তি কর–
আত্তাহি অওনো নাথো
কোহি নাথো পারসিয়া।
আমি বিড়বিড় করে আবৃত্তি করলাম। বাবা বললেন– এর অর্থটা বলে দেই— নিজের প্রদীপ নিজেকেই জ্বালাতে হবে।
আমি বললাম, হুঁ।
বাবা বললেন, কিছু না বুঝেই বলে ফেললি হুঁ।
না বোঝার তো কিছু নেই। নিজের প্রদীপ নিজেকেই জ্বালাতে হবে এটা তো সহজ কথা।
মোটেই সহজ কথা মা— অতি জটিল কথা। প্ৰদীপ থাকলেই হয় না। প্রদীপে তেল থাকতে হয়। প্ৰদীপ জ্বালানোর জন্যে ম্যাচের কাঠি থাকতে হয়। বুঝতে পারছিস?
হুঁ। বাবা দয়া করে তুমি যাও। আমাকে কিছুক্ষণ আরাম করে ঘুমুতে দাও। খুব ভোরে আমাকে উঠতে হবে।
কেন?
ফরিদা খালার বাসায় যেতে হবে? উনি জরুরি খবর পাঠিয়েছেন।
বাবা দুঃখিত গলায় বললেন, ব্যাটা তুই তো সংসারে জড়িয়ে পড়ছিস। তোকে জরুরি কাজে ডেকে পাঠাচ্ছে। তোর আবার কিসের জরুরি কাজ? খবৰ্দার তুই যাবি না।
আচ্ছা যাও যাব না।
তোর ফরিদা খালা ঘোর সংসারী মানুষ। তার কাছ থেকে এক শ হাত দূরে থাকবি।
আচ্ছা।
এক শ হাত না, তারচেয়েও বেশি। পাঁচ শ হাত দূরে থাকবি।
আচ্ছা এখন তুমি যাও।
বাবার আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি তলিয়ে যাচ্ছি গাঢ় গভীর ঘুমে।
ফরিদা খালা
ফরিদা খালা কখনোই আমাকে ধমক না দিয়ে কথা শুরু করতে পারেন না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। বাড়ির পুরোনো ড্রাইভার দুদিনের কথা বলে পনেরো দিন পর ফিরে এলে তার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা হয় সেই দৃষ্টি। তারপর শুরু হয় ধমক। প্ৰথমেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তারপর বলেন— আমার মতো অপদাৰ্থ, অকর্মণ্য মানুষ তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি। আমি এখনো কেন বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতু থেকে লাফ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছি না তা জানতে চান। তারপর এক সময় তার রাগী রাগী মুখ হাসি হাসি হয়ে যায়। তিনি বলেন— রামছাগলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছিস কী জন্যে? বোস। কী খাবি চা না। সরবত। বরফ দিয়ে লেবুর এক গ্লাস সরবত খা। কিছু ভিটামিন সি শরীরে যাক। চা খেয়ে খেয়ে শরীরের কি অবস্থা করেছিস খেয়াল আছে? আয়নায় নিজেকে কখনো দেখিস? দেখলে তো ওয়াক থু করে বমি করে আয়না নষ্ট করে ফেলতি। ঝামা দিয়ে ঘসে তোকে একদিন গোসল করাতে পারলে আমার মনটা শান্ত হত। তারপর বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বলেন–ওই মরজিনা, মরজিনা হিমুকে লেবুর সরবত বানিয়ে দে। মরজিনা এ বাড়ির কাজের মেয়ে অনেকদিন থেকে আছে! খালা কথায় কথায় বলেন এই বাড়িতে মরজিনার নাম যতবার নেওয়া হয় আল্লাহ্র নামও ততবার নেওয়া হয় না।
খালা যখন মরজিনাকে ডাকাডাকি শুরু করেন তখন বুঝতে হবে তার রাগ পড়ে গেছে। এই পর্যায়ে আসতে মাঝে মাঝে অল্প সময় লাগে আবার মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় লাগে। আজ যেমন লাগছে। খালার রাগ বাড়ছেই। তার গালাগালির মধ্যে আজ নতুন নতুন জিনিস যুক্ত হচ্ছে।
তুই বদ্ধ উন্মাদ এটা কি তুই জানিসা? উন্মাদদের গা থেকে রো বের হয়। এই রো-এর আশপাশে যারা থাকে তারাও উন্মাদ হয়। তোর গা থেকে যে রের বের হয় এটা তুই জানিস? যে কোনো সুস্থ মানুষ তোর সঙ্গে এক সপ্তাহ থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কেউ যদি গলা টিপে তোকে মেরে ফেলে তা হলে তার বেহেশতে নাসিব হবে এটা কি তুই জানিস?
খালা চিৎকার করেই যাচ্ছেন— আমি যথারীতি দাঁড়িয়ে আছি। লেবুর সরবত প্ৰসঙ্গ কখন আসে তার জন্যে অপেক্ষা করছি। আর লক্ষ করছি আঠারো উনিশ বছরের একটা অপরিচিত মেয়ে খুবই কৌতূহলী হয়ে পাশের ঘর থেকে মুখ বের করে আমাকে দেখছে এবং খালাকে দেখছে। চোখে চোখ পড়া মাত্র চট করে মাথা সরিয়ে নিচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খালার ব্যাপারে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। একবার সে খালায় দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল— প্লিজ প্লিজ।
খালা তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন— আমাদের কথার মধ্যে নাকগলাবে না। প্লিজ প্লিজ বলবে না। তুমি তোমার মতো থাক।
তারপর আবারো হেভি মেশিনগান চালু করলেন– কত লোক ট্রাকের নিচে থৈ পড়ে মারা যায়— তুই কেন মারা যাচ্ছিন্স না? তুই তো রাস্তাতেই থাকিস। কোনো ট্রাক তোকে ধাক্কা দিয়েছে এই খবরটা শুনলেই আমি দশটা ফকির খাওয়াতাম। ফকির আমার খবর দেওয়াই আছে। আসবে। আর খিচুড়ি খেয়ে চলে যাবে।
বলতে বলতে খালা বাথরুমে ঢুকলেন। তার মাথায় নিশ্চয় রূক্ত উঠে গেছে। মাথায় পানি ঢালা হবে।
অপরিচিত মেয়েটা এই সুযোগে ঘরে থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল— আন্টিয় অতি নিম্নমানের আচরণবিধিয় জন্যে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এবং দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার ধারণা তিনি কিঞ্চিৎ অসুস্থ। হাইপার টেনশনঘটিত ব্যাধির রোগীরা এরকম আচরণবিধি করে।
মেয়েটার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে— এই দেশের মেয়ে হলেও দেশের শ্ৰী সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। বড় হয়েছে বিদেশে। আচরণবিধি পত্রিকার ভাষা। বাংলাদেশের কোনো মেয়ে কথোপকথনে আচরণবিধি বলবে না। আমরা ঔ বিদেশীদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার সময় যেমন একটু ভয়ে ভয়ে থাকি ই ইংরেজিটা ঠিক হল কি না, মনে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনিই এই মেয়েও তাই করেছে। সে প্রথমে কথাগুলি ইংরেজিতে গুছিয়ে নিয়ে পরে বাংলায় অনুবাদ করছে। বাক্যগুলি দ্রুত বলছে না। থেমে থেমে ভেঙে ভেঙে বলছে।