- বইয়ের নামঃ লজ্জা
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
লজ্জা (০১-ক) – সুরঞ্জন শুয়ে আছে
লজ্জা – তসলিমা নাসরিন
সুরঞ্জন শুয়ে আছে
সুরঞ্জন শুয়ে আছে। মায়া এসে বারবার তাড়া দিচ্ছে–‘দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর। দেরি হলে কিন্তু অঘটন ঘটে যেতে পারে।’ সুরঞ্জন জানে এই ব্যবস্থার নামে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকা। ইঁদুর যেমন গর্তে ঢোকে ভয়ে, ভয় কেটে গেলে বা পরিস্থিতি শান্ত হলে চারদিক দেখেশুনে লুকোনো জায়গা থেকে ইঁদুর যেমন বেরিয়ে আসে; তেমনই তাদেরও লুকোতে হবে, পরিস্থিতি শান্ত হলে এদিক ওদিক দেখে তবেই বেরোতে হবে লুকোনো জায়গা থেকে। কেন সুরঞ্জনকে নিজের ঘর ছেড়ে পালাতে হবে–-তার নামে সুরঞ্জন দত্ত বলে? বাবার নাম সুধাময় দত্ত, মায়ের নাম কিরণময়ী দত্ত, বোনের নাম নীলাঞ্জনা দত্ত বলে বাবা, মা, বোনকে বাড়ি ছাড়তে হবে? কালাম, বেলাল বা হায়দারের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে যেমন নিয়েছিল দু বছর আগে? তিরিশে অক্টোবর সকালে কামাল তার ইস্কাটনের বাড়ি থেকে কিছু একটা আশঙ্কা আঁচ করে ছুটে এসেছিল, সুরঞ্জনকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে বলেছিল–‘শিগরি চল, দু-চারটে কাপড়চোপড় তড়িঘড়ি গুছিয়ে নে। বাড়িতে তালা দিয়ে সবাই চল তো। দেরি করিস নে, চল চল।’ কামালের বাড়িতে তাদের যত্নআত্তির অভাব হয়নি, সকালে ডিম রুটি–দুপুরে মাছ ভাত–বিকেলে লনে বসে ধুম আড্ডা–রাতে পুরু গদির বিছানায় ঘুম, চমৎকার কেটেছিল। কিন্তু কেন তাকে কামালের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়! কামাল তার অনেক দিনের বন্ধু। আত্মীয়স্বজন নিয়ে তার বাড়িতে ক’দিন সে থাকতে পারে কিন্তু তাতে থাকতেই হবে কেন? তাকে কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়, কামালকে তো পালাতে হয় না? এই দেশ কামালের যতটুকু, সুরঞ্জনেরও ঠিক ততটুকু। নাগরিক অধিকার দুজনের সমান হবারই কথা। কিন্তু কামালের মত সে কেন উদ্ধত দাঁড়াতে পারে না! সে কেন দাবি করতে পারে না আমি এই মাটির সন্তান, আমার যেন কোন আমার যেন কোনও অনিষ্ট না হয়!
সুরঞ্জন শুয়েই থাকে, ওঠে না। মায়া এঘরে ওঘরে অস্থির হাঁটে। বোঝাতে চায় কিছু একটা ঘটে গেলে পরে দুঃখ করে লাভ নেই। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখাচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে স্তব্ধ বসে আছেন সুধাময় আর কিরণময়ী। তাঁরাও ভাবছেন সুরঞ্জয় বুঝি এবারও নব্বই-এর অক্টোবরের মত কোনও মুসলমান বাড়িতে তাঁদের লুকোতে নেবে। কিন্তু আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না সুরঞ্জনের। সারাদিন শুয়েই কাটাবে সে ভাবে। কামাল বা কেউ নিতে এলে বলবে–‘বাড়ি ছেড়ে যাবো না, যা হয় হোক।’
.
আজ ডিসেম্বরের সাত তারিখ। গতকাল দুপুরে অযোধ্যার সরযূ নদীরে তীরে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। করসেবকরা সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে। করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তিনটি গুম্বুজসহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পুরো ঘটনাই ঘটে বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরং দলের সর্ব্বোচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পি এ সি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের নৃশংস কাণ্ড দেখে। দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে একটি গম্বুজ ভাঙা হয়, চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটে পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজও ভেঙে ফেলে উম্মত করসেবকরা। সৌধ ভাঙতে গিয়ে চারজন করসেবক ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক।
সুরঞ্জন শুয়ে শুয়েই পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোয়। আজ ব্যানার হেডিং–‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত।’ সে অযোধ্যায় যায়নি। বাবরি মসজিদ দেখেনি। দেখবে কী করে, দেশের বাইরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি। রাম কোথায় জন্মেছিল, আর তার কোন মাটি ফুঁড়ে মসজিদ গজিয়েছে এসব তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। তবে ‘ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে যে কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত; সমগ্র কল্যাণবোধের ওপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত’–এ কথা সে মানে। ‘বাংলাদেশেও বাবরি মসজিদ নিয়ে হয়ে যাবে প্রচণ্ড তাণ্ডব। মন্দিরগুলো ধুলিস্যাৎ হবে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়বে, দোকানপাট লুট হবে। বি জে পি-র উস্কানিতে করসেবকেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে এ দেশের মৌলবাদী দলকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করছে। বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর তাদের সহযোগীরা কি তাদের উন্মত্ত আচরণের জের কেবল ভারতের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে ভেবেছে? ভারতে শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মরছে পাঁচশ ছশ একহাজার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। হিন্দুর স্বার্থরক্ষকরা কি জানে দু থেকে আড়াই কোটি হিন্দু এই বাংলাদেশে আছে? শুধু বাংলাদেশে কেন, পশ্চিম এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে হিন্দু রয়েছে, তাদের কী দুর্দশা হবে হিন্দু মৌলবাদিরা একবার ভেবেছে? রাজনৈতিক দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির জানা উচিত ভারত কোনও বিচ্ছিন্ন জম্বুদ্বীপ নয়। ভারতে যদি বিষফোঁড়ার জন্ম হয় তার যন্ত্রণা শুধু ভারতই ভোগ করবে না, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বিশ্বে, অন্তত প্রতিবেশী দেশে তো সবার আগে।’
সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। তার গা ধাক্কা দিয়ে মায়া বলে–তুমি উঠবে কি না বল। বাবা মা তোমার ভরসায় বসে আছেন।