সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় রত্না হঠাৎ এক বিষয় বিকেলে তার বাড়িতে উঠবে এসে বলবে–কেমন জানি খালি খালি লাগে সুরঞ্জন ৷ ‘ সুরঞ্জনকে কতদিন চুমু খায় না কেউ। পারভিন খেত। পারভিন তাকে জড়ীয়ে ধরে বলত, ‘তুমি আমার, আমার, আমার ছাড়া আর কারও না, তোমাকে আজ একশ চুমু খাব।‘ ঘরে হঠাৎ কিরণময়ী ঢুকে পড়লে ওরা বিযুক্ত হত। মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে হলে বুট-ঝামেলা নেই, সেরকম জীবনই সে বেছে নিয়েছিল। রত্নার তো আর ‘জাত’-এর প্রবলেম নেই। ওর কাছেই সমৰ্পণ করবে। এই পোড়খাওয়া জীবন। সুরঞ্জন যখন এরকম ভাবছে, আজ রাতে সে যাবে, শরীরে যত বুল কালি জমেছে। সব ধুয়ে, ধোয়া একটি শার্ট গায়ে দিয়ে সে রত্নার বাড়িতে যাবে–তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলে দেখে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। বেশ সেজেছে। ঝকমকে শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি, রিন রিন করে বাজলও বোধহয়। রত্না মিষ্টি করে হাসছে, ওর হাসি সুরঞ্জনকে বিস্মিত ও অভিভূত করে। ‘আসুন ভেতরে আসুন’ বলতে বলতেই সে লক্ষ করে সুদৰ্শন এক ভদ্রলোক রত্নার পেছনে দাঁড়ানো।
রত্নাকে সে বসাবে কোথায়। যে বিচ্ছিরি অবস্থা ঘরের। তবু ‘বসুন বসুন’ বলে ভাঙা চেয়ারটি এগিয়ে দেয়। রত্না হেসে বলে—বলুন তো কাকে নিয়ে এসেছি?
রত্নার দাদাকে দেখেনি সুরঞ্জন। ভাবে সে-ই কি না। সুরঞ্জনকে বেশি ভাবতে দেয় না। রত্না, তার হাতের চুড়ির মত রিন রিন হেসে বলে—ওর নাম হুমায়ুন, আমার বর।
বুকের মধ্যে মুহুর্তে এক ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়, ঝড়ে তার যে শেষ বৃক্ষটি ছিল আকড়ে ধরবার, সেটিও শেকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ে। জীবনের অনেকটা বছর হেলায় হারিয়ে বড় ইচ্ছে ছিল বাকি জীবন রত্নাকে নিয়ে একটি ছোটখাট সংসার করবে। আর রত্না কিনা মুসলমান স্বামী নিয়ে এই সন্ত্রাসের দেশে বেঁচে থাকবার বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে! সুরঞ্জন অপমানে ক্ৰোধে নীল হয়ে ওঠে। সে এখন তার এলোমেলো দরিদ্র ঘরটিতে রত্না আর তার সুদৰ্শন সম্ভবত বিত্তবানও, স্বামীকে বসিয়ে ভালমানুষের মত ভাল ভাল কথা বলবে, তার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করবে, চা খেতে দেবে, যাবার সময় হেসে বলবে ‘আবার আসবেন’! না, সুরঞ্জন এসব কিছুই করবে না। এসব ভদ্রতা তার করতে ইচ্ছে করছে না। সে হঠাৎ ঘরের অতিথি দুজনকে অবাক করে দিয়ে বলে—’আমি খুব জরুরি কাজে বাইরে বেরোচ্ছি, আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার নেই।‘ ওরা এত অপমানিত হয় যে ‘দুঃখিত বলে দ্রুত বেরিয়ে যায়। সুরঞ্জন দরজার পাল্লাদুটো শব্দ করে লাগায়, লাগিয়ে পিঠ ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তার সম্বিত ফেরে কিরণময়ী ঘরে ঢুকে যখন বলেন–যে টাকা কটা ধার করেছিলি, ফিরিয়ে দিয়েছিস তো? ‘ধার’ শব্দটি বিষমখা তীরের মত বেঁধে সুরঞ্জনের বুকে। সে কিরণময়ীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকায় শুধু, কিছু বলে না।
রঞ্জনের বড় দমবন্ধ লাগে। ঘরটি যেন একটি লোহার বাক্স, খুলে সে বেরোতে পারছে না। বরান্দায় হাঁটে কিছুক্ষণ, তবু তার ওপর শ্রাবণের বৃষ্টির মত কেঁপে নামে এক আী শ দুঃখ। কিরণময়ী নিঃশব্দে এক কাপ চা রেখে যান টেবিলে। সুরঞ্জন দেখে, কিন্তু চাত্রে দিকে হাত বাড়ায় না। খানিকক্ষণ শোয়, আবার ওঠে, সে কি একবার লোহার পুল যাব? লোহার পুলের কথা ভাবতে গেলেই বুক কেঁপে ওঠে, মনে হয় তারও লাশ বুঝি গলে পচে পড়ে থাকবে নীচের নর্দমায়। বাড়িটি একটি স্থবির ডোবার মত নিস্তব্ধ। জহির ওপর জলপোকা যেমন নিঃশব্দে চলে, নিস্তব্ধতার মধ্যে বাড়ির তিনটি প্রাণী তেমন জলপাকার মত হাঁটে, কেউ কারও পায়ের শব্দ শুনতে পায় না।
হঠাৎ সব ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে দেন কিরণময়ী। কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, সুধাময়কে তিনি এক কাপ চা দিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে–তিনি কেঁদে ওঠেন, তাঁর কান্নার তীব্র শব্দে সুধাময় চকিতে উঠে বসেন, সুরঞ্জন ছুটে আসে। দেখে কিরণময়ী ঘরের দেয়ালে মাথা রেখে কাঁদছেন, তার সাহস হয় না এই কান্না থামাতে, এ কান্না থামবার নয়, এই কান্না কেঁদে যাবার, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর জল যখন জমতে জমতে বুকের নদী উঠি পড়তে চায়, কোনও বাঁধ থাকে না তাকে আটকে রাখে। সুধাময়ও নতমুখ, স্থির; কান্না থেকে উঠে আসা তীব্ৰ হাহাকার তাঁর বুকেও গিয়ে বেঁধে। কান্না থামে না। কেন কাঁদছেন কিরণময়ী কেউ জিজ্ঞেস করে না; কেন তাঁর এত বুকফাটা আর্তনাদ, তা সুধাময় সুরঞ্জন দুজনই যেন জানে, তাদের আর জানিবার দরকার হয় না।
সুরঞ্জন দরজায় দাঁড়িয়েছিল, নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে যেন কিরণময়ীর কান্না তার পায়ের শব্দে থেমে না যায়। তাঁর ভেতরের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, চূর্ণ হয়, পুড়ে যায়, ছাই হয়ে যায় তার সাজানো স্বপ্ন। কিরণময়ী যেমন হঠাৎ বাড়িটির নিস্তব্ধতা ভেঙে কেঁদে উঠছেন, তেমন সুরঞ্জনও হঠাৎ কান্না ভেঙে চিৎকার করে ওঠে–বাবা।
সুধাময় চমকে তাকান। সুরঞ্জন তাঁর দুটো হাত চেপে ধরে, বলে–বাবা, আমি কাল সারারাত একটা কথা ভেবেছি, তুমি আমার কথা রাখবে না জানি। তবু বলছি তুমি আমার কথা রাখো। কথাটা রাখো বাবা। চল আমরা চলে যাই।
সুধাময় জিজ্ঞেস করেন—কোথায়?
–ইন্ডিয়া।
–ইন্ডিয়া? সুধাময় এমন আঁতকে ওঠেন যেন অদ্ভুত একটি শব্দ শুনলেন তিনি, যেন ইন্ডিয়া অত্যন্ত অশ্লীল একটি শব্দ, একটি নিষিদ্ধ শব্দ, এটি উচ্চারণ করা অপরাধ।