হ্যালো আশা?
জি।
আমি হিমু। কেমন আছ?
ভালো আছি। আপনি কি আজ আসবেন?
আজ আসতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি নামলেই চলে আসব।
বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করছেন এর মানে বুঝতে পারছি না। বৃষ্টির সঙ্গে আপনার আসার সম্পর্ক কী?
বাংলাদেশ বৃষ্টির দেশ। এই দেশ দেখতে হলে বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর দিয়ে দেখতে হবে। আমি ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষা করছি। তোমার কি রেইন কোট আছে?
না।
একটা রেইন কোট কিনে ফেলা। ঝুম বৃষ্টি নামলে ছাতায় কুলাবে না। এই সঙ্গে রাবারের গাম বুট।
এই কদিন আসেন নি কেন জানতে পারি?
অবশ্যই জানতে পার। সারারাত জাগতে হচ্ছে তো; রাতে জাগছি, দিনে ঘুমুচ্ছি।
ও।
কেন রাত জাগছি জানতে চাও?
না।
আমার তো ধারণা তোমার জানার খুব কৌতূহল হচ্ছে— ভদ্রতা করে বলছ— না। আমার সঙ্গে ভদ্রতা করার কোনো দরকার নেই।
আপনার সঙ্গে ভদ্রতা করার দরকার নেই কেন?
কারণ আমি কারোর সঙ্গে ভদ্রতা করি না।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে বলুন কেন রাত জাগছেন।
আমাদের মেসে এক ভদ্রলোক থাকেন তার নাম জয়নাল। তিনি রাতে ঘুমুতে পারেন না। এই বেচারাকে কিছু সময় দিচ্ছি। প্রায় রাতেই তাকে নিয়ে বের হচ্ছি। ঘুরছি। ভদ্রলোক খুবই আনন্দে আছেন।
মানুষকে আনন্দ দেবার মহান ব্ৰত কি আপনি মাথায় নিয়েছেন?
তা না। তবে কাউকে আনন্দ দিতে ভালো লাগে। সব মানুষ ওই চেষ্টা খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও করে। জগতের আনন্দ যজ্ঞে সবারই নিমন্ত্রণ থাকে।
কঠিন বাংলা আমি বুঝতে পারি না। বুঝিয়ে দিন।
টেলিফোনে না, যখন দেখা হবে তখন বুঝিয়ে দেব।
আমাকে বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে?
হ্যাঁ। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। পরশু সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হবে। ইংরেজিতে যাকে বলে Cats amd Dogs রাস্তায় এক হাঁটু পানি জমে যাবে। এমন বৃষ্টি হবে যে তোমার গাম বুটের ভেতরেও রাস্তায় জমে থাকা নোংরা পানি ঢুকে যাবে।
পরশু সকাল থেকে বৃষ্টি হবে। কী করে বুঝলেন?
আমার মন বলছে।
যা আপনার মন বলে তাই কি হয়?
না তা হয় না।
কিন্তু আপনি যেভাবে কথা বললেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত যে পরশু সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হবে। রাস্তায় পানি জমে যাবে। আমার গাম বুটে পানি ঢুকে যাবে।
আমি মোটেই নিশ্চিত না। এমি বললাম। তবু তুমি তৈরি থেকে। সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম রেখো৷
চা খেতে খেতে বৃষ্টি দেখবেন? আপনার পরিকল্পনাটা কি জানতে পারি?
পরিকল্পনা খুবই ইন্টারেস্টিং। পাইপের ভেতর বসে বৃষ্টি দেখব।
একটু পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলুন।
ঢাকা শহরের বেশ কিছু লোক পাইপের ভেতর বাস করে। পাইপ সংসার। সুয়ারেজ লাইনের জন্যে বিরাট বিরাট পাইপ আছে। তার কিছু খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে। ভাসমান মানুষরা তার ভেতর সংসার পাতে এবং অতি সুখে বাস করে। সে রকম একটা পাইপে বসে বৃষ্টি দেখব।
ও।
পাইপে বাস করে এমন একটা পরিবারের সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। ওরা আমার জন্যে একটা পাইপ আলাদা করে রেখে দিয়েছে। সেখানে আমার বিছানা বালিশ আছে। হাতপাখা আছে; গামছা আছে। এমনকি আয়না চিরুনি তো আছে।
মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকেন?
হ্যা।
টিয়লেটের ব্যবস্থা কী?
সেই ব্যবস্থাও আছে। খুবই ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা, তবে আছে। আশা শোন আমি যে মেসে থাকি সেই মেসের ম্যানেজার আবুল কালাম তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।
কেন?
এম্নি। তোমার গলার স্বরটা টেলিফোনে কেমন শোনায় সেটা জানবেন। ম্যানেজার সাহেবের এটা একটা শখ। মানুষের অনেক রকম শখ থাকে। কেউ ডাকটিকেট জমায়, কেউ টেলিফোনে গলার স্বর জমায়।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না Why?
আমি Why এর জবাব না দিয়ে টেলিফোন রিসিভার আবুল কালাম সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি গন্তীর গলায় বলছেন–হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো। ও পাশ থেকে মনে হয়। আশা টেলিফোন রেখে দিয়েছে! আবুল কালাম সাহেবের চোখে মুখে চরম হতাশা।
আমি বললাম, লাইন কেটে দিয়েছে?
আবুল কালাম তিক্ত গলায় বললেন– কাটে নাই। রেখে দিয়েছে।
আচ্ছা আরেক দিন গলার স্বর শুনিয়ে দেব। গলার স্বর খারাপ না। মিষ্টি কিশোরী মেয়েদের গলা।
কালাম সাহেব ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, কোনো দরকার নাই।
আজ আপনার মনটা খারাপ কেন? চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে?
কালাম সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। তার মানে হচ্ছে কিছুদিন পরপরই তার চাকরি নিয়ে সমস্যা হয়। মালিক নোটিস দিয়ে বেতন বন্ধ করে দেন। কালাম সাহেব তারপরেও নিয়মিত আসেন। ম্যানেজায়ের চেয়ারে না বসে সামনের চেয়ারে বসেন। তারপর একদিন হঠাৎ তার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা যায়। তিনি ফিরে যান। তাঁর নিজের চেয়ারে। তাঁর পুরোনো গাভীর্য ফিরে আসে। গলার স্বরও তখন অন্য রকম হয়ে যায়।
হিমু সাহেব।
জি।
বৃষ্টি হবার কথা যেটা বললেন এটা কি ঠিক? সত্যি হবে?
কথার কথা বলেছি। আমি তো আর আবহাওয়া অফিসের লোক না।
খুব জোর দিয়ে বলেছে তো এই জন্যে বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। অনেকের অনেক পাওয়ার থাকে। আমার নিজেরো ছিল।
বলেন কী?
এখন নাই। ছোট বেলায় ছিল। ছয় সাত বছর বয়সের সময় ছিল। তখন যা বলতাম। তাই হত।
আশ্চর্য তো!
ধরেন খেলাধুলা করছি— হঠাৎ বললাম, আজ বাড়িতে মেহমান আসবে। ঠিকই আসত। একবারের কথা স্পষ্ট মনে আছে। গোল্লাছুটি খেলছি–হামিদ বলে আমার এক বন্ধু ছিল। সেও খেলছে। হঠাৎ আছাড় খেয়ে হামিদ আমার সামনে পড়ে গেল। তখন তাকে বললাম, আজ রাত তুই হেভি পিটুনি খাবি। পিটিয়ে তোর হাড়িড় ভেঙে দেবে। হামিদ বিশ্বাস করে নি? বাপ মায়ের এক ছেলে আদরে থাকতো।