হামিদ পিটুনি খেয়েছিল?
জি খেয়েছে। সেই দিন এশার ওয়াক্তে ওদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। সবাইকে বেঁধে পিটিয়েছে। হামিদের গালে লাঠির বাড়ি মেয়েছিল—চোয়ালের হাড্ডি ভেঙে মুখ বেঁকে গেল। আর ঠিক হল না। তার নাম হয়ে গেল— গাল ভাঙা হামিদ। আমাদের ক্লাসে দুটা হামিদ ছিল। একজন হল গালভাঙী হামিদ।–আরেকজনের নাম অশ্লীল বলা যাবে না। গালভাঙা হামিদ প্রায়ই মেসে আসে। একদিন আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।
জি আচ্ছা।
উঠতে যাব। কালাম সাহেব বিনয়ী গলায় বললেন— রূপা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলবেন না। অনেক দিন কথা বলেন না, এই জন্যে বললাম। অন্যকিছু না। টাকা সট থাকলে বাকিতে করেন। পরে দিয়ে দিলেই হবে। আমার কথায় আবার কিছু মনে করলেন না তো?
জি আচ্ছা।
আবুল কালাম খানিকটা ঝুকে এসে গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে বললেন, টেলিফোনে রূপা ম্যাডামের গলার স্বরটা যে কী মিষ্টি আসে আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না ভাই সাহেব। অত্যধিক মিষ্টি।
তাই নাকি?
জি।
আমি অনেক বিচার বিবেচনা করে একটা জিনিস বের করেছি। ভাই সাহেব। সত্য মিথ্যা আল্লাহপাক জানেন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সত্য। বলব?
বলুন।
যার গলার স্বর টেলিফোনে সুন্দর আসে তার অন্তরটাও সুন্দর।
এটা আপনার থিওরি?
জি ভাই সাহেব। পরীক্ষা করেও দেখেছি ঘটনা সত্যি। রূপা ম্যাড়ামকে লাইন করে দিব?
টেলিফোন নাম্বার মুখস্থ?
কেউ যখন আমার সামনে অন্য কাউকে টেলিফোন করে তখন নাম্বারটা মুখস্থ হয়ে যায়। এই যে আপনি একটু আগে টেলিফোন করলেন নাম্বার মুখস্থ হয়ে গেছে। বলব?
বলার দরকার নেই বিশ্বাস করছি। আপনি কি এই নাম্বারে পরে টেলিফোন করবেন? আপনার কি এই অভ্যাস আছে?
আবুল কালাম লজ্জিত গলায় বললেন, হঠাৎ হঠাৎ করি। তবে কথা বলি না। হ্যালো বললে রেখে দেই।
ম্যানেজার টেলিফোনে রূপাকে ধরে দিল। রূপা শান্ত গলায় বলল, এত দিন পর হঠাৎ কী ব্যাপার?
কোন ব্যাপার না। গলার স্বর শোনার জন্যে টেলিফোন করলাম।
গলার স্বর তো শোনা হয়েছে। এখন কি টেলিফোন রেখে দেব?
না আরো কিছুক্ষণ শুনি।
কতক্ষণ?
মিনিমাম তিন মিনিট।
তিন মিনিট কেন?
গান তিন মিনিটেক্স মতো হয়। সেই জন্যেই তিন মিনিট।
ভালো। ঠিক আছে তিন মিনিট কথা শোন। এক নাগাড় তিন মিনিট কথা বলব? নাকি মাঝে মধ্যে তুমিও কিছু বলার?
রেগে আছ কেন রূপা?
রেগে নেই। শরীর ভালো না। নতুন কী একটা ভাইরাস এসেছে–সেই জ্বর। একটু আগে জ্বর দেখেছি— এক শ তিন পয়েন্ট ফাইভ। মনে হয় এখন আরেকটু বেড়েছে।
বল কী? টেলিফোন রেখে মাথায় পানি দাও।
তিন মিনিট তো এখনো শেষ হয় নি। তিন মিনিট শেষ হোক।
তিন মিনিটের শেষ এক মিনিট আবুল কালাম সাহেবের জন্যে আলাদা করে রাখ তো প্লিজ।
তার মানে?
আমাদের মেসের ম্যানেজারের শখ হল মানুষের গলার স্বর শোনা এবং সেই স্বর নিয়ে গবেষণা করা। তিনি তোমার গলার স্বরের ব্যাপারে আগ্ৰহী। তাকে টেলিফোন দেব?
দাও।
আমি কালাম সাহেবের দিকে টেলিফোন রিসিভার আগিয়ে দিলাম। তিনি অতি বিনয়ী গলায় বললেন, ম্যাডাম স্লামালিকুম…
অন্যের টেলিফোনের কথাবার্তা আড়িপেতে শোনা কোনো কাজের কথা না। আমি উঠে পড়লাম।
স্বপ্নের নদী
আমি বসে আছি নৌকার গলুইয়ে। পা ঝুলিয়ে বসেছি। নৌকা খুব দুলছে বলেই মাঝে মাঝে নদীর পানিতে পা ডুবে যাচ্ছে। শরীর সিরসির করছে। গায়ে কাঁপুনি লাগছে। নদীর পানি এত ঠাণ্ডা হবার কথা না—। এই নদীর পানি এত ঠাণ্ডা কেন? মনে হচ্ছে বরফ গলা পানি। ঘটনাটা কী? স্বপ্নের নদী না তো?
ঘুমের মধ্যেও চেতনার একটি অংশ জাগ্রত থাকে। সেই অংশ আমাকে বলল–তুমি স্বপ্ন দেখছি। এখন তোমার ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। ইচ্ছা করলে তুমি জেগে উঠতে পার আবার ইচ্ছা করলে হাত পা লম্বা করে ঘুমুতেও পার। কিংবা যদি চাও স্বপ্নটা আরো কিছুক্ষণ দেখবে তাও পার। স্বপ্নকে তোমার ইচ্ছার অধীন করে দেওয়া হল।
আমি বললাম—–স্বপ্নটাই দেখি। স্বপ্নটা কোনো ভয়ঙ্কর দিকে মোড় না। নিলেই হবে। যদি দেখি ঝড়ে নৌকা ডুবে গেছে। আমি পানিতে খাবি। খাচ্ছি তা হলে সর্বনাশ। কী ঘটবে বলতো?
স্বপ্নে কি ঘটবে তা তো বলতে পারছি না।
তা হলে স্বপ্নটা বাদ থাক। আমি বরং আরো কিছুক্ষণে ঘুমাই।
বেশ তো। মাথা থেকে স্বপ্ন দূর করে দাও।
আমি মাথা থেকে স্বপ্ন ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করলাম। স্বপ্নটা যাচ্ছে না। স্বপ্নে নৌকাটা অনেক বেশি দুলছে। আমি পা তুলে বসলাম। নদীর পানির ঠাণ্ডাটা অসহ্য লাগছে। পা তুলে বসার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন অন্যদিকে মোড় নিল। দেখা গেল বিশাল এক স্টিমার দ্রুত নদীর পানি কেটে আমাদের নৌকার দিকে আসছে। স্টিমারের মাথায় সার্চ লাইট। সেই সার্চ লাইটের আলো ফেলা হয়েছে আমার চোখে। চোখ জ্বালা করছে। নৌকার মাঝি ব্যাকুল হয়ে ডাকছে, হিমু ভাই, হিমু। স্টিমারের ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দে তাঁর গলা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
স্বপ্ন অতি দ্রুত খারাপ দিকে যাচ্ছে। আমার উঠে পড়া দরকার। আমি তাই করলাম। চোখ মেললাম। নৌকার মাঝি আমাকে ডাকছে না। ডাকছেন। জয়নাল সাহেব! নৌকার মাঝির মতোই ব্যাকুল গলায় হিমু ভাই, হিমু ভাই করছেন।
জয়নাল সাহেব বললেন, জানালা খোলা রেখে ঘুমিয়েছেন। অবস্থােটা দেখেছেন– বৃষ্টিতে তো গোসল করে ফেলেছেন। ওঠে গা মুছেন ঠাণ্ড লেগে যাবে। ফ্লাস্কে করে চা এনেছি–চা খান। মুখ ধুয়ে আসবেন না বাসি মুখে চা খবেন?