আপনার কথা শুনে নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে স্যার।
আমরা জানি আপনি কি কি করেছেন। এম্বুলেন্স ডেকেছেন। রোগী নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। রাত দুটায় ধানমন্ডির এক বাসায় গেছেন। আবার হাসপাতালে গেছেন। ভোর সাতটায় গনিমিয়া টি স্টলে নাশতা খেয়েছেন। আমি সবই জানি।
আপনি তো স্যার মোটামুটি ইশ্বরের কাছাকাছি চলে গেছেন। ইশ্বর যেমন সব জানেন, আপনিও সব জানেন।
আমি বাইরের কর্মকাণ্ড জানি। আপনার মনের ভেতর কি কাণ্ডকারখানা হচ্ছে সেটা জানি না।
সেটা স্যার আমিও জানি না।
আপনার রোগীর কি অবস্থা সেটা জানেন?
জি না।
রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। আমি ভোরবেলা খবর নিয়েছি। রাত সাড়ে তিনটার সময় হার্ট থেমে গিয়েছিল। ডাক্তাররা ইলেকট্ৰিক শক দিয়ে চালু করেছেন।
ও।
রোগী আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আপনি নাকি তাকে কথা দিয়েছেন। তার মেয়েকে এনে দেবেন। তিনি মেয়েকে দেখতে চান। মেয়েটা কোথায় থাকে বলুন–আমি আনিয়ে দিচ্ছি। পুলিশ চলে যাবে। প্রয়োজনে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসবে।
বলেন কী। এই মেয়েকে আপনি আনাবেন কীভাবে?
আমি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললাম, দেখি চেষ্টা করে। স্যার আপনার টেলিফোনটা একটু ব্যবহার করি?
ওসি সাহেব টেলিফোন এগিয়ে দিলেন। আমি আশাকে টেলিফোন ধরলাম।
আশা তুমি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করবে? তোমার মাথায় ফুলফল ঘুরছে। তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। এই কাজটা করলে তোমার মাথা থেকে ফুল লুফল দূর হয়ে যাবে।
আপনিত শুধু জ্ঞানী না। আপনি একজন ডাক্তারও? হাউ ফানি।
কারো যখন খুব ঘনঘন হেঁচকি উঠতে থাকে তখন ভয়ঙ্কর কিছু করলে হেঁচকি থেমে যায়। তুমি যদি ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার সামনে দাঁড়াও তোমার হেঁচকি থেমে যাবে।
কী করতে হবে আমাকে?
অভিনয় করতে হবে। মৃত্যুপথ যাত্রী এক বৃদ্ধের মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে।
আমার সঙ্গে খেলা করবেন না। প্লিজ ডোন্ট প্লে গেমস উইথ মি।
আমি খেলা খেলছি না। অভিনয় অংশে তোমার নাম অহনা।
প্লিজ স্টপ ইট।
নাটকে তোমার বাবার নাম জয়নাল। এই জয়নাল তার মেয়েকে দুবছর বয়সে শেষ দেখা দেখেছে। এখন মেয়ের বয়স আঠারো। মেয়ের বাবা মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। মৃত্যুর সময় মেয়ের স্নেহময় মুখ দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছেন।
এই মিথ্যার মানে কী?
কোনো মানে নেই। আবার হয়তো মানে আছে। আশা তুমি চলে এসো। সোহরাওয়ার্দি হৃদরোগ হাসপাতাল। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। যার নাম আশা সে যদি আশাহীন মানুষের মনে আশা না জাগায় কে জাগাবে? তুমি কি আসবে?
ওসি সাহেব অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, মেয়েটা কী বলল? আসবে?
আমি বললাম, বলেছে আসবে না। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে আসবে।
আপনি কি এখন হাসপাতালে যাচ্ছেন?
জি।
আমি কি আপনার সঙ্গে হাসপাতালে যেতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
এসো করো স্নান নবধারা জলে
নকল দৃশ্য। বানানো, মিথ্যা। কিন্তু দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না। আশা গভীর মমতায় জয়নাল সাহেবের বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। যে কোনো মুহূর্তে চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়বে। মন বড় টলমল করছে।
জয়নাল সাহেব বিড়বিড় কথা বলছেন; যে গাঢ় মমতা নিয়ে তিনি কথা বলছেন-— এত মমতায় এর আগে কি কোনো পিতা তাঁর কন্যার সঙ্গে কথা বলেছে?
মাগো তুমি যে আসবা আমি জানতাম। হিমু ভাইকে যখন হাতজোড় করে বললাম আমার মেয়েটাকে এনে দেন। হিমু ভাই, হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। কিন্তু আমি বুঝেছি— কাজ হয়েছে। হিমু ভাই আমার মেয়েকে এনে উপস্থিত করবে।
আশা ফিসফিস করে বলল, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, প্লিজ কথা বলবেন না।
জয়নাল সাহেব শান্ত গলায় বললেন, মাগো আমার কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু কী শান্তি যে পাইতেছি এটা একমাত্র আমি জানি আর আল্লাহ পাক জানেন। মা শোনা আমার সময় হয়ে এসেছে। আমি চলে যাব। যাবার আগে তোমার জন্যে দোয়া করে গোলাম— খাস দিলে দেয়া করলাম।
ধন্যবাদ।
মাগো শোন, মানুষ তো ফেরেশতা না। মানুষ ভুল করে। আমি ভুল করতে পারি। আবার তোমার মা-ও ভুল করতে পারে। ভুলগুলো মনে রাখবা না।
জি আচ্ছা।
তোমার চেহারাও তোমার মার মতো। সেই নাক সেই চোখ! চুল কটা। তোমার মার চুলও ছিল কটা। বড় সুন্দর মা। মাগো তুমি নানান দেশ বিদেশ ঘুরবে—
উঁচু কপালী চিড়ল দাঁতি
পিঙ্গল কেশ
ঘুরবে কন্যা নানান দেশ
কোনো একটা সমস্যা মনে হয় হয়েছে। ডাক্তার নার্সরা ছোটাছুটি শুরু কের করেছেন। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে আশা।
আমি ওসি সাহেবকে নিয়ে বাইরে চলে এলাম। ওসি সাহেবের চোখ ভর্তি পানি। তিনি চাপা গলায় বললেন–খুবই কষ্ট পেলাম। খাকি পোশাক পরে–চোখের পানি ফেলা যায় না। খাকি পোশাকের এতে অপমান হয়। কিন্তু চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। সরি।
অনেকদিন পর আজ আবার বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ ভরতি হয়ে যাচ্ছে ঘন কালো মেঘে। আমি ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম–ওসি সাহেব বৃষ্টিতে কবে শেষবার ভিজেছেন বলুন তো?
ওসি সাহেব রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বললেন—খুব ছোটবেলায় ভিজেছি।
আজ চলুন তো আমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবেন। নাকি খাকি পোশাক পরোপ বৃষ্টিতে ভিজলে পোশাকের অপমান হবে?
না অপমান হবে না।
আমরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগোচ্ছি। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। লোকজন অবাক হয়ে দেখছে। কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে খাকি পোশাক পরা কেউ এভাবে বৃষ্টিতে ভেজে না।