কিরণময়ীর কান্না ধীরে ধীরে থেমে আসে। গোঙাতে থাকেন। তিনি, গোঙাতে গোঙাতে মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে। সুধাময়ের কপালে বিষম বিরক্তির ভাঁজ, বলেন–ইন্ডিয়া তোর বাবার বাড়ি না ঠাকুদদার বাড়ি? তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কার বাড়ি ইন্ডিয়া যে ইন্ডিয়া যাবি? নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে চাস, লজ্জা করে না?
–দেশ ধুয়ে জল খাব বাবা? দেশ তোমাকে কি দিচ্ছে? কি দিচ্ছে আমাকে? মায়াকে কি দিয়েছে তোমার এই দেশ? মা’কে কেন কাঁদতে হয়? তোমাকে কোন রাতে রাতে গোঙাতে হয়? আমার কেন ঘুম আসে না?
–দাঙ্গা তো সব দেশেই হয়। ইন্ডিয়ায় হচ্ছে না? ওখানে মরছে না মানুষ? কত লোক মরছে খবর রাখিস?
–দাঙ্গ তো ভাল জিনিস বাবা, এখানে দাঙ্গা হচ্ছে না, এখানে মুসলমানরা হিন্দুদের মারছে।
—নিজেকে হিন্দু ভাবছিস তুই? সুধাময় উত্তেজিত হয়ে বিছানা থেকে উঠতে চান। তাঁকে দু হাতে থামিয়ে সুরঞ্জন বলে—যত নাস্তিকই হই আমরা যত মানবতাবাদীই হই লোকে আমাদের হিন্দুই বলবে। মালাউনই বলবে। এই দেশকে যত ভালবাসাব, যত আপন ভাবব, এই দেশ আমাদের তত দুরে সরাবে। মানুষকে যত ভালবাসাব, মানুষ তত একঘরে করবে আমাদের। এদের বিশ্বাস নেই বাবা। তুমি তো কত মুসলমান পরিবারকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা কর। এই দুর্যোগের দিনে তারা ক’জন তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? আমাদের সবাইকে মায়ার মত লোহার পুলের নীচে মরে পড়ে থাকতে হবে। বাবা, চল চলে যাই। সুরঞ্জন ঝুঁকে পড়ে সুধাময়ের ওপর।
–মায়া ফিরে আসবে।
—মায়া ফিরবে না বাবা। মায়া ফিরিবে না। সুরঞ্জনের কণ্ঠ থেকে এক থোকা কষ্ট উঠে আসে।
সুধাময় শুয়ে পড়েন। শিথিল হয়ে পড়ে শরীর তাঁর। বিড়বিড় করে বলেন–মায়াকেই যদি রক্ষা করা গেল না, কাকে রক্ষা করতে যাব?
— নিজেদের। যেটুকু হারিয়েছি, সেটুকুর জন্য শোক করার জন্য এখানে বসে থাকব? এই ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে? তার চেয়ে চল চলে যাই।
—ওখানে কি করব?
–ওখানে যা হোক কিছু করব। এখানেই বা কি করছি? আমরা কি খুব ভাল আছি? খুব সুখে?
—শেকড়হীন জীবন।
—শেকড় দিয়ে কি করবে বাবা? শেকড় দিয়ে যদি কিছু হোতই তবে ঘরের দরজা জানোলা বন্ধ করে বসে থাকতে হয় কেন? সারা জীবন এমন কুনো ব্যাঙের জীবন কাটাতে হবে। এরা কথায় কথায় আমাদের বাড়িঘরে হামলা করার, আমাদের জবাই করার অভ্যোস রপ্ত করে ফেলেছে। এরকম ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে আমার লজ্জা হয় বাবা। বড় রাগ হয়। আমি কিছু করতে পারি না। রাগ হলে আমি কি ওদের দুটো বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে পারব? আমরা কি এমন বোকার মত তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের সর্বনাশই দেখব? কথা বলার, কোনও মুসলমান আমার গালে এক চড় দিলে তাকে উল্টে চড় দেবার অধিকার কি আমার আছে? চল চলে যাই।
—-এখন তো শাস্ত হয়ে আসছে পরিস্থিতি। এত ভাবছিস কেন? আবেগে ভর করে জীবন চলে না।
–শান্ত হয়ে আসছে? সব ওপরে ওপরে। ভেতরে হিংস্ৰতা আছেই। ভেতরে ভয়ঙ্কর দাঁত নখ বের করে ওরা ফাঁদ পেতে আছে। তুমি ধুতি ছেড়ে আজ পাজামা পর কেন? কেন তোমার ধুতি পরবার স্বাধীনতা নেই? চল চলে যাই।
সুধাময় দাঁতে দাঁত পেষেন রাগে, বলেন–না। আমি যাব না। তোর ইচ্ছে হয় তুই চলে যা।
—যাবে না তুমি?
–না। ঘৃণায়, বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেন সুধাময়।
—আবারও বলছি বাবা, চল ঘাই চল। সুরঞ্জন বাবার কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলে। স্বরে তার কষ্ট থাকে, কান্না থাকে।
সুখময় কষ্ঠে আগের সেই দৃঢ়তা নিয়েই বলেন—না।
এই না’ শব্দটি সুরঞ্জনের পিঠে ইস্পাতের চাবুকের মত পড়ে। ‘
সুরঞ্জন ব্যর্থ হয়। সে জানত সে ব্যর্থ হবে। সুধাময়ের মত কঠিন চরিত্রের মানুষটি লাথিঝাঁটা খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। মাটির সাপ বিছুরা তাঁকে কামড়াবে, তবু তিনি মাটিতেই কামড় দেবেন, মাটিতেই মুখ থুবড়ে পড়বেন।
কিরণময়ীর কান্না থেমেছে। তিনি ঝুঁকে আছেন একটি রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। এর আগে সুরঞ্জন একটি গণেশের মূর্তি দেখেছিল। ঘরে, সম্ভবত মুসলমানেরা ওটি ভেঙে ফেলেছে। গোপনে কোথাও হয়ত কিরুণাময়ী লুকিয়ে রেখেছিলেন রাধাকৃষ্ণের এই ছবিটি, এটিকে সামনে নিয়ে তিনি ঝুঁকে আছেন, ভগবান কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করছেন নিরাপত্তার, নির্ভাবনার, নিশ্চয়তার, নিরুপদ্রব জীবনের।
নিরাশার উজান-জলে সুরঞ্জন একা একা সাঁতরায়। রাত হয়। রাত গভীর হয়। বড় একা লাগে তার। কেউ নেই, কেউ সহায় নয় তার। নিজ দেশে নিজেকে পরবাসী বলে মনে হয়। নিজের যুক্তি-বুদ্ধি বিবেকসহ সে গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর। তার উদারতা, সহিষ্ণুতা, যুক্তিবাদী মন হরতাল কারফিউ আর সন্ত্রাসের দেশে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসে, ভয়ংকর এক একাকীত্ব তাকে নিঃশেষ করে আনে, সে তার দরজা জানালা বন্ধ করা ঘরে নিঃশ্বাস নেবার অমল হওয়া পায় না। যেন ভয়াবহ কোনও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এখন আর মায়ার জন্য নয়, নিজের ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে সবার হৃদয়। তারা একা হয়ে যাচ্ছে, চেনা লোকেরা, মুসলমান বন্ধু বা পড়শি দেখতে আসছে কিন্তু কেউ বলতে পারছে না—আমাদের যেমন নিশ্চয়তা আছে জীবনের, তোমাদেরও আছে। তোমরা কুষ্ঠিত হয়ো না। কুঁকড়ে থেকে না। তোমরা নিৰ্ভয়ে হাঁটো, নির্বিঘ্নে কাজ কর, প্রাণখুলে হাসো, নিশ্চিন্তে ঘুমাও।