সুধাময় ঢাকা এসে তাঁতিবাজারে উঠেছিলেন। তাঁর মামাতো দাদার বাড়ি ছিল তাঁতিবাজার। অসিত রঞ্জনই ছোট একটি বাড়ি দেখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—সুধাময়, তুমি বড়লোকের ছেলে। তুমি কি থাকতে পারবে ভাড়া বাড়িতে?
সুধাময় বলেছিলেন—কেন পারব না? আর মানুষ থাকছে না?
—তা থাকছে। কিন্তু তুমি তো জন্ম থেকে কোনও অভাব দেখনি। আর নিজের বাড়ি বিক্রি করলেই বা কেন? মায়া ছোট মানুষ। ও তো আর যুবতী মেয়ে ছিল না। নিশ্চয়ই সে ধরনের কোনও ঘটনা ঘটত না। আমাদের উৎপলাকে তো পাঠিয়েই দিলাম কলকাতায়। ও তো কলেজে যেতে পারত না। ওকে তুলে নেবে, ধরে নেবে এসব বলত পাড়ার ছেলেরাই। ভয়ে পাঠিয়ে দিলাম। এখন তিলজলায় ওর মামার বাড়িতে আছে। মেয়ে বড় হলে বড় দুশ্চিন্তা হয় দাদা।
অসিত রঞ্জনের কথাকে উড়িয়ে দিতে পারেন না। সুধাময়। হ্যাঁ দুশ্চিন্তা হয় বৈকি। তিনি ভাবতে চান মুসলমানের মেয়ে বড় হলেও তো দুশ্চিন্তা হয়। সুধাময়ের এক ছাত্রীকে রাস্তায় ফেলে শাড়ি টেনে খুলেছিল একদল যুবক, মেয়েটি তো হিন্দু ছিল না, ছিল মুসলমান। যুবকরাও মুসলমান ছিল, তবে? সুধাময় নিজেকে সান্ত্বনা দেন আসলে হিন্দু মুসলমান নয়, দুর্বল পেলে সবলেরা অত্যাচার কিছু করবেই। নারী দুর্বল বলে সবল পুরুষেরা অত্যাচার করছে। অসিত রঞ্জন তাঁর দুই মেয়েকেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সা ভাল রোজগার করেন, সোনার দোকান আছে ইসলামপুরে, নিজেদের দোতলা একটি বাড়ি আছে পুরনো, এটির সংস্কারও করেননি তিনি। নতুন বাড়ি করবেন, তাতে উৎসাহ নেই কোনও। সুধাময়কে একদিন বললেন—টাকাপয়সা খরচ কোর না। দাদা। জমাও। বাড়ি বিক্রির টাকা পারো তো পাঠিয়ে দাও, আমার আত্মীয়রা আছে ওখানে, জমি-টমি রেখে দেবে।
সুধাময় জিজ্ঞেস করেছেন–ওখানে মানে?
অসিত রঞ্জন গলা খাটো করে বলেছেন—কলকাতায়। আমিও কিনে রেখেছি।
সুধাময় গলা উঁচু করে বলেছেন—তুমি এখানে টাকা কামাবে। আর খরচা করবে গিয়ে ওদেশে? রীতিমত দেশদ্রোহী বলা যায় তোমাকে।
অসিত রঞ্জন অবাক হতেন। সুধাময়ের কথায়। ভাবতেন কোনও হিন্দুর মুখে এ ধরনের কথা তিনি তো শোনেননি। বরং টাকা পয়সা এখানে যথেচ্ছ খরচ না করে জমিয়ে রাখবার পক্ষপাতী সকলে। কখন কী হয় বলা তো যায় না। এখানে গেড়ে বসব, আর কখন কারা খুঁটি তুলে আছাড় মারে, বলা যায়?
সুধাময় মাঝে মধ্যে ভাবেন কেন তিনি ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে এলেন। নিজের বাড়ির মায়া তাঁকে এতটুকু কাতর করল না কেন? মায়াকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, হতেই পারে। অপহরণের ঝামেলায় হিন্দু মুসলমান দু সম্প্রদায়ই ভুগতে পারে। সুধাময় নিজের বাড়িতে কি নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন? নিজের কাছেই গোপনে জিজ্ঞেস করেন তিনি। তাঁতিবাজারের অপরিসর ঘর বারান্দায় শুয়ে বসে সুধাময় ভাবেন; কেন তিনি নিজের ভিটে ছেড়ে অচেনা একটি এলাকায় বাস করছেন। এ কি নিজেকে লুকোনো? কেন নিজের ভিটে মাটি নিয়েও উদ্বাস্তু মনে হত নিজেকে? নাকি শওকত সাহেবের জাল দলিলের মামলায় সুধাময়ের সন্দেহ হত তিনি হেরে যাবেন? নিজের বাড়ির মামলায় নিজের হারা। তার চেয়ে মান-সম্মান নিয়ে চলে যাওয়াই ভাল। সুধাময় তাঁর এক খুড়তুতো দাদাকে দেখেছেন নিজের বাড়ি খোয়াতে। বাড়ি ছিল টাঙাইলের আকুর টাকুর পাড়ায়। এক হাত জমির দখল নিতে চায় পাশের বাড়ির জমির মুন্সি। আদালতে মামলা উঠল, পাঁচ বছর পর্যন্ত মামলা গড়িয়ে গড়িয়ে জমির মুন্সির পক্ষ নিল। তারাপদ ঘোষাল দেশের পাট, চুকিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেছে। ইন্ডিয়া। শওকত সাহেবের মামলাটিরও তারাপদের দশা হয় কি না ভেবেই তিনি কি নিজের বাপ ঠাকুরদার বাড়িটি নিমেষে বিক্রি করে দিলেন? হবে হয়ত। এও কথা ঠিক, আগের সেই দাপট ছিল না। সুধাময়ের। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। ফাঁক পেলেই চলে যেত এক-একটি হিন্দু ফ্যামিলি। অনেকে মরে গেলেন। ক’দিন পর পরই চেনা পরিচিতদের বা আত্মীয় বন্ধুদের লাশ কাঁধে নিয়ে ‘হরি বোল বলো হরি’ বলতে হয়েছে। যাঁরা বেঁচে হিলেন, ছিলেন চরম হতাশা নিয়ে। যেন কোনও মূল্য নেই বেঁচে থাকায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সুধাময় লক্ষ করতেন, তিনিও ভয় পাচ্ছেন, যেন খুব শিগরি গভীর রাত্তিরে একটি দৈত্য এসে তাঁদের গুড়িয়ে দেবে। সকলের স্বপ্নের দেশ ইন্ডিয়া, গোপনে ফন্দি আঁটেন বডাির পার হবার। সুধাময় শুনে অনেকদিন বলেছেন—‘দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হল, কাপুরুষের মত পালালে ইন্ডিয়া। দেশ স্বাধীন হল তো বীরদৰ্পে ফিরে এলে। এখন কথায় কথায় এ ওকে টোকা মারল তো চলে যাবে ইন্ডিয়া, যতসব কাওয়ার্ডের দল।’ সুধাময়ের সামনে যতীন দেবনাথ, তুষার কর, খগেশ কিরণ সকলেই ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি করে নিলেন। তাঁরা মুখ ফুটে মনের কথা বলতে আর রাজি হন না। সুধাময় নিজের শহরে নিজে বড় একা হয়ে গেলেন। বন্ধু শাকুর, ফয়সল, মজিদ, গাফফারদের সঙ্গে দূরত্বও স্পষ্ট হচ্ছিল। হয়ত গেলেন ওঁদের বাড়িতে, বলে বসলেন—’তুমি একটু সামনের ঘরে বস, সুধাময়, নামাজটা সেরে আসি, অথবা ‘আজ এলে, আজ তো বাড়িতে মিলাদ। বামপন্থীদের বয়স বাড়ে আর তাঁরা ধর্মে মনোযোগী হন, সুধাময় বড় নিঃসঙ্গ বোধ করেন। নিজের শহরে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেকের এই দৈন্য তাঁকে আহত করে খুব, তিনি তাই পালাতে চাইলেন, দেশ থেকে নয়, স্বপ্নের শহরটি ছেড়ে, যেন তাঁকে আর হাঙরের মত গিলে না খেতে পারে স্বপ্নের নীল নিকষ মৃত্যু।