সুরঞ্জনকে বাড়ি পাঠানোর জন্য অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে চেনে না। এমন দু-একজন ছুটে এসে জানতে চায় হয়েছে কী। ওরা বুঝিয়ে বলে ও হিন্দু, ওর এখানে থাকাটা ঠিক নয়। সকলে মাথা নেড়ে সায় দেয়, হ্যাঁ চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু সে তো ঘরে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসেনি। ওরা তার পিঠ আলতো খুঁয়ে, হাত টেনে রিক্সায় ওঠাতে যাবে আর তখনই সুরঞ্জন হাত ছাড়িয়ে নেয়। সে তার হাতখানা একটু হেঁচকাটানেই ছাড়ায়।
২খ.
সুখময় সটান শুয়ে থাকতে চান, পারেন না। অস্থির লাগে। সুরঞ্জন আবার এ সময় বাইরে বেরিয়েছে। ও বেরোবার পর টুকটুক শব্দ হয় দরজায়। সুধাময় লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়েন। সূরঞ্জনই ফিরে এল। কিনা। না সুরো নয়, এসেছেন আখতারুজ্জামান। এ পাড়ায় বাড়ি তাঁর। রিটায়ার্ড অধ্যাপক। বয়স ষাটের ওপর। ঘরে ঢুকেই ছিটিকিনি আটকে দিলেন নিজ হাতে। ‘কী কিছু হয়নি তো?’ আখতারুজ্জামান প্রশ্ন করলেন চাঁপা স্বরে। ‘কইনা তো কি হবে? সুধাময় ঘরের বিছানা টেবিল বইপত্রর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়েন। আখতারুজ্জামান নিজেই চেয়ার টেনে বসেন। সারভাইক্যাল স্পনডিলাইটিসের রোগী। ঘাড় সোজা রেখে চোখের মণি নেড়ে বলেন-বাবরি মসজিদের অবস্থা তো জানেন? কিছু নেই। আর। ছিঃ ছিঃ।
一হুঁ।
—কিছু বলছেন না যে। সাপোর্ট করছেন?
–সাপোর্ট করব কেন?
—তবে যে বলছেন না কিছু?
—খারাপ লোক খারাপ কাজ করেছে। দুঃখ করা ছাড়া আর কী বা করার আছে?
-একটি সেকুলার রাষ্ট্রে যদি এই অবস্থা হয়। ছিঃ ছিঃ। সমস্ত রাষ্ট্ৰীয় পরিস্থিতি, সমস্ত রাজনৈতিক ঘোষণা, সুপ্রিম কোর্ট-লোকসভা-পর্টি, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য-সবই আসলে ফাঁকা আওয়াজ। যাই বলুন সুধাবাবু, ভারতে যত দাঙ্গা হয়েছে, এ দেশে তুলনায় কিন্তু কিছুই হয়নি।
–হুঁ। চৌষট্টির পর নব্বই–এই প্রথম বড় দাঙ্গা হল।
—চৌষট্টি না বলে পঞ্চাশ বলাই ভাল। পঞ্চাশের পরে চৌষট্টিতে দাঙ্গা যা হয়েছিল, সবচেয়ে বড় দিক ছিল সাম্প্রদায়িকতার স্পনটেনিয়াস প্রতিরোধ, যেদিন দাঙ্গা শুরু হয়, সেদিনই মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরি আর আবদুস সালামের উদ্যোগে প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ব্যানার হেডিং ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। প্রতিবেশী এক হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে যেয়ে পঞ্চান্ন বছর বয়সের আমীর হোসেন চৌধুরি প্রাণ দিলেন। আহা।
সুধাময়ের বুকের ব্যথাটি বাড়ে। তিনি চৌকিতে গা এলিয়ে দেন। এক কাপ গরম চা খেতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু চা-টা দেবে কে? সুরঞ্জনের জন্য কিরণময়ী দুশ্চিন্তা করছেন। একা একা বাইরে গেল, গোলই যদি হায়দারের সঙ্গে গেলেই পারত। কিরণময়ীর দুশ্চিন্তাটি সুধাময়ের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। সুরঞ্জনের আবেগ বরাবরই ঘন, তাকে ঘরে আটকে রাখা যায় না, সুধাময় তা জানেনও, তবু দুশ্চিন্তা তো এমন নয় যে তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা যায়। তিনি সেটিকে বুকের মধ্যে পুষে আখতারুজ্জামানের প্রসঙ্গে ফেরেন—শান্তিই নাকি সকল ধর্মের মূল গন্তব্য অথচ সেই ধর্মকে নিয়ে কত অশান্তি, কত রক্তপাত, মানুষের কত লাঞ্ছনা হতে পারে এই শতাব্দীর শেষে এসে তাও দেখতে হল। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে মানুষ এবং মনুষ্যত্বকে যেভাবে গুড়িয়ে ফেলা যায় তেমন আর কোনও কিছু দিয়েই সম্ভব হয় না।
আখতারুজ্জামান বলেন–হুঁ।
কিরণময়ী দু কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। ‘কী, ব্যথাটা তোমার বাড়ল নাকি? ঘুমের ওষুধটা না হয় খেয়ে নাও’ বলে দুজনের সামনে কাপদুটো রেখে তিনি চৌকিতে বসেন। আখতারুজ্জামান বলেন-বৌদি তো বোধহয় শাঁখা সিঁদুর পরেন না, তাই না?
কিরণময়ী চোখ নামিয়ে বলেন–পঁচাত্তরের পর থেকে পরি না।
— বাঁচা গেল। তবুও সাবধানে থাকবেন। সাবধানের মার নেই।
কিরণময়ী স্নান হাসেন। সুধাময়ের ঠোঁটেও এই হাসিটি সংক্রামিত হয়। আখতারুজ্জামান চায়ে দ্রুত চুমুক দেন। সুধাময়ের বুকের ব্যথা কমে না। তিনি বলেন–আমিও তো ধুতি ছেড়েছি সেই কবে। ফর দা সেক অফ ডিয়ার লাইফ, মাই ফ্রেন্ড।
আখতারুজ্জামান চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে বলেন–চলি, ওদিকে বিনোদবাবুকে একবার দেখে যাব ভাবছি।
সুধাময় টান টান শুয়ে থাকেন। চা জুড়িয়ে পড়ে থাকে। শিয়রের কাছের টেবিলে। কিরণময়ী দরজার খিল এটে বসে থাকেন। বাতির উল্টোদিকে বসা, মুখে তাঁর ছায়া পড়েছে, একসময় চমৎকার কীর্তন গাইতেন কিরণময়ী। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নামকরা পুলিশ অফিসারের মেয়ে কিরণময়ী। ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। সুধাময় বলতেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত গাঁও কিরণ। ওস্তাদ রেখে দিই।’ মিথুন দে-র কাছে ক’বছর শিখেওছিলেন। গান গাওয়ার ডাকও পড়ত। ময়মনসিংহের নানা অনুষ্ঠানে। সুধাময়ের মনে পড়ে টাউন হলে একবার গান গাইতে গিয়েছিলেন কিরণময়ী। তখন সুরঞ্জনের বয়স তিন কী চার বছর। শহরে গানের শিল্পী হাতে গোনা ক’জনই ছিলেন। সমীর চন্দ্ৰ দে গেয়ে যাবার পর কিরণময়ী এলেন। সুধাময় সামনের সারিতে বসে রীতিমত ঘামছিলেন, কী জানি কেমন গান, কিরণময়ী গাইলেন—’আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।’ অডিয়েন্স চিৎকার করে উঠল, ওয়ান মাের ওয়ান মোর। এরপর ধরেছিলেন–‘ভুবনেশ্বর হে, মোচন কর বন্ধন সব মোচন করা হে। প্ৰভু মোচন কর ভয়, সব দৈন্য করাহ লয়, নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর নিঃসংশয়।’ এত দরদ দিয়ে গাইছিলেন যে শুনে সুধাময়ের মত নাস্তিক মানুষের চোখেও জল চলে এসেছিল। দেশ স্বাধীনের পর বাইরে গান গাইতে যেতে চাইতেন না কিরণময়ী। উদিীচীর অনুষ্ঠানে সুমিতা নাহা গাইবে, মিতালি মুখার্জি গাইবে, সুরঞ্জন মায়ের কাছে আবদার করত তুমিও গাইবে চল। কিরণময়ী হাসতেন ‘রেওয়াজ করি না, এখন কী আর আগের মত গলা আছে!’ সুধাময় বলতেন—যাও না অসুবিধে কী। আগে গাইতে, লোকে তো চেনেও অনেকে। হাততালিও তো পেয়েছ একসময়।‘