দুদিন টানা শুয়ে থেকে সুরঞ্জন যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়, দেখে কিরণময়ী চমকে উঠে বলেন–কোথায় যাচ্ছিস?
—দেখি শহরের অবস্থা কী। হরতাল কেমন হচ্ছে দেখে আসি।
—বাইরে যাস নে সুরো। কী হয় বলা যায় না।
—যা হয় হবে। মরতে তো একদিন হবেই। আর এত ভয় পেও না তো। তোমাদের ভয় দেখলে আমার রাগ ধরে। চুলে সিঁথি কাটতে কাটতে সুরঞ্জন বলে।
কিরণময়ী কেঁপে ওঠেন। তিনি ছুটে এসে সুরঞ্জনের হাত থেকে চিরুনি কেড়ে নেন। –কথা শোন সুরঞ্জন। একটু সাবধান হ। হরতালের মধ্যেই শুনছি দোকান ভাঙছে, মন্দির পোড়াচ্ছে। ঘরে বসে থাক। শহরের অবস্থা দেখার কোনও দরকার নেই।
সুরঞ্জন চিরকালের অবাধ্য ছেলে। সে কিরণময়ীর কথা মানবে কেন? বাধা ডিঙিয়ে চলে যায় সে। বাইরের ঘরে সুধাময় একা বসেছিলেন। তিনিও অবাক তাকিয়ে থাকেন। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে। ঘরের বাইরে বেরোতেই বিকেলের স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে খাঁ খাঁ নির্জনতা আর ভূতুড়ে স্তব্ধতা তার গায়ে বেঁধে। একটু কি ভয় ভয় লাগে তার!! লাগেই মনে হয়। তবু সুরঞ্জন ভেবেছে যখন আজ সে শহর ঘুরবে, ঘুরবেই। এবার তাদের নিতে বা দেখতে কেউ আসেনি। না বেলাল, কামাল, না কেউ। ওরা এলেও সুরঞ্জন যেত না, যাবে কেন? ক’দিন পর পরই হামলা হবে। আর তল্পিতল্পা সহ ছোটাছুটি, ছিঃ! নেহাত গর্দভ ছিল বলে গত বছর গিয়েছিল কামালের বাড়িতে। এবার এলে দিব্যি সে বলে বসন্ত ‘তোমরা মারবেও আবার দয়াও করবে, এ কেমন কথা। তার চেয়ে সকলে মিলে একটি কাজ কর। যত হিন্দু আছে দেশে, ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে মারো। মরে গেলে তোমাদের ঝামেলা চুকবে। মারতেও হবে না, আবার কায়দা করে বাঁচাতেও হবে না।’ সুরঞ্জন রাস্তায় উঠতেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, চেচিয়ে ওঠে ‘ধর ধর, হিন্দু ধর বলে। এই ছেলেগুলো পাড়ারই। বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে সাত বছর এদের দেখছে সে। সুরঞ্জন চেনেও দু-একজনকে। আলম নামের ছেলেটি প্রায়ই আসে। চাঁদা চাইতে। পাড়ায় একটি ক্লাব আছে। এদের। ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় সুরঞ্জন গানও গায়। কিছু ছেলেকে ডি এল রায় আর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শেখাবে ভেবেছিল সে। এরা প্রায়ই দাদা এটা করে দিন ওটা শিখিয়ে দিন বলে কাজে-অকাজে বাড়িতে ভিড় করে। এদেরই পাড়ার লোক বলে সুধাময় ফ্রি চিকিৎসা করছেন দীর্ঘদিন। আর এরাই ওই যে হিন্দু যায়, হিন্দু ধর’ বলে সুরঞ্জনকে ধরে পেটাবার ইঙ্গিত করে। সুরঞ্জন উল্টো পথে দ্রুত হেঁটে যায়, ভয়ে নয়, লজ্জায়; পাড়ার এই চেনা ছেলেগুলো তাকে ধরে পেটাবে ভাবলে নিজেরই লজ্জা হয়। নিজে মারি খাচ্ছে সে কারণে নয়, লজ্জা যারা পেটাবে তাদের জন্যই। লজ্জা বুঝি অত্যাচারিতের জন্য হয়, লজ্জা তো হয় অত্যাচারীর জন্য, দুৰ্বত্তের জন্য।
সুরঞ্জন হাঁটতে হাঁটতে শাপলা চত্বরের কাছে এসে থামে। থমথমে চারদিক। কোথাও কোথাও মানুষের জটিল। রাস্তায় ইটের টুকরো, পোড়া কাঠ, ভাঙা কাচ ছড়ানো, বোঝা হ্যায় এইমাত্র ভীষণ এক তাণ্ডব ঘটে গেছে। দু-একজন যুবক এদিক-ওদিক দৌড়োচ্ছে। কিছু নেড়ি কুকুর মধ্য রাস্তা বরাবর ছুটছে। টিংটিং বেল বাজিয়ে সামান্য কটি রিক্সা চলে যাচ্ছে ডানে বাঁয়ে। সে কিছু বুঝতে পারছে না কোথায় কী ঘটেছে। কুকুরগুলোর কীের্ণ ভয় নেই। জাতের ভয় নেই। তারা যে দৌড়োচ্ছে, সুরঞ্জন অনুমান করে খালি রাষ্ট্ৰী পাওয়ার আনন্দেই দৌড়োচ্ছে। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে দৌড়োতে। মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তা এতদিনে খালি পেয়ে সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে ছোটবেলার মত জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল শোিণত, অথবা খড়ির স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট। এরকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁকে একটি ঘর পোড়া। সাইনবোর্ড দরজা জানোলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটি ইপিন এয়ারলাইনসেক্স অফিস। কিছু লোক পােড়া অফিসটি দেখছে দাঁড়িয়ে, হাসছে। সুরঙ্গসুন্দর দিকে কেউ কি লুকুঁচকে তাকায়, সন্দেহ হয়। দ্রুত হাঁটে সে সামনের দিকে, ফে এইসব ঘরবাড়ি পুড়ে যাক, তার কী? সামনে সে দেখতে যাচ্ছে আর কী কী পুড়েছে, আৰু কি পোড়া পেট্রোলের মত পােড়া ইট কাঠের ভ্রাণ নিতে অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। হবে হয়?। হাঁটতে হাঁটতে সে সি পি বি অফিসের সামনে দেখে মানুষের ভিড়। রাস্তায় ইট পাটকলের ছড়াছড়ি। ফুটপাতে বই-এর দোকান ছিল। সূরঞ্জন এই ফুটপাত থেকে প্রচুর বই কনেছে। আধাপোড়া একটি বই সুরঞ্জনের পায়ে ঠেকে, ম্যাক্সিম গোর্কির মা। মুহূর্তে মনে হয়। সে পাভেল ভলািসভ। আর সে তার মায়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে পায়ের নীচে পিন্ধই। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সুরঞ্জনের। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে পোড়া বইটির সামল। চারদিকে জটলা, ফিসফিস কথা, চরম উত্তেজনা পুরো এলাকায়। কী হয়েছে, কী হবে এসব নিয়ে কথা বলছে সবাই। সি পি বি অফিসটি পোড়া। কমিউনিস্টরা তাদের স্ত্র্যাটেজি চেঞ্জ করে আল্লাহ খোদার নাম নিচ্ছে, তারপরও রেহাই পেল না। আগুন থেকে? কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বড় জানাজা হল, মিলাদও হল, তারপরও সাম্প্রদায়িকতার আগুন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পোড়ায়! পোড়া অফিস্টর দিকে নির্বক তাকিয়ে থাকে সুরঞ্জন। হঠাৎ সামনে পড়ে কায়সার। উড়েইগড়া চুল। শেভ না করা গাল, রক্তাভ কনজাংটিভা, কণ্ঠে উদ্বেগ তার, বলে—তুমি বেরিয়েছ কেন?