সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে–তোর ইচ্ছে হলে তুই চলে যা, আমি এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ব না।
–আর ওঁরা?
–জানি না।
–যদি কিছু হয়?
–কী হবে!
–ধর, বাড়ি লুট করল। পুড়িয়ে ফেলল।
–ফেলবে।
–তুমি তার পরও বসে থাকবে?
–বসে না, শুয়ে থাকব।
সুরঞ্জন খালি পেটে একটা সিগারেট ধরায়। তার চায়ের তেষ্টা পায়। কিরণময়ী সকালে এক কাপ চা তাকে দেন, আজ দিচ্ছেন না। এ সময় তাকে কে দেবে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। মায়াকে বলা বৃথা। পালাবার কথা ছাড়া আপাতত মেয়েটি কিছুই ভাবছে না। চা বানাতে বললে ওর গলা আবারও সপ্তমে চড়বে। সে নিজেই উঠে বানিয়ে নিতে অয়ারে, কিন্তু আলস্য তাকে ছাড়ছে না। ওঘরে টেলিভিশন চলছে। তার ইচ্ছে হয় না সি এন এন-এর সামনে চোখ গোল গোল করে বসে থাকতে। ওঘরে খানিক পর পর মায়া চেঁচিয়ে উঠছে–দাদা শুয়ে আছে, পেপার পড়ছে, তার কোনও হুঁশ নেই।
হুঁশ সুরঞ্জনের নেই এ কথা ঠিক নয়। সে ঠিকই বোঝে যে কোন সময় দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারে একদঙ্গল লোক, তাদের কতক চেনা কতক অচেনা, তারা বাড়ির জিনিপত্র ভাঙবে, লুট করবে, আর যাবার সময় বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেবে। এ অবস্থায় কামাল বা হায়দারের বাড়িতে উঠলে কেউ বলবে না আমাদের জায়গা নেই। কিন্তু তার খুব লজ্জা হয় যেতে। মায়া চেঁচাচ্ছে–তোমরা না যাও আমি একাই তবে চলে যাই। পারুলের বাড়ি গিয়ে বসে থাকি। দাদা কোথাও নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার না হয় বেঁচে থাকার দরকার নেই, আমার আছে।
মায়া ধারণা করছে সুরঞ্জন যে কারণেই হোক আজ কারও বাড়িতে তাদের লুকোতে নেবে না। অগত্যা সে নিজেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি সুরঞ্জনকে ভোগায় খুব।
নিরাপত্তা নব্বই-এর অক্টোবরেও ছিল না। ঢাকেশ্বরী মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দিল একদল লোক। পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, বাধা দিল না। পুড়ে গেল মূল মন্দির, ওরা ধ্বংস করে ফেলল নাটমন্দির, শিবমন্দির, অতিথিশালা, অতিথিশালার পাশে শ্রীদাম ঘোষের বাস্তুভিটে। মন্দিরের ভেতরের জিনিসপত্র লুট করল। মাধব গৌড়িয় মঠের মূল মন্দির ধ্বংস করল। ওদিকে জয়কালী মন্দির চূর্ণ করে দিল। ব্রাহ্ম সমাজের বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরের ঘরটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিল। রামসীতা মন্দিরের ভেতর কারুকাজ করা ঠাকুরের সিংহাসনটি বিধ্বস্ত করে ফেলল। বিধ্বস্ত করল মূল ঘর। নয়াবাজারের মঠ ভেঙে ফেলল। বনগ্রাম মন্দির ভেঙে ফেলল শাবল চালিয়ে। শাঁখারি বাজারের মুখে সাতটি হিন্দুর দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হল। শিলা বিতান, সোমা ট্রেডার্স, সেলুন, টায়ারের দোকান, লণ্ড্রি, মিতা মার্বেল, সাহা কেবিন, রেস্টুরেন্ট কিছুই রক্ষা পেল না। শাঁখারি বাজারের মোড়ে এমন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল যে যতদূর চোখ যায় ধ্বংসের চিহ্ন ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। ডেমরায় শনির আখড়ার মন্দির লুট হল। পঁচিশটি পরিবারের বাড়িঘর লুট করল দু’তিনশ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী। লক্ষ্মী বাজারের বীরভদ্রের মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ভেতরের সব নষ্ট করে দিল। ইসলামপুর রোডের ছাতা আর সোনার দোকানগুলোয় আগুন লাগিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের মরণচাঁদ মিষ্টির দোকান ভেঙে ফেলল। ভেঙে ফেলল পুরানা পল্টনের মরণচাঁদও। রায়ের বাজারের কালী মন্দিরের মূর্তি মাটিতে ফেলে ভাঙল। সূত্রাপুরে হিন্দুদের দোকান লুট কর, ভেঙে, মুসলমানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের ঘোষ এণ্ড সন্স-এর মিষ্টির দোকানটি লুটপাটের পর নবাবপুর যুব ইউনিয়ন ক্লাব-এর একটি ব্যানার দোকানের ওপর টাঙিয়ে দিল। ঠাঁটারি বাজারের বটতলি মন্দির ভেঙে তছনছ করা হল। নবাবপুরে রামধন পশারি নামের পুরনো দোকানটি লুট করা হল। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির মাত্র কয়েক গজের মধ্যে শুকলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ভেঙে চুরমার করা হল। যতীন এণ্ড কোং-এর দোকান এবং কারখানা ভেঙে ফেলল, ঘরের জিনিসপত্র পুড়ল। ঐতিহাসিক সাপ মন্দিরের অনেকটা গুঁড়ো করে ফেলল, সদরঘাট মোড়ে রতন সরকারের মার্কেট লুটপাট করল, ভাঙচুর করল। সুরঞ্জনের চোখের সামনে একটি একটি করে ভেসে ওঠে ভাঙা পোড়া সেইসব বীভৎস দৃশ্য। এর নাম কি দাঙ্গা? নব্বই-এর ঘটনাকে কি দাঙ্গা বলা যায়? দাঙ্গা অর্থ মারামারি–এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের নাম দাঙ্গা। কিন্তু একে তো দাঙ্গা বলা যায় না, এ হচ্ছে এক সম্প্রদায়ের ওপর আরেক সম্প্রদায়ের হামলা। অত্যাচার। নির্যাতন। জানলা গলে রোদ এসে পড়ে সুরঞ্জনের কপালে। শীতের রোদ, এ রোদে গা পোড়ে না। শুয়ে থেকে সে চায়ের তৃষ্ণা অনুভব করে।
(চলবে)
লজ্জা (০১-খ)
এখনও সেইসব দৃশ্য সুধাময়ের চোখে ভাসে। কাকা পিসি মামা মাসিমা একে একে চলে যাচ্ছেন। ময়ময়সিংহ জংশন থেকে ট্রেন ছাড়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে। কয়লার ইঞ্জিন এক আকাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে যখন পুঁউউ হুইসেল বাজায়, ট্রেনের কমপার্টমেট থেকে বুক ভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে আসে। পাড়া-পড়শিও যাচ্ছে আর তাগাদা দিচ্ছে—‘সুকুমার, এ হচ্ছে মুসলমানের হোমল্যান্ড। এখানে নিজের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নেই।’ সুকুমার দত্ত এক কথার লোক, তিনি বললেন—‘নিজের জন্মের মাটিতে যদি নিরাপত্তা না থাকে, নিরাপত্তা তবে পৃথিবীর কোথায়? দেশ ছেড়ে পালাতে আমি পারব না। তোমরা যাচ্ছ যাও। আমার বাপ ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। নারকেল সুপুরির বাগান, ধানি জমি, দু বিঘার উপর বাড়ি—এসব ছেড়ে শিয়ালদা স্টেশনের উদ্বাস্তু হব এ আমার ইচ্ছে নয়।’ সুধাময়ের তখন উনিশ বছর বয়স। কলেজের বন্ধুরা চোখের সামনে চলে যাচ্ছে, বলছে—‘তোর বাবা কিন্তু পরে পস্তাবে।’ সুধাময় তখন বাবার মত বলতে শিখেছেন—‘নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাব কেন? মরলে এই দেশেই মরব, বাঁচলে এই দেশেই।’ কলেজ ফাঁকা হয়ে গেল সাতচল্লিশে, যারা যায়নি, তারা যাব যাব করছে। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলমান ছাত্র আর রয়ে যাওয়া কিছু দরিদ্র হিন্দুর সঙ্গে কলেজ পার করে লিটন মেডিকেলে লেখাপড়ে করলেন সুধাময়।
বাহান্নোয় চব্বিশের টগবগে যুবক তিনি। ঢাকার রাস্তায় তখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে সাহসী ও সচেতন বাঙালি তরুনেরা। তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নত ন্যুব্জ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে, মিছিলে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে, রক্তে রাজপথ ভেসে যায়, তবু কেউ দাবি ছাড়েনি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করবার দাবি। সুধাময়ের তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা, মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ‘বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়েছেন। পুলিশের গুলিতে যেদিন রফিক সালাম বরকত জব্বার প্রাণ হারান, সুধাময় ছিলেন সেই মিছিলে। তাঁর বুকেও লাগতে পারত গুলি। তিনিও হতে পারতেন এ দেশের মহান শহীদদের একজন।
উনসত্ত্রের গনআন্দোলনেও সুধাময় ঘরে বসে থাকেননি। আয়ুব খানের পুলিশবাহিনী তখন মিছিল দেখলেই গুলি ছোঁড়ে, এগারো দফা নিয়ে বাঙালি তবু মিছিলে নামা ছাড়ে না। পুলিশের গুলিতে নিহত আলমগীর মনসুর মিণ্টুর লাশ কাঁধে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহের রাস্তায় হেঁটেছেন, পেছনে শত শত শোকস্তব্ধ বাঙালি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আরেকবার মুঠো শক্ত করেছে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ কথা প্রমাণ করেছে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশভাগ হওয়া ছিল ভুল একটি সিদ্ধান্ত। আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন– It is one of the greatest frauds on the people to suggest that religious affinity can unite areas which are geographically, economically and culturally different. It is true that islam sought to establish a society which transcends racial, linguistic, economic and political forntiers. History has however proved that after the first few decades or at the most after the first century, Islam was not able to unite all the muslim countries on the besis of Islam alone.
জিন্নাহও জানতেন দ্বিজাতিতত্ত্বের অসাড়তার কথা। মাউন্টব্যাটেন যখন পাঞ্জাব আর বাংলা ভাগ করবার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন জিন্নাহ নিজেই বলেছিলেন—A man is Punjabi or a Bengali before he is Hindu or Moslem. They share a common history, language, culture and economy. You must not divide them. You will curse endless bloodshed and trouble.