বলতে পারলাম না।
লুম্বিনীর শালবনে।
মৃত্যু কোথায় হয়েছে জানেন?
না।
মৃত্যুও হয়েছে বৈশাখী পূর্ণিমায়। শালবনে। তবে লুম্বিনীর শালবনে না।– কুশিনারার শালবনে। মহাপুরুষদের জন্ম মৃত্যু একই দিনে হয়। ভাই সাহেব উঠি অনেক বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না। জানি আপনি কিছু মনে করেন। নাই। মনে করলে আমার এত কথা শুনতেন না। অনেক আগেই আমাকে গেট আউট করে দিতেন। আপনি সেটা করেন নাই। সিগারেটের প্যাকেট আগায়ে দিয়েছেন। জাপানি একটা প্ৰবাদ আছে– একটা আন্তরিক কথা দিয়ে তিনটা শীতকাল উষ্ণ করা যায়। আপনার সঙ্গে কথা বলে জাপানি প্রবাদটার কথা মনে পড়ল। ছাত্রজীবনে আমার প্রবাদ সংগ্রহের বাতিক ছিল। প্রবাদ, প্ৰবচন লিখে তিনশ পৃষ্ঠার একটা খাতা ভরতি করেছিলাম। বাসার লোকজন ভুলক্রমে পুরোনো খবরের কাগজের সঙ্গে খাতাটা বিক্রি করে ফেলে। জীবনে এত দুঃখ পাই নাই। ভাইসাব যাই?
আমি বললাম, আচ্ছা যান।
ভদ্রলোক দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বললেন, আপনার ঘুম ভাঙায়েছি। যদি অনুমতি দেন তা হলে ঘুম পাড়ায়ে দিয়ে যাই।
কীভাবে ঘুম পাড়াবেন?
মাথা বানিয়ে দিব। চুল টেনে দিব। নাপিতের কাছ থেকে শিখেছি। নাপিতের নাম নেক মর্দ। নাম শুনে মনে হয় হিন্দু। আসলে মুসলমান; অতি ভালো মানুষ। আমাকে যত্ন করে শিখিয়েছেন।
কী শিখিয়েছেন? মাথা বানানোর কৌশল?
উনার কাছে চুল কাটাও শিখেছি। ভবিষ্যতে চুল কাটার প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন। আমার কাছে কাচি চিরুনি সবই আছে।
জি বলব।
এখন যদি অনুমতি দেন, মাথা বানায়ে দেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়ায়ে দিব ইনশাল্লাহ; মাথার নিচে দুটা বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়েন।
আমি আপত্তি করলাম না। মাথার নিচে দুই বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুরু হয়ে গেল মাথা মালিশ। জয়নাল সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, ভাই সাহেব কেমন লািগছে?
আমি বললাম, ভালো।
শরীর ছেড়ে দেন; যত ছাড়বেন তত আরাম পাবেন।
আমি শরীর ছেড়ে দিলাম। জয়নাল সাহেব ফিসফিস করে বললেন, আমি কী কথা বলছি, না বলছি মন দিয়ে শোনার কোনো দরকার নাই। এক কান দিয়ে ঢুকাবেন আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেন।
আমি বললাম, আচ্ছা।
সবচে আরামের মালিশ হল চোখ মালিশ। এটা দিব সবার শেষে। তখন ঘুম চলে আসবে। আরাম লাগছে না ভাই সাহেব?
লাগছে।
শরীরের আরামকে অনেকে খুব খারাপ চোখে দেখে। এটা ঠিক না। শরীর হল আত্মার ঘর। ঘর আরাম পেলে আত্মা আরাম পাবে ঠিক না ভাই?
হ্যাঁ ঠিক।
মেসের সবার কি ধারণা জানেন?
না জানি না।
মেসের সবার ধারণা আপনার পাওয়ার আছে।
কী আছে?
পাওয়ার আছে।
পাওয়ার আছে মানে কী?
কিছু কিছু মানুষকে আল্লাপাকে পাওয়ার দিয়ে পাঠান। তারা যা ইচ্ছা করে তাই হয়।
আপনার ধারণা আমার পাওয়ার আছে?
আমার কোনো ধারণা না–লোকজন বলে।
আপনি বিশ্বাস করেন না?
আমি বিশ্বাসও করি না, আবার অবিশ্বাসও করি না। আল্লাহ। কখন কাকে কী দেন। বলা মুশকিল। কে জানে হয়তো আপনাকে দিয়েছে। এমন তো না যে আপনাকে কিছু দিলে আল্লাহর টান পড়ে যাবে। উনার হল অফুরন্ত ভাণ্ডার।
আল্লাহ আমাকে কিছুই দেন নাই। তবে এখন আপনার মাধ্যমে আরাম দিচ্ছেন। খুবই আরাম পাচ্ছি। মাথা মালিশটাকে তো আপনি একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। চোখের কাজটা কখন শুরু করবেন?
দেরি আছে। কপাল ম্যাসাজ হবে, তারপরে ভুরু— তারপরে চোেখ। ঘুম পাচ্ছে না?
হ্যাঁ পাচ্ছে। খুবই ঘুম পাচ্ছে! কষ্ট করে জেগে আছি।
কষ্ট করে জেগে আছেন কেন?
ঘুমিয়ে পড়লে তো আর আরামটা পাব না। যতক্ষণ জেগে থাকব ততক্ষণই আরাম। যে নাপিতের কাছ থেকে এই কাজ শিখেছেন তার নামটা যেন কী?
নেকমর্দ।
বেঁচে আছেন এখনো?
জি না। উনার ইস্তেকাল হয়েছে।
কবর হয়েছে কোথায়?
চাঁদপুরে।
মাজার জিয়ারত করতে যান না?
জি না।
যাওয়া দরকার। এবং কবর বাঁধানোর ব্যবস্থা করাও দরকার। শ্বেত পাথরে লেখা থাকবে–
মহান মাথা মালিশ শিল্পী
নেকমর্দ
বুঝতে পারছি আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুম চলে আসছে। ওস্তাদ নেকমর্দের যোগ্য উত্তরসূরি তাঁর চোখের কাজ শুরু করেছেন। মনে হচ্ছে চোখের পাতার উপর দিয়ে ভেজা পায়ে পিঁপড়া হেঁটে যাচ্ছে। পিঁপড়াদের মধ্যে দু-একটা আবার দুষ্ট প্রকৃতির। এরা পথ চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কুটুস করে কামড় দিচ্ছে। সেই কামড়েরও আরাম। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়– সুখের মতো ব্যথা। মূল কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করছি। ঘুমে মাথা এলোমেলো হয়ে আসছে – ভালো মনে আসছে না–
কমল ফুল বিমল সেজখানি
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে
বাজিল বুকে সুখের মত ব্যথা।
হিমু। এই হিমু।
মাথা থেকে কবিতা উধাও হয়ে গেল— হঠাৎ মনে হল জয়নাল সাহেব আমার চোখের পাতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন না, হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার বাবা। তাঁর গায়ের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছি। অর্থাৎ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। গভীর ঘুম। অবচেতন মনের যে অংশে বাবা ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। সেই অংশ থেকে তিনি উঠে এসেছেন। কিছু কঠিন কঠিন কথা তিনি এখন শুনাবেন।
হিমু!
জি।
বেহায়ার মতো মাথা পেতে শুয়ে আছিস তোর লজা লাগছে না। ছোটলোকদের মতো মাথা মালিশ করাচ্ছিস?
লজ্জা লাগার কী আছে? শরীর আরাম পাচ্ছে। শরীরে বাস করছে আত্মা। কাজেই আত্মাও আরাম পাচ্ছে।
ফাজলামি করছিস? তোকে এত দিন কী শিখিয়েছি? যা শিখিয়েছি। সব ভুল মেরে বসে আছিস?