আপনি মনে হচ্ছে বিরাট জ্ঞানী। জগতের সব জ্ঞান নিয়ে নিয়েছেন। আপনার জ্ঞানের ভাণ্ডার আমাকে দেখানোর দরকার নেই।
রাগ করছ কেন?
রাগ করছি না। আপনি আপনার পেমেন্ট নিতে এসেছেন নিয়ে চলে যান। আপনার পাওনা কত?
দু শ ডলার। বাংলাদেশী টাকায় দশ হাজার টাকা। পেমেন্টটা বাংলাদেশী কারেন্সিতে করলে ভালো হয়।
আপনি আপনার খালার কাছে গিয়ে বসুন। আমি টাকা নিয়ে আসছি।
থ্যাংক য়্যু।
আমার ধারণা এত টাকা ঘরে নেই। ব্যাংক না খুললে দিতে পারব না। আপনি কি আগামীকাল ব্যাংক আউয়ারের পরে এসে টাকাটা নিতে পারেন?
আমার টাকাটা এখনি দরকার।
আপনি ড্ররিং রুমে বসুন। দেখি কী করা যায়।
হাসপাতালে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা বেজে গেল! জয়নাল সাহেবকে রাখা হয়েছে ইনটেনসিড কেয়ার ইউনিটে। দর্শনার্থীদের সেই ঘরে প্রবেশ নিষেধ। মহিলা ডাক্তারের দয়ায় সেখানে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল। জয়নাল সাহেব চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে নানা রকম তার লাগানো। মনিটরে কী সব দেখা যাচ্ছে। পিপি পিপ শব্দ হচ্ছে। আমি জয়নাল সাহেবের কপালে হাত রাখতেই তিনি জেগে উঠলেন। চোখ মেলে ক্লান্ত গলায় বললেন, হিমু ভাই আপনাকে বিরাট তকলিফ দিলাম। আপনার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী। দয়া করে ক্ষমা করুন।
ক্ষমা করলাম। আপনার মনে হয় কথা বলা নিষেধ। কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আমি বরং কিছুক্ষণ আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। আপনার কাছে শেখা বিদ্যা কাজে লাগাই।
জয়নাল সাহেব আমার হাত ধরে ফেললেন। ফিসফিস করে বললেন, আমার কথা বলা নিষেধ আমি জানি। কিন্তু আমার সময় শেষ হয়ে গেছে! কথা বলার সুযোগ আর পাব না।
সময় শেষ কে বলল?
কেউ বলে নাই। এইসব জিনিস বোঝা যায়। যতবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আমি আমার মৃত আত্মীয়স্বজনদের দেখি। এরা বিছানার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। এরা আমাকে নিতে এসেছে। এখনো বসে আছে–আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। আমি আবছা আবছা দেখছি।
ও।
আমার বাবার পাশে আমার বড় মা বসে আছেন। আপনাকে বলতে ভুলে গেছি। আমার বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের দুই মাসের মাথায় তার প্রথম স্ত্রী মারা যায়। উনাকে আমি কখনো দেখি নি। কিন্তু আজ বাবার পাশে দেখেই চিনেছি। আমার নিজের মা বসে আছেন উলটো দিকে।
আপনি কি দয়া করে কথা বলা বন্ধ করবেন?
হিমু ভাই কয়েকটা জরুরি কথা আপনাকে বলব। না বললে আর বলা হবে না। যদি ইজাজত দেন।
বলুন।
আমার মেয়েটার সঙ্গে একবার দেখা হওয়া খুব প্রয়োজন ছিল। তাকে একটা কথা বললে মনটা শান্ত হত।
কী কথা?
বেচারী নিশ্চয়ই ধারণা করে আছে তার বাবা ভয়ঙ্কর একটা মানুষ। তার মার মুখে এসিড মারার জন্যে এসিড কিনে লুকিয়ে রেখেছিল। আমার সম্পর্কে এত বড় একটা খারাপ ধারণা তার থাকবে ভাবলেই অস্থির লাগে। মেয়েটাকে যদি বলতে পারতাম— সমস্ত ঘটনাটা সাজানো। মন শান্ত হত।
মেয়েটাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললে অন্য একটা সমস্যা হবে। মেয়েটা সারাজীবন তার মার সম্পর্কে ভয়ঙ্কর খারাপ ধারণা নিয়ে থাকবে। এটা কি ঠিক হবে?
জয়নাল সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বললেন, না ভাই সাহেব এটাও ঠিক হবে না। বাবার সম্পর্কে খারাপ ধারণা থাকলে তেমন কিছু যায় আসে না, কিন্তু মার সম্পর্কে খারাপ ধারণা থাকলে কোনো ছেলে মেয়ে বড় হতে পারে না। আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ধরে দিয়েছেন। এই জন্যেই আপনাকে এত পছন্দ করি। লোকে যে বলে— আপনার পাওয়ার আছে। এটা ঠিক? আসলেই আপনার পাওয়ার আছে।
আপনি ঘুমান আমি চলে যাই। আমি থাকলে আপনি ঘুমুতে পারবেন না।
ভাই সাহেব।
জি।
একটা শেষ কথা বলি মনে কিছু নিবেন না।
বলুন।
আপনার পাওয়ার আছে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতা দিয়ে আপনি মেয়েটার সঙ্গে আমার শেষ দেখা করিয়ে দিন। স্বয়সে আমি আপনার অনেক বড় তবুও করজোড়ে ভিক্ষা চাচ্ছি।
ভাই আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আমার একমাত্র ক্ষমতা হল খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটা। বিভ্ৰান্তিকর কথাবার্তা বলে মানুষকে বিভ্ৰান্ত করে দেওয়া।
হিমু ভাই আমি জানি আপনি ইচ্ছা করলেই পারবেন। হাত জোড় করছি ভাই সাহেব। মৃত্যুপথ যাত্রীর শেষ অনুরোধ।
জয়নাল সাহেবের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তিনি হাত জোড় করে আছেন।
একটা মিথ্যা আশ্বাস কি জয়নাল সাহেবকে দেব? সেটা কি ঠিক হবে? আমার বাবা তার পুত্রের জন্যে কিছু কঠিন উপদেশ লিখিতভাবে দিয়ে গিয়েছিলেন।
মিথ্যা সম্পর্কে তিনি বলেছেন–
হে আমার প্রিয় পুত্ৰ, মিথ্যার কিছু কিছু উপকার আছে। কিছু মিথ্যা সমাজের এবং ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে কল্যাণকর ভূমিকা নেয়। কিন্তু মিথ্যা মিথ্যাই। সত্য আলো, মিথ্যা অন্ধকার। তোমার যাত্রা আলোর দিকে। মিথ্যা ছলনাময়ী নানান ছলনায় তোমাকে ভুলাইবে। তুমি ভুলিও না; কখনো না, কোন অবস্থাতেই না। ইহা আমার আদেশ।
ভোর চারটার মেসে ফিরে
ভোর চারটার মেসে ফিরে দেখি— আবুল কালাম সাহেব আমার ঘরে বাসা। চেয়ারে পা তুলে বসেছেন। মনে হচ্ছে মানুষ না কাপড়ের পুঁটলি। কতক্ষণ ধরে বসে আছেন কে জানে। মানুষটা ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্তা লাগছে। গলায় ফুলের মালা নেই। ফুলের মালা পাঞ্জাবির পকেটে রাখা হয়েছে। মালার একটা অংশ পকেটের বাইরে। গাদা ফুলের জীবনী শক্তি ভালো। এতক্ষণেও ফুল চুপসে যায় নি। আমি হালকা গলায় বললাম, কালাম সাহেবের খবর কী?