- বইয়ের নামঃ তোমাদের এই নগরে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, দর্শন
রাতে দরজা জানালা খোলা
রাতে দরজা জানালা খোলা রেখে ঘুমানোর কিছু উপকার আছে। ঘরে বাতাস খেলে, নিজেকে প্রকৃতির অংশ বলে মনে হয়, খাঁচার ভেতর ঘুমুচ্ছি এরকম মনে হয় না। খোলা দরজা দিয়ে চোর ঢুকবে এবং ঘরের জিনিসপত্র সাফ করে দেবে তাও কিন্তু না। চোরদের গাইড-বুক বলে, তালাবন্ধ ঘরে তালা ভেঙে ঢুকবে। কিন্তু দরজা জানালা সবই খোলা এমন ঘরে কখনো ঢুকবে না–সমস্যা আছে। কেউ খামাখা দরজা খোলা রাখে না। নিশ্চয়ই কোথাও কিন্তু আছে। চোরেরা কিন্তু ভয় পায়।
চোরদের সাইকোলজির উপর ভরসা করেই আমি দিনের পর দিন দরজা জানালা খোলা রেখে ঘুমাই কখনোই কোনো সমস্যা হয় নি। কিন্তু কোনো একটা ব্যাপার কয়েকদিন হল ঘটেছে–প্রায় রাতেই ঘরে চোর আসছে বলেই আমার ধারণা। চোর ধরতে পারছি না। অনেকের থাকে পাতলা ঘুম। খুটখাট শব্দ হলেই এরা লাফ দিয়ে উঠে বসে। গলায় মাইক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে-কে কে কে কে? আমার উলটো ব্যাপার। খুটখাট শব্দে আমার ঘুম গাঢ় হয়। তখন আর চোখ মেলতে পারি না।
প্রতি রাতেই ঘুমুবার সময় ভাবি— আজ চোর ধরতে হবে। যেভাবেই হোক ব্যাটাকে বেঁধে মেসের ম্যানেজারের হাতে তুলে দিতে হবে। সে চায়টা কী? কী আছে আমার ঘরে যে রোজ রাতে আসতে হবে।
পরিকল্পনা পর্যন্তই, পরিকল্পনা আর কাজে খাটে না। শেষে ঠিক করলাম— দূর ছাই চোর ঘুরুক চোরের মতো। আমি ঘুমাই আমার মতো। সে আমার ঘর থেকে নেবেটা কী? তোষকের নিচে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা পাঁচ শ টাকার নোটের তোড়া নেই। আখরোট কাঠের বাক্সে হীরার নেকলেশ নেই। টেবিলের নি উপর সস্তার একটা টাইমপিস আছে এটা নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যাক। খামাখা চোরের বিষয়ে টেনশন করে ঘুম নষ্ট করে লাভ কী? দিলাম লেজ পেতে। লেজে পা দিয়ে চোর আসলে আসুক।
তখনি চোর ধরা পড়ল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি চোর চেয়ারে বসা। ঘরে চাঁদের আলো। চারপাশ মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি— চোরের পরনে চেক ও লুঙি, গায়ে স্যান্ডে গেঞ্জি। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না— সে বসে আছে আমার দিকে পিঠ দিয়ে। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। দ্রুত পা নাচাচ্ছে বলে স্যান্ডেলে থপথপ শব্দ হচ্ছে। শব্দের মধ্যেও ছন্দ আছে।
থপথপ থপ থপথপ
থপথপ থপ থপথপ
স্যান্ডেল সংগীত আমি মোটামুটি মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়েই শুনছি। স্যান্ডেলের থপথপ শব্দ থেমে গেল। চোর এবার টেবিলের ড্রয়ার ধরে টানাটানি করতে লাগল। এই ড্রয়ারটা শক্ত। চট করে খোলা মুশকিল! তবে খুললেও সমস্যা কিছু নেই। ড্রয়ার ফাঁকা থাকার কথা। কিছু চিঠি পত্র, একটা চাবির রিং, দেয়াশলাই এবং মোমবাতি। এর বেশি কিছু থাকার কথা না।
বেশ শব্দ করে ড্রয়ার খুলল। এই শব্দে আমার ঘুম ভাঙল কি না চোর চট াৈ করে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেও নিল। এখন সে আগ্রহ নিয়ে ড্রয়ার ণে হাতড়ে দেখছে। এখন তার হাতে চাবির রিং। ঝনঝনি করে রিং বাজাচ্ছে। মনে শ্ৰী হল রিং বাজিয়ে বেশ মজা পাচ্ছে। এর মধ্যেও একটা ছন্দ আছে—রিনরিন রিন ঝিন রিনরিন রিন ঝিন। এবার সে উঠে দাঁড়াল। চাবির রিংটা এখনো তার হাতে আছে। চাবি দিয়ে ট্রাংক বা সুটকেসের কোন তালা খুলবে। এরকম কোনো মতলব কি করছে? করলে ভুল করবে। আমার ঘরে সুটকেস, ট্রাংক কিছুই নেই। নে রিং ভরতি চাবিই শুধু আছে। খোলার মতো তালা নেই। চোরটা আমার খাটের কাছে উবু হয়ে বসল। হাত বাড়িয়ে খাটের নিচ থেকে কী যেন নিল। আবার গিয়ে চেয়ারে বসল। চোরের হাতে এখন বিস্কুটের টিন। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম থেকে আমার আলসার হয়েছে এরকম সন্দেহে রূপা এই বিস্কুটের টিন আমাকে দিয়েছে। এক-দুই ঘণ্টা পরে পরে যেন বিস্কুট খেয়ে এক গ্লাস পানি খাই। আমি যে কাজটা এখনো করতে পারি নি— চোর তা বেশ আয়েশ করেই করছে দেখা গেল। সে জগ থেকে গ্লাসে পানিও ঢেলেছে। বিস্কুট খেয়ে পানি খাওয়া হবে তারপর নিশ্চয়ই আরাম করে সিগারেট ধরানো হবে। সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই আছে আমার বালিশের নিচে। এই ঘরের সব কিছুই এই চোরের জানা। কাজেই সে যে সিগারেটের জন্যে বালিশের নিচে হাত দেবে এটা প্ৰায় নিশ্চিত। চোরকে এই কাজটা করতে দেব, না তার আগেই উঠে বসব বুঝতে পারছি না। হ্যালো ব্ৰাদার কেমন আছেন? এই প্রশ্ন করা যেতে পারে। আচমকা এই প্রশ্ন শুনে চোর হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে পেটে ছোরা বসিয়ে দেবে না তো? চোরের সঙ্গে ছোটখাটো অস্ত্র রাখে বলে শুনেছি—ছোরা, ব্লেড, ক্ষুর। Small range weapons.
কুড়মুড় কুড়মুড় শব্দ হচ্ছে। চোর বিস্কুট খাচ্ছে। আমি উঠে বসলাম। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে গলার স্বর যতটা স্বাভাবিক রাখা যায় ততটা স্বাভাবিক রেখে বললাম, কেমন আছেন?
কুড়মুড় শব্দে বিস্কুট খাওয়া বন্ধ হল। চোর পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঠোঁট মুছে আমার চেয়েও স্বাভাবিক গলায় বলল, জি ভালো।
কী করছেন?
বিসকিট খাচ্ছি।
পরিচয় জানতে পারি?
দুই শ আঠারো নম্বরের বোর্ডার। আমার নাম জয়নাল। ঘরে আলো কম তো। এই জন্যে চিন্তে পারছেন না। মতিঝিল ব্রাঞ্চের কৃষি ব্যাংকে কাজ করি। কেশিয়ার। লাইট জ্বালালেই চিনবেন।