আমি কিছু বললাম না। মাথা থেকে স্বপ্নটা এখনো যায় নি। স্টিমার চোখে দেখতে না পেলেও তার ইঞ্জিনের ঘরঘর শব্দ এখনো কানো বাজছে। সার্চ লাইটের আলো এখনো আমার চোখে— এই জন্যেই চোখ মিটমিট করছি।
জয়নাল সাহেব গ্লাস ভর্তি করে চা ঢালছেন। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। বড় কোনো আনন্দোর খবর দেবার আগে আগে মানুষের মুখে যে আভা থাকে তার চোখে মুখে সেরকম আভা। চোখে ছলছলে ভাবও আছে। আদরের কনিষ্ঠ কন্যা স্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে বাবাদের চোখে এমন ছলছলো হয়ে যায়। জয়নাল সাহেবের কোনো মেয়ে আছে কিনা জানি না। মনে করে জিজ্ঞেস করতে হবে।
হিমু সাহেব!
জি।
চা-টা খেয়ে আরাম পাবেন। স্পেশাল চা। গনিমিয়ার দোকানের চা। এই চা শুধু দুই জায়গায় পাওয়া যায়। এক ঠাটারি বাজার গনিমিয়ার দোকানে, আর পাওয়া যাবে বেহেশতে। আল্লাহপাক বলেছেন সব ভালো ভালো জিনিস বেহেশতে আছে।
আমি হাত বাড়িয়ে চায়ের গ্লাস নিলাম। জয়নাল সাহেব উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকাতেও ভালো লাগছে।
বুঝলেন ভাই সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে তো। বৃষ্টি দেখেই মনে করলাম গনিমিয়ার দোকানের স্পেশাল চা হিমু ভাইকে খাওয়াই।
ঠাটারি বাজার চলে গেলেন?
জি। প্রথমে একটা ফ্লাস্ক কিনলাম। এত দূর থেকে তো আর কোকের খালি বোতলে কয়ে চা আনা যাবে না। চা, গরম আছে না?
হ্যাঁ গরম।
খেতে কেমন?
অসাধারণ। মনে হচ্ছে লিকুইড অমৃত। মিষ্টি একটু বেশি। অমৃত মিষ্টি তো হবেই।
যখন এই চা খেতে ইচ্ছা করবে। আমাকে বলবেন। ফ্লাস্ক কিনে ফেলেছি চা গরম করা এখন আর সমস্যা না। সামনের মাসে বেতন পেলে একটা কেরোসিনের চুলো কিনব।
কেন?
মাঝে মধ্যে ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা করে। চুলা থাকলে ফন্ট করে রোধে ফেললাম। বৃষ্টি বাদলার দিন– ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে আসলে— ভাজা করে. বা কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে ভাতের মধ্যে দিয়ে ভাপ ইলিশ। আমি ভালো রানতে পারি। রেহানা যখন রান্না করত। আমি পাশে বসে থাকতাম। দেখে দেখে শিখেছি। ইনশাল্লাহ। আপনাকে রোধে খাওয়াব।
আচ্ছা।
রেহানার একবার টাইফয়েড হল। একুশ দিন ছিল জ্বর। আমিই রাঁধতাম।
ভালো তো।
জয়নাল সাহেব খুবই আগ্রহ নিয়ে বললেন, ইলিশ খিচুড়ি খাবেন? ব্যবস্থা করি? বাবুর্চিকে বললেই ব্যবস্থা করে দিবে। পাঁচটা টাকা ধরায়ে দিলে হবে। রান্না আমি নিজের হাতে করব। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে ইলিশ খিচুড়ি না খেলে বৃষ্টির অপমান হবে।
আজ থাক। আরেক দিন।
জয়নাল সাহেব অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন– আজি খুব হিসাব করে বৃষ্টি নেমেছে। শুক্রবার, অফিসে যেতে হবে না। মনে হচ্ছে আল্লাহপাক ইলিশ খিচুড়ি খাওয়ানোর জন্যেই বৃষ্টিটা নামিয়েছেন। নিয়ে আসি একটা ইলিশ কিনো? কী বলেন?
আচ্ছা আনুন। রান্না শেষ হলে সব খাবার টিফিন কেরিয়ারে ভরবেন। টিফিন কেরিয়ার হাতে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে উপস্থিত হবেন।
কোথায় উপস্থিত হব?
ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি–ওই ঠিকানায়।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাব?
অবশ্যই। বৃষ্টি উপলক্ষে খিচুড়ি খাচ্ছেন। বৃষ্টিতে ভিজবেন না?
খুবই ইম্পৰ্টেন্ট কথা বলেছেন ভাই সাহেব। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খিচুড়ি না খেলো— কিসের ইলিশ খিচুড়ি? আপনি ঠিকানা বলে দেন— আমি নিয়ে যাব৷
জয়নাল সাহেবকে ঠিকানা দিয়ে আমি নিচে নোমলাম। বেশি দেরি করা যাবে। না বৃষ্টি থাকতে থাকতেই আশাদের বাড়িতে উপস্থিত হব। একটা ছোট্ট চমক। আশাকে বলেছিলাম দুদিন পর বৃষ্টি নামবে। পাকে চক্ৰে তাই হচ্ছে দুদিন পরই বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি জহির হয়। যথা নিয়মে বৃষ্টি হচ্ছে— আমার কেরামতি জাহির হচ্ছে।
বের হবার মুখে মেস ম্যানেজার আবুল কালামের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার চাকরি আবার হয়তো নট হয়েছে। তিনি ম্যানেজারের চেয়ারে বসে নেই। অন্য চেয়ারে বসা! মুখ অত্যন্ত মলিন। রাতে মনে হয় ঘুমও হয় নি। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। একদিনে বয়স বেড়ে গেছে। এক শালিক দেখা যেমন খারাপ— মলিন মুখে একাকী কেউ বসে আছে দেখা ঠিক সেরকমই খারাপ। চিল মেরে অমঙ্গলের এক শালিক উড়িয়ে দেওয়া যায়। এক মানুষ উড়ানো যায় না। তবে মানুষটার মন ভালো করার চেষ্টা করা যায়। আমি সেই দিকেই অগ্রসর হলাম। হাসি মুখে বললাম, আবুল কালাম সাহেবের খবর কী?
ভালো।
মন খারাপ না-কি?
না।
বৃষ্টি কেমন নেমেছে দেখেছেন? কুকুর বেড়াল বৃষ্টিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই বৃষ্টির নাম সিংহ বাঘ বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজবেন নাকি। বৃষ্টি স্নান করতে চাইলে চলে আসুন।
না।
চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি তো? নিজের চেয়ার ছেড়ে অন্য চেয়ারে বসে আছেন এই জন্যে জিজ্ঞেস করলাম। কোনো সমস্যা হয়েছে?
না।
আবুল কালাম না বললেন খুবই দুর্বল ভঙ্গিতে এবং অন্যদিকে তাকিয়ে-এর অর্থ একটাই, চাকরি আবার নট হয়েছে। চাকরি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত ভদ্রলোকের মুখের বিমৰ্ষভোব কাটবে না। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে বললাম— বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে কই মাছের মনেও আনন্দ হয়। তারা পুকুর ছেড়ে লাফাতে লাফাতে ডাঙায় উঠে আসে। আর আপনি মুখ ভোতা করে বসে আছেন?
আবুল কালাম বিরক্ত মুখে বললেন— আমি তো কই মাছ না। খামখা লাফালাফি করব কেন? আপনি বৃষ্টিতে ভিজে লাফালাফি করেতে চান করেন। কেউ তো আপনাকে না বলছে না।
চাকরি চলে গেছে?
হ্যাঁ চলে গেছে। খুশি হয়েছেন? যান এখন খুশি মনে বৃষ্টিতে ভিজেন।