কায়সার একটি দলে ভিড়ে যায়। মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিকরা কাঁধে ঝোলা বা ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। এদের মধ্যে লুৎফরকে দেখেও সুরঞ্জন ডাকে না। ও একসময় নিজেই এগিয়ে আসে। চোখ কপালে তুলে বলে-দাদা, আপনি এখানে কেন?
—কেন থাকতে নেই?
লুৎফরের চোখে মুখে চরম উৎকণ্ঠা। জিজ্ঞেস করে–বাড়িতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
লুৎফরের কথায় এবং বলবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অভিভাবকত্ব আছে। সুরঞ্জন টের পায়। এই ছেলেটি মুখচোরা স্বভাবের ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও কথা বলেনি এমনই বিনত, লাজুক, ভদ্র। ছেলেটিকে সুরঞ্জনই ‘একতা’ পত্রিকার সম্পাদককে বলে-কয়ে চাকরি নিয়ে দিয়েছিল। লুৎফর একটি বেনসন ধরায়। সুরঞ্জনের খুব কাছে সরে এসে বলে—সুরঞ্জনদা, অসুবিধে হয়েছে কোনও?
সুরঞ্জন হেসে জিজ্ঞেস করে–কি অসুবিধে?
লুৎফর একটু অপ্রস্তুত হয়। বলে—কী আর বলব দাদা। দেশের যা অবস্থা…
সুরঞ্জন তার সিগারেটটির ফিল্টারটুকু নীচে ফেলে পায়ে পিষতে থাকে। লুৎফর তার সঙ্গে সব সময় নীচু কণ্ঠে কথা বলত, আজি কণ্ঠটা তার উঁচুই মনে হয়। ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে, কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, বলে—দাদা, আজ বরং আপনি অন্য কোথাও থাকুন। বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। আচ্ছা আশেপাশের কোনও মুসলমানের বাড়িতে অন্তত দুটো রাতে থাকার ব্যবস্থা করা যায় না?
সুরঞ্জনের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে দোকানের আগুনমুখে দড়িটির দিকে তাকিয়ে বলে—না।
—না? লুৎফর চিন্তিত হয়। ওর ভাববার ভঙ্গিতেও অভিভাবকত্ব টের পায় সুরঞ্জন। সে বুঝে যায়, যে কেউই এখন এ ধরনের অভিভাবকত্ব দেখাবে। না চাইতেই আগ বাড়িয়ে উপদেশ দেবে। বাড়িতে থাকা ঠিক নয়, লুকিয়ে থাকে। ক’দিন বাড়ি থেকে বেরিও না। নাম পরিচয় বলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে না হয় বেরোও, এসব। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে আরও একটি সিগারেট ধরাতে। কিন্তু লুৎফরের গুরুগম্ভীর উপদেশ তার ইচ্ছেটিকে নষ্ট করে দেয়। শীত নেমেছে বেশ। সে হাতদুটো ভাঁজ করে -বুকের ওপর রেখে গাছের পাতার সবুজ-গাঢ় সবুজ রং দেখে। শীতকালটা সে সব সময়ই বেশ উপভোগ করে। সকালে গরম ভাপাপিঠে, রাতে গায়ের ওপর রোদে দেওয়া লেপ, মায়ের মুখে ভূতের গল্প-ভাবতেই এক ধরনের রোমাঞ্চ হয় সুরঞ্জনের। লুৎফরের সামনে –দাঁড়িয়ে একটি ঝোলা কাঁধের দাড়িঅলা যুবক নাগাড়ে বলে যায়-ঢাকেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, মহাপ্রকাশ মঠ, নারিন্দা গৌড়ীয় মঠ, ভোলাগিরি আশ্রমে মিছিল করে গিয়ে লোকেরা ইট মারছে, লুট করছে। স্বামীবাগ আশ্রম লুট হয়েছে। শনির আখড়ার পচিশটি বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। শনির মন্দির, দুর্গ মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নারিন্দার ঋষিপাড়া আর দয়াগঞ্জের জেলেপাড়াও রক্ষা পায়নি। ফার্মগেট, পল্টন ও নবাবপুরে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান, টিকাটুলির দেশবন্ধু মিষ্টির দোকান লুট করেছে, ভেঙেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঠাঁটারি বাজারের মন্দিরে আগুন লাগিয়েছে।
লুৎফর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—আহা।
সুরঞ্জন লুৎফরের দীর্ঘশ্বাসটি কান পেতে শোনে। সে ভেবে পায় না সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, মিছিলে যোগ দেবে, নাকি দূরে কোথাও চলে যাবে। আত্মীয়হীন বন্ধুহীন কোনও ঝাড় জঙ্গলে একা বসে থাকবে। ঝোলা কাঁধের যুবকটি সরে গিয়ে অন্য আডায় মিশে যায়। লুৎফরও চলে যাবার পাঁয়তারা করে। কারণ সুরঞ্জনের ভাবলেশহীন মুখ আতাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটে।
চাপা উত্তেজনা চারদিকে। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে দলের সঙ্গে মিশে যেতে। তার ইচ্ছে করে কোথায় কোথায় মন্দির ভাঙল, পুড়ল, কোথায় ঘরবাড়ি দোকান লুট হল এসব খবরে সেও অংশ নিক। সেও স্বতঃস্ফূর্ত বলুক—‘এই ধর্মবাদীদের চাবকে সোজা করা দরকার। <এই মুখোশধারী ধার্মিকেরা আসলে সবচেয়ে বড় প্রতারক।’ কিন্তু পারছে কই। তার —দিকে আড়াচোখে যারাই তাকাচ্ছে সকলের চোখ থেকেই করুণা ঝরছে, যেন তার এখানে শুথিাকা নিরাপদ নয়, যেন সে ঠিক এখানে দাঁড়াবার, ওদের মত উত্তেজিত হবার, ওদের সঙ্গে -মিছিল করবার যোগ্য লোক নয়। সে এতদিন ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে —মঞ্চে বা আড্ডায় তুখােড় তুখোড় কথা বলেছে, অথচ আজ তাকে একটি অদৃশ্য শক্তি বোবা করে রাখছে। কেউ বলছেও না, সুরঞ্জন কিছু বল, কিছু কর, রুখে দাঁড়াও।
কায়সার জটলা ভেঙে সামনে আসে। ফিসফিস করে বলে, ‘বায়তুল মোকাররমে বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে মিটিং হবে, লোক জমছে, তুমি বাড়ি চলে যাও।‘
—তুমি যাবে না? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।
কায়সার বলে—আরে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল করতে হবে না!
কায়সারের পেছন লিটন আর মাহতাব বলে দুজন ছেলে ছিল। ওরাও বলে—আসলে আপনার ভালর জন্যই বলছি। শুনেছি জলখাবারও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশেই ঘটছে ঘটনাগুলো। আপনাকে চিনতে পারলে কী হবে বলুন তো। ওরা হাতে ছুরি, লাঠি, রামদা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে।
কায়সার একটি রিক্সা ডাকে। রিক্সায় সুরঞ্জনকে তুলে দেবে সে। লুৎফর এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টান দেয়, বলে–আসুন তো দাদা। সোজা বাড়ি যান। এ সময় কেন যে বাইরে বেরোলেন আপনি।