সুরঞ্জন প্রথম প্রথম চেঁচামেচি করত নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কবুতরের খোপে বাস করতে হচ্ছে বলে। তারপর তারও সয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, বন্ধু-বান্ধব গড়ে উঠেছে নতুন করে, ভাল লাগা এখানেও জন্মেছে। এখানেও রাজনীতিতে জড়িয়েছে সে। এখানেও মিটিং মিছিলে সুরঞ্জনের ডাক পড়ে। কিরণময়ী আপত্তি করেছিলেন, এখনও আপত্তি করেন, রাতে রাতে চোখের জল ফেলেন নিজের হাতে লাগানো সিমের ম্যাচটি কী আর আছে, আমাদের পেয়ারার মত অত বড় পেয়ারা পাড়ায় আর একটি ছিল না, আহা ডাবগাছগুলোর কী অবস্থা কে জানে, গোড়ায় কি ওরা লবণজল দেয়! কেবল কি কিরণময়ীর, সুধাময়েরও কি কষ্ট কম হয়।
ঢাকায় বদলি হয়ে সুধাময় ভেবেছিলেন প্রমোশনের ব্যাপারে খোঁজখবর কিছু করা যাবে। গিয়েও ছিলেন মিনিস্ট্রিতে, গিয়ে বসে থাকতে হয় ছোটখাটো কেরানির রুমে, বড়জোর এ পি এস-এর রুমে। ‘ভাই, ফাইলটার কি কিছু হবে? এসবের সদুত্তর কখনও মিলত না। হচ্ছে হবে জাতীয় কিছু শব্দ শুনে সুধাময়কে বিদায় নিতে হত। কেউ কেউ বলতেন, ‘ডাক্তারবাবু, মেয়ের আমাশা ওষুধ লিখে দিন, বুকের বাঁদিকটা ক’দিন থেকে ব্যথা করছে, ভাল ওষুধ দিন তো। * সুধাময় ব্রিফকেস খুলে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা প্রেসক্রিপশান প্যাড বের করতেন, তারপর গোটা গোটা অক্ষরে ওষুধের নাম লিখে দিতেন। জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার কাজটি হবে তো ফরিদাসাহেব?’ ফরিদাসাহেব একগাল হেসে বলতেন, ‘এসব কি, আর আমাদের হাতে মশাই? সুধাময় খবর পেতেন তাঁর জুনিয়ারদের প্রমােশন হচ্ছে। তাঁর ফাইলের ওপর চোখের সামনে ডাঃ করিমুদ্দিন, ডাঃ ইয়াকুব মোল্লার ফাইল পড়ল, ওঁরা এসোসিয়েট প্রফেসার-এর পোস্টিং নিয়ে কাজও শুরু করে দিলেন। সুধাময়ের জুতের সুখতলি কেবল খরচা হতেই লাগল। ওঁরা বললেন, ‘আজ নয় কাল আসুন, আপনার ফাইল সেক্রেটারির কাছে যাবে। কাল নয়। পরশু আসুন, আজ মিটিং আছে। মন্ত্রী দেশের বাইরে গেছেন, এক মাস পর আসুন’—এসব শুনতে শুনতে সুধাময় একদিন বুঝলেন তাঁর আসলে হবে না। দেড়-দু বছর পদোন্নতির পেছনে ছুটে তো দেখলেন যারা ডিঙিয়ে যাবার তারা যায়, যোগ্যতা না থাকলেও যায়। রিটায়ারমেন্টের সময় চলে আসছে, তাঁর প্রাপ্য ছিল এ সময় এসোসিয়েট প্রফেসারের পদটি, তিনি কোনও লোভ করেননি, এ তাঁর প্রাপ্য, জুনিয়ররা এই পদ নিয়ে মাথার ওপর বসে আছে।
শেষ পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক হিসেবেই অবসর গ্রহণ করলেন সুধাময় দত্ত। একইসঙ্গে চাকরি করতেন মাধব চন্দ্ৰ পাল, সুধাময়ের ফেয়ারওয়েলের দিন গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘মুসলমানের দেশে নিজের জন্য খুব বেশি সুযোগ-সুবিধে আশা করা ঠিক নয়। যা পাচ্ছি তাই আমাদের জন্য বেশি।’ বলেই তিনি ঠা-ঠা করে হেসেছিলেন। তিনিও দিব্যি সহকারীর চাকরি করে যাচ্ছেন, দু-একবার তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল পদোন্নতির জন্য, আর সব নাম নিয়ে আপত্তি না উঠলেও এই নামটি নিয়ে উঠেছে, তা ছাড়া মাধব চন্দ্রের আরও দোষ ছিল, তিনি নাকি সোভিয়েত ঘুরে এসেছেন। সুধাময় পরে ভেবেছিলেন মাধব চন্দ্র ভুল বলেননি, প্রশাসন, পুলিশ, কিংবা সেনাবাহিনীর উঁচু পদে হিন্দুদের নিয়োগ বা পদোন্নতির ব্যাপারে বাংলাদেশের আইনের কোনও বাধা নেই। কিন্তু দেখা যায় মন্ত্রণালয়গুলোয় কোনও সেক্রেটারি বা এডিশনাল সেক্রেটারি পদে কোনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি আছেন তিনজন, আর হাতে গোনা ক’জন আছেন ডেপুটি সেক্রেটারি। সুধাময়ের বিশ্বাস সেই গুটিকয় জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর ডেপুটি সেক্রেটারি নিশ্চয় পদোন্নতির আশা করেন না। ছয়জন মাত্র হিন্দু ডি সি আছেন। সারাদেশে। হাইকোর্টে হিন্দু জজ মাত্র একজন। পুলিশের নীচু পদে হয়ত তাদের নেওয়া হয়। কিন্তু এস পি পদে হিন্দু ক’জন আছেন? সুধাময় ভাবেন তিনি আজ সুধাময় দত্ত বলেই তাঁর এসোসিয়েট প্রফেসর হওয়া হয়নি। তিনি যদি মোহাম্মদ আলি অথবা সলিমুল্লাহ চৌধুরি হতেন তবে নিশ্চয় এই বাধা থাকত না। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলেও মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, বিশেষত শিল্পঋণ সংস্থা থেকে শিল্পকারখানা গড়বার জন্য ঋণ দেওয়াও হয় না।
সুধাময় দত্ত তাঁতিবাজারেই আবার নিজের বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। জন্মের শহর ছেড়েও তাঁর মায়া যায়নি, দেশের মায়া। বলতেন, ‘ময়মনসিংহই কি দেশ? পুরো বাংলাদেশই তো আমার দেশ।’
কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ব, দুটো সবজির গাছ লাগাব, ছেলেমেয়েরা গাছের ফল খাবে, এগুলো এখন স্বপ্নের মত, এখন মাস মাস ভাড়ী শুনতেই দেখি সব যায়।’ রাত গভীর হয়ে এলে কিরণময়ী প্রায়ই বলতেন, ‘বাড়ি বিক্রির টাকা আর রিটায়ার করার পর মোটা অঙ্কের টাকাই তো পেলে, চল চলে যাই, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন তো কম নেই আর!’
সুধাময় বলতেন—আত্মীয়রা একবেলা তোমাকে খাওয়াবে ভেবেছ? ভাবিছ উঠবে তাঁর বাড়িতে, গিয়ে দেখলে মুখ ফিরিয়ে রাখল, বলল কোথায় উঠলেন, চা-টা খাবেন কি না।
–নিজেদের টাকা পয়সা নিলে অন্যের কাছে হাতই বা পাততে হবে কেন?