—আমার কি বেরোতে মানা? সুরঞ্জন পাল্টা প্রশ্ন করে।
—মানা নেই। তবু জানোয়ারগুলোকে তো বিশ্বাস নেই। এরা যে এত ধর্ম ধর্ম করে, আসলে কি কোনও ধর্ম মানে, বল?? জামাত শিবির যুব কমান্ডের সন্ত্রাসীরা গতকাল দুপুরে এসব করেছে। পার্টি অফিস, ফুটপাতের বইয়ের দোকান, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো তাকে তক্কে থাকে কোথাও একটা ইস্যু তাদের ফেভারে নিয়ে চিৎকার করতে। যেন তাদের উঁচু গলাটা সবাই শোনে।
পাশাপাশি তোপখানার দিকে হাঁটতে থাকে দুজন। সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে—আর কোথায় কোথায় আগুন ধারালো ওরা?
–চট্টগ্রামের তুলসীধাম, পঞ্চাননধাম, কৈবল্যধাম মন্দির ভেঙে গুড়ো করে দিয়েছে। মালিপাড়ী, শ্মশান মন্দির, কোরবানিগঞ্জ, কালীবাড়ি, চট্টেশ্বরী, বিষ্ণুমন্দির, হাজারিলেন, ফকিরগািড়া এলাকার সব মন্দির লুটপাট করে আগুন জেলে দিয়েছে। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিলও বেরিয়েছে।
সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কায়সার ডান হাতে এলেচুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে—কাল শুধু মন্দির নয় মাঝিরঘাট জেলেপাড়ায় আগুন জ্বেলে দিয়েছে। অন্তত পঞ্চাশটি ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
—আর? সুরঞ্জন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
—জয়দেবপুরের মাধব মন্দির আর দুর্গ মন্দিরে হামলা হয়েছে। শেরপুরের কৃষি সেন্টারে অন্নপূর্ণ মন্দির, শেরিঘাট আশ্রমের কালী মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে। ফরিদপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরগুলো লুট হয়েছে। মহারাজা আর তার ছাত্ররা সিরিয়াসলি ইনজিউরড।
—আর? সুরঞ্জনের উদাসীন স্বর।
-নরসিংদিতে চালাকচড় আর মনোহরাদির বাড়ি আর মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ থানার মর্যাপাড়া বাজারের মন্দির ধ্বংস করেছে। কুমিল্লার পুরনো অভয় আশ্রমটি জ্বলিয়ে দিয়েছে। আর নোয়াখালিতেও জঘন্য সব কাণ্ড করেছে।
—কি রকম?
—সুধারাম থানার অধর চাঁদ আশ্রম আর সাতটা হিন্দুর বাড়ি জ্বলিয়ে দিয়েছে। গঙ্গাপুর গ্রামে যত হিন্দু বাড়ি ছিল, প্রথম লুট করেছে, পরে পুড়িয়ে দিয়েছে। সোনাপুরের শিব-কালী মন্দির আর বিনোদপুর আখড়া ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনির কালীমন্দির, দুৰ্গাপুরের দুৰ্গর্বিাড়ি মন্দির, কুতুবপুর আর গোপালপুরের মন্দির ভেঙেছে। ডাঃ পি কে সিংহের ওষুধের ফ্যাক্টরি, আখন্দ আশ্রম, ছয়আনি এলাকার মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনি বাবুপুর, তেতুইয়া, মেহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গিরপাড়, কাজিরহাট, রসুলপুর, জমিদারহাট, পোতাবাড়ির দশটি মন্দির আর আঠারোটি হিন্দু বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। একটি দোকান, একটি গাড়ি, একটি মহিলাও পুড়েছে। ভাবর্দির সতেরোটি বাড়ির মধ্যে তেরোটি বাড়িই পুড়ে গেছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়ির মেয়েরা নিৰ্য্যতিত হয়েছে। বিপ্লব ভৌমিক স্টেবডি। গতকাল বিরাহিমপুরের সবকটি বাড়ি এবং মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দির, চরহাজারি গ্রামের তিনটি দোকান, ক্লাব লুট করেছে, ভেঙেছে। চরপার্বতী গ্রামের দুটো বাড়ি, দাসের হাটের একটি বাড়ি, চরকুকরি আর মুছাপুরের দুটো মন্দির, জয়কালী মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। পিরোজপুরের প্রতিটি মানুষ মার খেয়েছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়িগুলো শেষে পোড়ানোও হয়েছে।
–ও।
সুরঞ্জন আর কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে চায় না। ছোটবেলার মত রাস্তার যে কোনও ইট বা পাথরের টুকরো পায়ে ছুড়ে ছুড়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। কায়সার আরও কী কী সব বলে, আরও মন্দির পোড়ানো, আরও বাড়িঘর লুটপাট, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। সুরঞ্জন সব শোনেও না। তার শুনতে ইচ্ছেও করে না। প্রেস ক্লাবের সামনে দুজনই দাঁড়ায়। সাংবাদিকদের জটলা, গুঞ্জন দু চোখ ভরে দেখে সে। শোনেও কিছু। কেউ বলছে-ভারতে এ পর্যন্ত দুশর ওপর লোক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। আর এস এস, শিবসেনাসহ মৌলবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ, লোকসভায় বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানি পদত্যাগ করেছে। কেউ বলছে-চট্টগ্রামে, নন্দনকানন তুলসীধামের এক সেবক দীপক ঘোষ পালিয়ে যাবার সময় জামাতিরা তাকে ধরে জ্বলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। পাশে কয়েকজন দারোয়ান ছিল, ওরা দীপককে মুসলমান পরিচয় দিলে জামাতিরা দীপককে মারধোর করে ছেড়ে দেয়।
সুরঞ্জনকে পরিচিত যারাই দেখে চমকে ওঠে। বলে—কী ব্যাপার তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে! বিপদ হতে পারে। বাড়ি চলে যাও।
সুরঞ্জন কোনও উত্তর করে না। বড় অপ্রতিভা লাগে নিজেকে। তার নাম সুরঞ্জন দত্ত বলে তাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হবে। আর কায়সার, লতিফ, বেলাল, শাহীন এরা বাইরে বেরোবে, কোথায় কী হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মিছিলও করবে। কিন্তু সুরঞ্জনকে বলবে বাড়ি চলে যাও, এ কেমন কথা? সুরঞ্জন কি ওদের মতই বিবেকবান, মুক্তবুদ্ধির, যুক্তিবাদী মনের মানুষ নয়? দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে উদাসীন, সিগারেটের দোকান থেকে এক কাঠি বাংলা ফাইভ কেনে, আগুনমুখো দড়ি থেকে সিগারেট ধরায়। নিজেকে বড় বিচ্ছিন্ন বোধ করে সুরঞ্জন। এত লোক চারদিকে, অনেকেই চেনা, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠও, তবু এক লাগে তাঁর। যেন এই যে এত মানুষ হাঁটছে, কথা বলছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা আর সেইসূত্রে এ দেশের মন্দির ভাঙা নিয়ে উত্তপ্ত কথাবাত চলছে, এসব সুরঞ্জনের বিষয় নয়। সে মিশে যেতে চাইলেও পারছে না। কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করছে সে। সুরঞ্জন বুঝতে পারছে তাকে সকলেই আড়াল করছে, করুণা করছে, তাকে দলে টানছে না। সুরঞ্জন গাল ভরে ধোঁয়া নিয়ে ধোঁয়ার রিং ছুড়ে দেয়। চারদিকে উত্তেজনা আর সে তার অলস শরীরের ভার দেওয়ালে ছেড়ে দেয়। অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সুরঞ্জনকে। বিস্মিত হয়। কারণ একটি ‘হিন্দু ও আজ ঘরের বার হয়নি। ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়েছে সব। আর সুরঞ্জনের সাহস বা স্পধর্ম দেখে লোকে অবাক হবেই বা না কেন!