এটুকু বলে হরিপদ গভীর মুখে বসে থাকেন। বলেন—কিছু ঠিক করেছেন? এখানেই থাকবেন? থাকাটা উচিত হবে বলে মনে হয় না। আমি তো ভেবেছিলাম শ্বশুরবাড়ি চলে যাব। মানিকগঞ্জে বাড়ি। তো আজ সন্ধ্যায় আমার বড় শ্যালক এসে বলল মানিকগঞ্জ শহরে আর ঘিওর থানায় প্রায় একশ বাড়ি লুট করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পাঁচিশটি মন্দির ভেঙে আগুন জ্বালিয়েছে। বাকবুড়ি বলে একটি গ্রাম আছে, ওই গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দেবেন শোরের মেয়ে সরস্বতীকে মাঝরাতে আট-দশজন ছেলে বাড়ি থেকে সোজা উঠিয়ে নিয়ে রেপ করে।
—বালছ কী! সুধাময় আর্তনাদ করে ওঠেন।
–আপনার মেয়েটি কোথায়?
—মায়া গেছে ওর বান্ধবীর বাড়িতে।
–মুসলমানের বাড়ি তো!
–হ্যাঁ।
–তা হলে ঠিক আছে। হরিপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
কিরণময়ীরও স্বস্তি হয়। সুধাময় চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেন–আসলে এদিকটাতেই যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ময়মনসিংহে তেমন দাঙ্গা হতে দেখিনি কিন্তু। আচ্ছা, আমাদের ময়মনসিংহে কিছু হয়েছে বলে শুনেছ নাকি হরিপদ?
–শুনলাম গত রাতে ফুলপুর থানার বাথুয়াদি গ্রামে দুটো মন্দির, একটা পূজা মণ্ডপ, আর ত্রিশালে একটি কালীমন্দির ভেঙে ফেলেছে।
—শহরে তো কিছু হয়নি নিশ্চয়ই। দেশের উত্তর দিকটায়। এসব আসলে কমই হয়। আমাদের ওদিকে, কী বল কিরণময়ী, মন্দির পোড়াবার ঘটনা কিছু শুনেছ নাকি কখনও!
–নৰ্থ ব্ৰুক হল রোডের সার্বজনীন পূজা অফিস, জমিদার বাড়ি কালী প্রতিমা, মন্দির সবই ধ্বংস করে ফেলেছে। আজ শান্তিনগরে জলখাবার মিষ্টির দোকান, শতরূপা স্টোর লুট করে ভেঙে পুড়িয়েও দিয়েছে। কুষ্টিয়ায় ছটা মন্দির গতকাল গভীর রাতে জামাত শিবিরের লোকেরা ভেঙে ফেলেছে। তারপর ধরুন চিটাগাং, সিলেট, ভোলা, শেরপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালির কথা যা শুনেছি, আমার তো ভয় হচ্ছে খুব।
—কিসের ভয়? সুধাময় প্রশ্ন করেন।
–এক্সোডাস।
–আরো না। এদেশে ওইভাবে দাঙ্গা বাধবে না।
–নব্বই-এর কথা ভুলে গেলেন দাদা। নাকি তা তেমন গুরুতর বলে মনে হয়নি আপনার?
–ও তো এরশাদ সরকারের সাজানো ঘটনা ছিল।
—কি যে বলছেন দাদা। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবটি দেখলেই তো পারেন। এবারের এক্সোডাস ভয়ঙ্করই হবে। সাজানো ঘটনায় মানুষ দেশের মাটি ছেড়ে এভাবে চলে যায় না। দেশের মাটি তো আর ফুলের টবের মাটি নয়। জল সার দিলাম। আর কদিন পর পর পাল্টালাম। দাদা, ভয় হয় খুব। এক ছেলে কলকাতায় পড়ালেখা করে। দু মেয়ে আছে। এখানে। মেয়েরা বড় হয়েছে, রাতে ঘুমোতে পারি না। ভাবছি চলেই যাব।
সুখময় আঁতকে ওঠেন। এক ঝটিকায় চশমাটি খুলে নিয়ে বলেন–পাগল হয়েছ তুমি হরিপদ? এমন অলক্ষুণে কথা উচ্চারণও কোরো না।
–এ কথাই তো বলবেন যে এখানে আমার প্র্যাকটিস ভাল। ভাল টাকা পয়সা কামাচ্ছি। নিজের বাড়ি আছে। তাই না?
—না হরিপদ। সে কারণে নয়। সুযোগ-সুবিধে আছে বলেই যে তোমার যাবার কথা ওঠে না তা নয়। সুযোগ-সুবিধে না থাকলেই বা যাবার প্রশ্ন উঠবে কেন? এ তোমার দেশ নয়? আমি তো রিটায়ার্ড লোক। আয় রোজগার নেই। ছেলেটা কোনও চাকরি-বাকরি করে না। রোগী দেখার টাকায় সংসারটা চলে। দিন দিন রোগী কমছে। আমি কি তাই বলে চলে যাব?. দেশ ছেড়ে চলে যায় যারা, তারা কি মানুষ? যা কিছুই হোক যত দাঙ্গাই ঘটুক, বাঙালি তো আর অসভের জাত নয়। একটু-আধটু কোলাহল হচ্ছে, থেমে যাবে। পাশাপাশি দুটো দেশ, এক দেশের আগুন আরেক দেশে তো একটু-আধটু ছিটকে আসবেই। মাইন্ড ইট হরিপদ, চৌষট্টির দাঙ্গ বাঙালি মুসলমান বাঁধায়নি, বাঁধিয়েছিল বিহারীরা।
হরিপদ গায়ের চাদরে নাক মুখ ভাল করে ঢেকে নিয়ে বলেন—এই যে চাদরের তলে মুখখানা লুকিয়ে বেরোচ্ছি, সে কিন্তু বিহারীদের ভয়ে নয় দাদা, আপনার বাঙালি ভাইদের ভয়েই।
হরিপদ আলগোছে দরজা খুলে বেরিয়ে পা টিপে টিপে বাঁয়ের গলিতে অদৃশ্য হয়ে যান। কিরণময়ী দরজা দু আঙুল ফাঁক করে সুরঞ্জনের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠেন। খানিক পর পরই মিছিল যাচ্ছে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়ে। তাদের ভাষ্য, ভারত সরকারকে যে করেই হোক বাবরি মসজিদ গড়ে দিতে হবে, নইলে রক্ষা নেই।
সুরঞ্জন বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে। টলতে টলতে ফেরে। কিরণময়ীকে জানিয়ে দেয় তার খিদে নেই, রাতে সে ভাত-টাত খাবে না।
২গ.
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সুরঞ্জন। তার ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ অস্থিরতায় তার সারারাত কাটে। যেহেতু ঘুম আসেই না সে এক পা এক পা করে অতীতে ফেরে। এই রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি ছিল—জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। বাহান্নার ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও তার চূড়ান্ত পৰ্য্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক ও ধমন্ধি শক্তি পরাস্ত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সংবিধানের চরিত্র পরিবর্তন করবার পর মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাখ্যাত ও পরাজিত সেই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি পুনবাসিত হয়। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবার অপকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার পর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা খুব বেশি বেড়ে যায়।