ফাজলামি করবেন না।
জি আচ্ছা স্যার।
আবুল কালাম লোকটা কে?
গুরুত্বপূর্ণ কেউ না স্যার।
গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই পুলিশের আইজি তার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। সে সাধারণ লোক হবে কীভাবে?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, পুলিশের আইজি ইন্টারেস্টেড কারণ তাকে অনেক উপর থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে।
সেই অনেক উপরটা কী?
তা তো স্যার বলা যাবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি আবুল কালামকে নিয়ে চলে যান।
ছেড়ে দিচ্ছেন।
জি ছেড়ে দিচ্ছি। চা খাবেন?
না চা খাব না। তবে ছোট্ট একটা কাজ করলে খুব উপকার হয়— মারের চোটে আবুল কালাম সাহেবের নাকের লোম বের হয়ে গেছে। উনি একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। নাক দিয়ে লোম বের করা অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া ঠিক না। যদি তাঁর নাকের লোমগুলি একটু ছোট দেবার ব্যবস্থা করেন। খুব উপকার হয়।
ওসি সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তার মানে?
আপনাদের ডিউটি অফিসারকে বললেই বুঝবেন। উনি কোনো কারণ ছাড়া আমাকে হাজতে ঢুকিয়েছেন। উনি যদি কষ্ট করে আবুল কালাম সাহেবের নাকের লোম ছোট দেন— তা হলে আমি কিছু মনে রাখব না। কবি বলেছেন–Forget and Forgive, ক্ষমাই মহত্বের লক্ষণ। উনাকে দেখেই বুঝেছি। উনি মহান। উনি মহান। উনি মহান একুশে।
ওসি সাহেব আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বেল টিপে ডিউটি অফিসারকে ডাকালেন।
আমি গলা নামিয়ে অতি বিনিয়ের সঙ্গে বললাম, আরেকটা ফুলের মালা যদি আনিয়ে দেন। আবুল কালাম সাহেবের গলায় মালাটা পরাব। গলায় মালা পরে জেল থেকে অনেকে বের হয়েছেন। হাজত থেকে কেউ বের হন নি। একটা রেকর্ড হয়ে যাক।
আপনার নাম হিমু?
জি।
এই দিন দিন না। আরো দিন আছে— এই গানটা শুনেছেন?
টিভিতে দেখেছি স্যার। কুদ্দুস বয়াতী একদল বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গানটা করে।
গানের কথাগুলি মনে রাখবেন। ভবিষ্যতে আপনাকে যদি আমি ট্রিট করতে না পারি তা হলে আকিকা করে আমি আমার নাম আলম খান বদলায়ে রাখব।–কুত্তা খান। আপনি আকিকার দাওয়াত পাবেন।
রাগে ওসি সাহেবের শরীর কাঁপছে। তিনি রাগ সামলাতে পারছেন না। ডিউটি অফিসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওসি সাহেব তার দিকে তাকিয়ে বললেন–এই লোক কী বলছে শুনুন আর একটা ফুলের মালা আনিয়ে দিন।
আবুল কালাম সাহেবের গলায় গাদা ফুলের মালা। তিনি এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছেন। আমি বললাম, শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?
জি না।
মালা গলায় নিয়ে হাঁটতে যদি খারাপ লাগে মালাটা খুলে ফেলুন।
জি না।
রিকশা নেব?
না।
যাবেন কোথায় ঠিক করেছেন? মেসে ফিরে যাবেন?
না।
ঢাকায় আত্মীয়স্বজন কেউ আছে? ঠিকানা বলুন সেখানে নিয়ে যাই। ঢাকায় তেমন পরিচিত কেউ নাই। দেশের বাড়ি চলে যাব চাঁদপুর। লঞ্চে করে যাব।
চা খাবেন? চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে বসে চা খাই, তারপর ঠিক করি কী করা হবে। চাঁদপুরে চলে যেতে চাইলে চলে যাবেন।
পুলিশের কাছে হাজিরা দিতে হবে না?
না। আপনাকে পুলিশ আর ঘাঁটাবে বলে মনে হয় না। আইজি সাহেব আপনার প্রসঙ্গে যেভাবে বলেছেন তারপর আর কিছু বলার থাকে না।
উনি কি বলেছেন আমি সৎ লোক।
অবশ্যই।
কেন বলেছেন। উনি তো আমাকে চিনে না।
আমি তাঁকে বলতে ঘলেছিলাম। উনি আপনাকে না চিনলেও আমি চিনি।
হিমু ভাই আপনার ধারণা আমি একজন সৎ লোক?
অবশ্যই।
আবুল কালাম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, এই প্রথম একজন কেউ বলল, আমি সৎলোক। এর আগে কেউ কোনোদিন বলে নাই। স্কুলে পড়ার সময় আমি একবার একটা কলম চুরি করেছিলাম— তারপর আমার নাম হয়ে গেল— চোর কালাম! স্কুলে দুজন কালাম ছিল। তাকে ডাকত ভালো কালাম, আমাকে ডাকত চোর কালাম।
কে কী ডাকত তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি তো জানেন। আপনি কী? আপনি নিজেকে জানেন না?
জানি। আমি হলাম চোর কালাম। দুই লাখ টাকা আমি সত্যিই চুরি করেছি। আপনি ফুলের মালা গলায় পরিয়ে একটা চোরকে বের করে নিয়ে এসেছেন। কাজটা ঠিক করেন নাই।
কালাম সাহেব বড় বড় করে নিশ্বাস নিচ্ছেন। আমি তাকিয়ে আছি। কালাম সাহেব তাকালেন আমার দিকে। শান্ত গলায় বললেন, আমি এখন সদরঘাট টার্মিনেলে চলে যাব। সেখান থেকে যাব চাঁদপুর। ভাই সাহেব যাই?
ফুলের মালা গলায় দিয়ে কালাম সাহেব হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। আরো অনেকেই তাকে দেখছে। গাদা ফুলের মালা গলায় দিয়ে ঢাকা শহরে কেউ হাঁটাহাটি করে না।
জয়নাল সাহেব
জয়নাল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গায়ে জ্বর, বুকে সামান্য ব্যথা। বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়— উঠে বসলেই বুক ধড়ফড় করে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কিছু খেতেও পারছেন না। খাবার মুখে দিলেই বমি আসে। তার চেহারা একদিনে নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, গোলগাল মুখ লম্বাটে হয়ে গেছে। কথাও বলছেন হাসের মতো ফ্যাসফেসে গলায়।
অসুখটা হয়েছে আমার কারণে। আমি আবুল কালামকে দেখতে গিয়ে ফিরছি না দেখে তিনি টেনশনে অস্থির হয়ে আমার খোঁজ নিতে থানায় যান। সেখানে জানতে পারেন আমাকে হাজতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখনি তাঁর বুকে ব্যথা শুরু হয়। থানার সামনের রাস্তার পাশের নর্দমায় দুবার বমি করেন। লোকজন তাঁর অবস্থা দেখে ফুটপাতেই শুইয়ে দেয়। আধঘণ্টা ফুটপাতে বিশ্রাম করে মেসে ফিরে শয্যাশায়ী।
আমি বললাম, সামান্য কারণে বুকে ব্যথা বাধিয়েছেন? উঠে বসুন তো। আমি ঠিকঠাক মতো ফিরে এসেছি।