—হুঁ পেয়েছি। যারা তালি দিত, তারাই বলত হিন্দু মেয়েদের লজ্জা শরম নেই বলেই তাঁরা গান শেখে, পরপুরুষের সামনে গা দেখিয়ে গান গায়।
—মুসলমান মেয়েরা বুঝি গান গায় না? সুধাময় সামাল দিতেন।
—সে তো এখন গায়। আগে যখন গাইত না তখন টিপ্পনিগুলো তো আমাদের শুনতে হত। এত ভাল গাইতেন মিনতিদি, একপাল ছেলে একদিন ধরল তাঁকে, তিনি নাকি মুসলমান বাড়ির মেয়েদের গান শেখাবার তাল করছেন।
—গান শেখানো তো ভাল জিনিস। সুধাময় বলেছিলেন।
–ছেলেরা বলল মুসলমান মেয়েদের গান গাওয়া ঠিক নয়। গান গাওয়া খারাপ, গান গাইলে তারা নষ্ট হয়ে যাবে।
–ও।
কিরণময়ীও আর তেমন মন দেননি। গানে। মিথুন দে মাঝে মাঝেই বলতেন, তোর গলাটা ভাল ছিল কিরণ, ছেড়েই দিলি গানটা।
কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন—দাদা, ভাল লাগে না কিছু। মনে হয় কী হবে গেয়ে। এইসব নাচ গান তো মানুষ পছন্দ করে না। খারাপ বলে।
ছাড়তে ছাড়তে ছাড়াই হয়ে গেল। গান। সুধাময় জোর করেননি যে তোমার গাইতে হকেই। তবে মাঝে মধ্যে অনুযোগ করতেন, ‘বাইরে না গাঁও, ঘরে তো গাইতে পারে।’ ঘরে কী আর গাওয়া হয়। রাত গভীর হয়ে এলে ঘুম আসছে না। এমন অস্থির সময়ে দুজন ইন্সে উঠতেন। ব্ৰহ্মপুত্রের জন্য, ব্ৰহ্মপুত্রের কাছে ফেলে আসা বাড়িটির জন্য দুজনেরই মন কাঁদত। দূর নক্ষত্রের দিকে দুজনেই নিবাক তাকিয়ে থাকতেন। কিরণময়ী গুন গুন করতেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা বলব। কী রে হয়, শুনে সুধাময় যে এত শক্ত মনের *মানুষ, তাঁরও কেমন কেমন জানি লাগত। তাঁরও ফিরে পেতে ইচ্ছে করত। শৈশব কৈশোরের খেলার মাঠ, ইস্কুলের আঙিনা, ভরা নদী, নদীতীরের ঘন বনের ভেতর-পথ ধরে ব’ন পীরের দিকে যাওয়া। এত যে কঠিন হৃদয়ের মানুষ সুখময়, সুধাময়ই রাতে রাতে কিরণময়ীকে দু হাতে বুকে জাপটে ধরে কেঁদে উঠতেন। সুধাময়ের কষ্ট্রের কোনও গণ্ডি নেই। একাত্তরে জগন্ময় ঘোষাল, প্রফুল্প সরকার, নিতাই সেন প্রায় চোখের সামনে খুন হলেন। ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলত, পরদিন ট্রাক ভরে ফেলে আসত বধ্যভূমিতে। হিন্দু পেলেই পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে আসত, বুটের লাথি, বেয়নেটের খোঁচা, চোখ উপড়ে নেওয়া, পিঠের হাড় ভেঙে দেওয়া এসব যখন করত মনে হত বুঝি ছেড়ে দেবে, শেষ পর্যন্ত কিন্তু মেরে ফেলত। অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে ছেড়ে দিতে দেখেছে সুধাময়, হিন্দুকে ছাড়তে দেখেনি। মেথরূপট্টির কুয়ো ভর্তি হিন্দু আর মুসলমানের লাশ গাদাগাদি করে ফেলে রাখা ছিল, মাজেদ, রহিম, ইক্লিস-এর আত্মীয়রা, দেশ স্বাধীনের পর কুয়োর ভেতর থেকে যেদিন হাজার হাজার হাড় ওঠানো হল, ওই হাড়ের ওপর পড়ে চিৎকার করে কেঁদেছিল, কোন হাড় মাজেদের, কোন হাড় অনিলের কে বুঝবে? সুধাময়ের ভাঙা পা, পাঁজরের ভাঙা তিনটে হাড় জোড়া নিয়েছিল, কাটা পেনিসের ঘা-ও শুকিয়ে এসেছিল, কিন্তু বুকের ক্ষত শুকোয়নি, চোখের জলও শুকোয়নি। বেঁচে যাওয়া খুব কি বড় কিছু? শরীরে বেঁচে গিয়ে সুধাময়ের কিন্তু মনে হয়নি ক্যাম্প থেকে ফিরে খুব বেঁচে গিয়েছিলেন। ফুলপুরের অর্জুনখিলা গ্রামে আবদুস সালাম নাম নিয়ে তিনি দীর্ঘ সাত মাস কাটিয়েছিলেন একটি বাঁশের বেড়ার ঘরে, সুরঞ্জনকে ডাকতে হত সাবের বলে, কিরণময়ীকে যখন একঘর লোক ফাতেমা বলে ডাকত, সুধাময়ের লজ্জা করত শুনতে, পাঁজরের ভাঙা হাড় বুকে যত খোঁচা দিত, তার চেয়ে ফাতেমা নামের খোঁচা বুকে বাজত বেশি। ডিসেম্বরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ফুলপুরে নেমে এল, সারা গ্রাম ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দে নেচে উঠল, পুরো সাত মাস না ডাকতে পারা প্রিয় নামটি সেদিন প্ৰাণ ভরে ডেকেছিলেন সুধাময়—কিরণ, কিরণ, কিরুণাময়ী। বুকে জমিয়ে রাখা তাঁর কােষ্ট্রর আগুনগুলো সব নিভে গেল। এই-ই সুধাময়ের জয় বাংলা। কিরণময়ীকে গলা ছেড়ে হাজার মানুষের সামনে কিরণময়ী ডাকবার স্বাধীনতাকেই তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে জানেন।
হঠাৎ কড়া নড়বার বিশ্ৰী শব্দ শুনে দুজনে চমকে ওঠেন। এসেছেন। হরিপদ, হরিপদ ভট্টাচার্য। জিভের তলে নিফিকার্ড ট্যাবলেট দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকবার পর ব্যথাটি সামান্য কমে সুধাময়ের। হরিপদ ঘরের লোকের মতই। হরিপদকে দেখে সুধাময় উঠে বসেন। ‘কী আপনার অসুখ করল নাকি? খুব পেইল লাগছে!’
—হ্যাঁ হরিপদ। কদিন থেকে শরীরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। প্রেসারটাও দেখা হয় না।
–আগে জানলে আমি বি পি মেশিনটা নিয়ে আসতে পারতাম।
কিরণময়ী বলেন–সুরঞ্জনটা এ সময় বাইরে বেরোল, বুঝুন অবস্থা। আর আপনিই বা এলেন কি করে?
–শর্টকাট মেরেছি। বড় রাস্তা দিয়ে আসিনি।
অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না, হরিপদ গায়ের চাদরটি গা থেকে খুলে নিয়ে বলেন-চাকায় আজ বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদ হচ্ছে, আবার শান্তি মিছিলেও বেরিয়েছে, রাজনৈতিক দল আর বিভিন্ন সংগঠন সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি বজায় রাখবার আহ্বান জানিয়েছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংযত ও সহিষ্ণু থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, শেখ হাসিনাও বলেছেন, যে কোনও মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি বজায় রাখুন। ভারতে দাঙ্গায় দুশ তেইশজন নিহত, চল্লিশটি শহরে কার্ফ, সাম্প্রদায়িক দলগুলো নিষিদ্ধ, নরসীমা রাও বাবরি মসজিদ নতুন করে তৈরি করবে। কথা দিয়েছেন।