এক ঘণ্টা ঝুম বৃষ্টি ঢাকা শহর আচল করে দেবার জন্যে যথেষ্ট। রাত তিনটা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন বাজছে নটা। ছয় ঘণ্টা এক নাগাড়ে বৃষ্টিতে শহর পানিতে ডুবে যাবার কথা। ডুবন্ত শহর দেখারও আনন্দ আছে। চৈত্রদিনের শুকনো শহর আর বর্ষা দিনের ডুবন্ত শহরের মধ্যে আকাশ পাতালের চেয়েও বেশি ফারাক। এক শহরের দুই রূপ না, যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুটা শহর।
প্রতিটি বড় রাস্তা নদী হয়ে গেছে। রাস্তায় নদীর স্রোতের মতো স্রোত আছে। ঘূর্ণি পর্যন্ত আছে। অবস্থা যা জোয়ারভাটা থাকাও বিচিত্র না। ফুটপাতেও এক হাঁটু পানি। ম্যানহোলের খোলা ঢাকনা যখন চোখে দেখা যায়। তখনো মানুষ ম্যানহোলে পড়ে যায়— আর আজ তো পানিতেই সব ঢাকা। আজ এগুতে হবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে। প্রথম পা ম্যানহোলে পড়ল। কিনা। এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই দ্বিতীয় পা তুলতে হবে।
রাস্তার জায়গায় জায়গায় গাড়ি ডুবে আছে। গাড়ির মালিকরা অসহায় ভঙ্গিতে টোকাই জোগাড় করার চেষ্টা করছে। গাড়ি ঠেলতে হবে। টোকাইরা গাড়ির চাকার হাওয়া ছেড়ে দেওয়াতে যেমন দক্ষ— গাড়ি ঠেলার ব্যাপারেও সেরকমই দক্ষ। একটা সাধারণ পনের শ সিসি গাড়ি ঠেলার জন্যে চার জন টোকাই-ই যথেষ্ট। মহানন্দে তারা গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাবে। বখশিশ, পেলে ভালো। না পেলেও কোনো ক্ষতি নেই। গাড়ি ঠেলতে পারার আনন্দেই তারা আনন্দিত।
হরতালের দিন এইসব রাস্তায় ক্রিকেট খেলা হয়। আজ হচ্ছে সাতার সাতার খেলা। এরশাদ সাহেবের পথিকলিয়া পানিতে লাফালাফি ব্যাপাঝাপি করছে। এরমধ্যে একটা কলাগাছও দেখি যোগাড় হয়েছে; কলাগাছ ধরে সাতার দেবার চেষ্টা হচ্ছে। একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে অতি গম্ভীর মুখে কলাগাছে বাসা। তিন-চারটা তার বয়সী ছেলে কলাগাছ ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। যেন মেয়েটি বর্ষারানী। বৃষ্টি উৎসবের রানী। অতি মজাদার দৃশ্য। সিএনএন টিভির লোকজন থাকলে এই দৃশ্য ক্যামেরায় নিয়ে নিত। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের জলকেলি শিরোনামে মজার কোনো রিপোর্ট পৃথিবীর মানুষরা দেখতে পেত।
বিকল্প ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মানুষজন পারদর্শী। কাপড় না ভিজিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুটা টুলবাক্সের সাহায্যে কাজটা করা হচ্ছে। দুটাকা করে পারানি। আরো তিন-চারদিন এই অবস্থা চললে অতি অবশ্যই রাস্তায় নৌকা নেমে যাবে। আওয়ামী নেতারা মুজিবকোট গায়ে দিয়ে হাসিমুখে বলবেন— বলেছিলাম না নৌকা ছাড়া আমাদের গতি নাই। দেখলেন তো?
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল আশা। এক সেকেন্ড দেরি হল না। মনে হল দরজায় হাতল ধরে সে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ বেল টিপবে। আর সে দরজা খুলবে।
আমি বললাম— চল বের হয়ে পড়ি বৃষ্টি নেমেছে।
আশা বলল, আপনার একী অবস্থা। ভিজে কী হয়েছেন? হাতের চামড়া নীল হয়ে গেছে। আপনার ছাতা নেই?
না।
এমন বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া বের হয়েছেন? আপনার তো অসুখ করবে।
তুমি সময় নষ্ট করছ, কেন। বৃষ্টি থাকতে থাকতে বের হতে হবে।
ঘরে ঢুকবেন না?
গা দিয়ে পানি পড়ছে। এই অবস্থায় কার্পেটওয়ালা ঘরে ঢোকা যাবে না।
টাওয়েল দিচ্ছি গা মুছে নিন।
আবার তো ভিজতেই হবে গা মুছে লাভ কী?
এ রকম বৃষ্টি আমি আমার জীবনে দেখি নি। কী অদ্ভুত কাণ্ড! নন স্টপ বৃষ্টি।
পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে বের হয়ে এসো।
গরম কফি বানিয়ে দেব। আপনি শীতে কাঁপছেন।
কিচ্ছু লাগবে না। তুমি বের হও। গামবুট, রেইন কোট ছাতা সব আছে তো?
সবই আছে। তবে আমি কোনোটাই নেব না। আপনি যেভাবে বের হয়েছেন আমি ঠিক সেভাবেই বের হব! আপনার মতো খালি পায়ে হাঁটব।
সেকী?
শুধু শাড়ি পাল্টে প্যান্ট শার্ট পরব। ভেজা শাড়ি গায়ে লেস্টে থাকলে দেখতে খুব খারাপ লাগবে। আপনার পরিকল্পনা কী? আজ আমরা কী দেখব? পাইপে বসে বৃষ্টি?
পাইপে বসে বৃষ্টি বিলাস করা হবে। ইলিশ খিচুড়ি খাওয়া হবে। তবে তার আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হবে। সেখানে কদম ফুলের গাছ আছে। গাছ থেকে কদম ফুল ছিঁড়তে হবে।
কেন?
কদম ফুল ছাড়া বর্ষা যাপন হয় না?
তার মানে?
বর্ষা দেখতে হলে কদম ফুল লাগে। একেকটা দেখার একেক রকম নিয়ম। জোছনা দেখতে হয় সাদা রঙের কাপড় পরে। কালো কাপড় পরে জোছনা দেখা যায় না। একইভাবে বর্ষা দেখতে কদম ফুল লাগে?
কে বানিয়েছে এসব নিয়ম।
আমি হাসলাম। জবাব দিলাম না। আশা গেল কাপড় বদলাতে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল, আবারো মেঘা জমতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আজ। সারাদিনে বৃষ্টি ধরবে না। মেঘের পরে মেঘা জমবে। আঁধার হয়ে আসবে। রূপা তার সারাউন্ড সিস্টেমের ট্রাম্পেটের কোনো সিডি চালিয়ে দেবে। বৃষ্টি নামলেই তার নাকি ট্রাম্পেট শুনতে ইচ্ছা করে।
রাস্তায় নেমে আশা বাচ্চ মেয়ের মতো চেঁচিয়ে বলল what a day!
আমি বললাম, খুব মজা লাগছে।
আশা বলল, মজা না, অন্য রকম লাগছে। গায়ে যেমন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরও পড়ছে। শুধু যদি গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ত তা হলে হত মজা বা ফান : যেহেতু বৃষ্টির ফোঁটা শরীরের ভেতরও পড়ছে কাজেই এটা আর ফান না— অন্য কিছু। আচ্ছা শুনুন–আপনি তো নানানভাবে আমাকে চমকে দিয়েছেন। আমিও কিন্তু আপনাকে চমকে দিতে পারি। আপনি যদি এই মুহূর্তে আমার হাত ধরেন তা হলে কিন্তু ভয়ঙ্কর চমকবেন।