কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার সবাহন গ্রামে উনিশ শ উনআশি সনের আটই ফেব্রুয়ারি ভোরে হিন্দু ঋষি সম্প্রদায়ের ওপর আশেপাশের গ্রামের প্রায় চারশ লোক অতর্কিতে আক্রমণ চালায়, তারা চিৎকার করে ঘোষণা করে, ‘সরকার দেশে ইসলামকে রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ঘোষণা করেছে। তাই ইসলামি দেশে থাকতে হলে তোদের সবাইকে মুসলমান হতে হবে। মুসলমান না হলে এ দেশ থেকে তোদের পালিয়ে যেতে হবে ৷ ‘ এই লোকগুলো ঋষি সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাড়ি লুট করে, আগুন জ্বলিয়ে দেয়, মন্দির ধূলিসাৎ করে, অনেককে ধরে নিয়ে যায়, যাদের এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ করা হয়। এই হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও অনেকে আছেন।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার আবীরদিয়া গ্রামের নৃপেন্দ্ৰ কুমার সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী অনিমা সেনগুপ্তাকে একজন এডভোকেটের বাড়িতে আটকে রেখে সোয়া আট বিঘা জমি জোর করে রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়েছে। উনিশ শ উনআশি সনের সাতাশে মার্চ তারিখে অনিমা নরসিংদী পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন যে, আসামীরা তাঁকে ভয় দেখায়, এলাকার লোকও ভয়ে কিছু বলতে পারে না। এরপর অনিমাকে চার দিন হাজতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।
সে বছর সাতশে মে তারিখে পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার বউলাকান্দা গ্রামে দশ-বারো জন সশস্ত্ৰ লোক হালদার বাড়িতে হামলা করে। ওরা বাড়ির জিনিসপত্র লুট করে, মন্দির ভেঙে সোল্লাশে শ্লোগান দিয়েছে, ‘মালাউন নিধন কর, মন্দির ভেঙে মসজিদ কর।’ ওরা হিন্দুদের শিগরি দেশ ত্যাগের জন্যও বলে যায়।
চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গশ্চি গ্রামের বৈদ্যবাড়িতে মে মাসের নয় তারিখে দিনে-দুপুরে বোমা ফাটিয়ে, বাড়ি জ্বলিয়ে, গুলি করে প্রায় এক-দেড়শ জন মুসলমান তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে।
ষোলই জুন পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর গ্রামে দশ-বারো জন পুলিশ গৌরাঙ্গ মণ্ডল, নগেন্দ্ৰ মণ্ডল, অমূল্য মণ্ডল, সুবোধ মণ্ডল, সুধীর মণ্ডল, হীরেন্দ্ৰ নাথ মণ্ডল, জহর। দেউরি সহ পনেরো-ষোলজন হিন্দুকে আটক করে এবং গৌরাঙ্গ মণ্ডলের বাড়ির উঠোনে এনে মারধোর শুরু করে। গৌরাঙ্গ মণ্ডলের স্ত্রী বেণু বাধা দিতে গেলে পুলিশেরা তাকে একটি ঘরে ধরে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। অন্য মহিলারা বাধা দিতে গেলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। সনাতন মণ্ডলের কন্যা রীণাকেও জোর করে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনার পর রাণাকে অপহরণ করা হয়। আজও রাণার কোনও খোঁজ নেই।
আঠারোই জুন তারিখে রাত এগারেটার দিকে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার চাঁদকাঠি গ্রামে তিনজন পুলিশ ও স্থানীয় চৌকিদার কিছু সশস্ত্ৰ লোক সহ তল্লাশি চালায়। তল্লাশি চালাবার সময় তারা হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করতে বলে। সর্বহারী পার্টির সদস্য বলে অভিযোগ করে তারা দুলাল কৃষ্ণ মণ্ডল সহ চার-পাঁচজন হিন্দুকে আটক করে থানায় নিয়ে অকথ্য নিযাতন চালায়। পরে আট-দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই এলাকার অনেক হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীর হাট ইউনিয়নের বারোটি গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর শুরু হয়েছে। অকথ্য নিযাতন। নিবাচনে হেরে গিয়ে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোল্লা জামালউদ্দিন ভাড়াটে লোক লাগিয়ে হিন্দুদের চাষাবাদে বাধা দিচ্ছে, মাঠের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে, গরু ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, দোকানপাট লুট করছে।
বরিশাল জেলার দুর্গাপুর গ্রামে অর্পিত সম্পত্তির অন্যায় ভাবে লিজ গ্রহণ ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে মামলার কারণে অষ্ট আশি সনের দশই ডিসেম্বর আবদুস সোবহান ভূঁইয়া ও ইউ পি সদস্য গোলাম হোসেন অস্ত্রশস্ত্র ও দলবল নিয়ে রাজেন্দ্রনাথ দাসের বাড়িতে চড়াও হয়। তারা রাজেন্দ্রনাথের বাড়িতে খুন করবার হুমকি দেখিয়ে বাড়ির সোনাদানী লুট করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ মূর্তিও নিয়ে গেছে, যারা দিতে চায়নি, তাদের ইচ্ছেমত পেটানো হয়েছে। যাওয়ার আগে ওরা রাজেন্দ্রনাথ দাসকে সপরিবারে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে যায়।
অষ্ট আশির ছাব্বিশে আগস্ট সকালে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় তািলবুনিয়া গ্রামে কিছু মৌলবাদীর প্ররোচনায় অশীতিপর বৃদ্ধ লক্ষ্মণ চন্দ্ৰ পালের বাড়িতে ঢুকে বৃদ্ধের নাতি বিকাশ চন্দ্ৰ পালকে পুলিশের খুব পেটায়, লক্ষ্মণ চন্দ্রের বড় ছেলে পুলিন বিহারী পাল ও মেজ ছেলে রবীন্দ্রনাথ পালকেও মারধোর করে। পুলিনের বউ পুলিশের কাজে বাধা দিতে গেলে পুলিশ তাকেও বেদম পেটায়। পুলিশ এরপর পুলিন, রবীন্দ্রনাথ আর বিকাশকে বেঁধে থানায় নিয়ে যায়, সেখানে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হাজতে পাঠিয়ে দেয়। তাদের জামিন দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার কিছু আগে শোলাকুড়া গ্রামের আবদুল হাকিম মোল্লা লক্ষ্মণ চন্দ্রের ভাইয়ের মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল এবং বাড়ির অন্য সদস্যদের পিটিয়েছিল। এই অপরাধে দীর্ঘকাল জেলবাস হয় হাকিম মােল্লার। জেল থেকে ফিরে তালবুনিয়া গ্রামের সিরাজ মল্লিক, হারুণ মল্লিক ও আবদুল জব্বার কাজিকে নিয়ে প্রতিশোধ নেয় পুলিশ দিয়ে লক্ষ্মণচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের এ ধরনের শাস্তি দিয়ে। এই ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতায় এলাকার অনেক হিন্দুই দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছে।