এখানে কী করছেন?
বসে আছি।
বসে আছেন সে তো দেখতেই পাচ্ছি। নিজের ঘর ছেড়ে আমার ঘরে বসে আছেন কেন?
রাগ করছেন?
রাগ করি নি। তবে খুবই অবাক হচ্ছি। আপনি রাতে প্রায়ই আমার ঘরে আসেন। তাই না?
জি।
এসে কি করেন? বিসকিট খান?
বিসকিট এর আগে একবার শুধু খেয়েছি। সেদিন খেয়েছিলাম দুটা, আজ খেয়েছি একটা।
ও আচ্ছা।
মাঝে মধ্যে সিগারেট খাই। সিগারেটের প্যাকেট যদি টেবিলে থাকে তখনই খাই। আপনার বালিশের নিচে থাকলে খাই না, আপনার ঘুম ভেঙে যাবে। এটা তো বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভদ্রলোকের বিবেচনায় মুগ্ধ হয়েই বোধ হয় বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি সহজ ভঙ্গিতে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। তবে সিগারেট ধরালেন না। নিচু গলায় বললেন, ভাই সাহেব নিশ্চয়ই আমাকে পাগল ভাবছেন? এবং আমার উপর খুবই রাগ করছেন। রাত বিরাতে আপনার ঘরে ঢুকি। নিজের মতো ঘোরা ফিরা করি। বিস্কুট খাই, সিগারেট খাই। ট্রেসপাসিং কেইস। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে পুলিশেও দিতে পারেন। পুলিশেই দেওয়া উচিত। আমি নিজে হলেও তাই করতাম। এই ধরনের কাজ করে আমি বড় লজ্জিত! ক্ষমা করবেন।
জয়নাল সাহেবের কথা শুনে মনে হচ্ছে না। তিনি লজ্জিত কিংবা দুঃখিত। তিনি বিস্কুটের টিন খুলে আরেকটা বিস্কুট নিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হচ্ছে বিস্কুট খেতে সংকোচ বোধ করছেন; আমার অনুমতি ছাড়া খাবেন না। আমি বললাম, খান বিস্কুট খান।
জয়নাল সাহেব ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বললেন–ব্রাত জাগলে প্রচণ্ড ক্ষিধে লাগে। রাত তিনটার পর ক্ষিধার চোটে মাথা অউলা হয়ে যায়। আমার বিছানায় একটা কোল বালিশ আছে। কোল বালিশকে মনে হয় কলা। কভার খুলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।
রাজ জাগেন কেন?
এই তো আসল প্রশ্ন করেছেন। রাত জাগি কারণ আমার রাতে ঘুম হয় না। শুনলে মনে করবেন বানিয়ে বলছি। একুশ বছর আমি রাতে ঘুমাই নাই। সামান্য ভুল বললাম, একুশ বছর এখনো হয় নাই সামনের নভেম্বরের নয় তারিখে একুশ বছর হবে।
একুশ বছর ধরে আপনি রাতে ঘুমান না?
জি না।
দিনে ঘুমান তো? না কি দিনেও ঘুমান না?
সূর্য উঠার পর ঘণ্টা খানিক ঘুম হয়। তাও সবদিন না। যেমন ধরেন গত শনিবারে আর সোমবারে দিনে সামান্য ঘুম হয়েছে।
ডাক্তার দেখিয়েছেন?
ডাক্তার কবিরাজ সবই দেখিয়েছি। টোটকা চিকিৎসা করিয়েছি। যে যা করতে বলেছে করেছি। একজন বলল বাদুড়ের মাংস খেতে। বাদুড়ও তো রাতে ঘুমায় না। কাজেই বাদুড়ের মাংস খেলে বিষে বিষক্ষয় হবে।
বাদুড়ের মাংস খেয়েছেন?
জি। বাদুড় ধরাতো মুশকিল। আমাদের গ্রামের এক ভাঙা মন্দির থেকে তিনটা বাদুড় ধরেছিলাম। আমি ধরি নি— জিতু বলে একটা ছেলে দশ টাকার বিনিময়ে ধরে দিয়েছিল। কেউ রান্না করতে চায় না। শেষে আমি নিজেই রান্না করলাম। রান্না তো না তেল মশলা দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করেছি।
খেতে কেমন ছিল?
অত্যন্ত সুস্বাদু। মাংসটাও সুন্দর লাল। টকটকে মাংস; নরম। প্রথমে খুবই ঘেন্না লাগছিল। একটুকরা মুখে দেবার পর ঘেন্না কেটে গেল! চেটেপুটে খেয়েছি। তবে যে কারণে খেয়েছি তার কিছু হয় নি। ঘুম হয় নি।
জয়নাল সাহেব সিগারেট ধরালেন। অনিদ্রার রোগী রাতে কথা বলার সঙ্গী পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়। ভদ্রলোকের তাই হয়েছে। মনের আনন্দে কথা বলে যাচ্ছেন।
বুঝলেন ভাই সাহেব রাতে ঘুম হয় না। নিজের ঘরে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়। রাস্তায় গিয়ে যে হাঁটাহঁটি করব সেই উপায় নেই–এরা স্নাত বারটার সময় কোলাপসিবল গোট বন্ধ করে দেয়। মেসের বারান্দায় হাঁটাহঁটি করি। আপনার ঘর সব সময় খোলা থাকে। একরাতে টুক করে আপনার ঘরে ঢুকে পড়লাম। সেই থেকে অভ্যাস হয়ে গেল। বাংলা প্রবচন আছে না— জুর হইয়া বউ লেংটা হইল, সেই থাইক্যা বউ এর অভ্যাস হইল। এই প্রবচনটা শুনেছেন?
জি–না।
এটা আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রবচন। একটু অশ্লীল। নিজগুণে ক্ষমা করে নেবেন। প্রবচনটার অর্থটা পরিষ্কার করে না বললে বুঝবেন না। গ্রামের এক বউ-এর প্রচণ্ড জ্বর উঠেছে। জ্বরের ঘোরে মাথা ঠিক নাই গায়ের কাপড় চোপড় খুলে ফেলেছে। সবার সামনেই পুরো নগ্ন। এর থেকে তার হয়ে গেল অভ্যাস। কথা নাই বার্তা নাই ফট করে কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে পড়ে। সার কথা হল মানুষ অভ্যাসের দাস। প্রবচনটা এখন কি বুঝতে পেরেছেন?
জি বুঝতে পারছি।
আপনার সঙ্গে কথা বলে খুবই ভালো লাগছে। রাতের পর রাত একা বসে থাকি। গল্পের বই পড়ার অভ্যাস নাই। তাও পড়ার চেষ্টা করেছি। ভালো লাগে না। শরৎচন্দ্রের একটা বই কিনলাম। দোকানদার বলেছে খুবই ভাল বইদেনা পাওনা নাম। এতবার সেই বই পড়েছি প্ৰায় মুখস্থ হয়ে গেছে। যেমন ধরেন শুরুটা বলি–
চন্ডীগড়ের চন্দ্রী বহু প্ৰাচীন দেবতা। কিংবদন্তী আছে রাজা বীরবাহুর কোন এক পূর্বপুরুষ কি একটা যুদ্ধে জয় করিয়া বারই নদীর উপকূলে এই মন্দির স্থাপিত করেন, এবং পরবর্তীকালে ইহাকেই আশ্রয় করিয়া চড়ীগড় গ্রামখানি ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছিল।… আরো বলব?
না, আর বলতে হবে না। খবরের কাগজ পড়ি এতে কিছু সময় যায়। খবরের কাগজের কিছুই বাদ দেই না। সবই পড়ি। দুইবার করে পড়ি। জেনারেল নলেজের পরীক্ষায় কেউ আমার সঙ্গে পারবে না। বলেন দেখি গৌতমবুদ্ধের জন্ম কোথায় হয়েছে? গত পরশু পেপারে ছিল। বৈশাখী পূর্ণিমা ছিল তো সেই উপলক্ষে একটা আর্টিকেল ছাপা হয়েছে— আমি তিনবার পড়লাম। বলতে পারবেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম কোথায় হয়েছে। একটা হিনটস দেই প্ৰথম অক্ষর ল।